উৎসর্গ...
যাদের কথা এবং কাজ দুটোতেই আমি মুগ্ধ !
প্রিয়, তারিক আলমগীর ভাই ও তারিকুর রহমান শামীম ভাই
এবং
প্রিয় তারিক রিদওয়ান, প্রিয় বন্ধুবরেষু
আমি আশা করব, আপনি সুযোগ পেলেই আপনার নির্ভরতার হাতখানা
আমার ঘাড়ে রাখবেন- বিশ্বাসী বন্ধুর মতন..........।
ভূমিকা.....
আপনাকে আমি চিনি না, কোন দিন দেখিও নি। তবুও আপনাকে না জানিয়েই আপনার জীবনের কিছু অংশ নিয়ে একটা কিছু লিখার স্পর্ধা দেখালাম। আমায় ক্ষমা করবেন। যোজন যোজন কষ্ট নিয়েও মানুষকে কিভাবে হাসতে হয় তা আপনি জানেন।কিন্তু আপনি এটা জানেন না, এভাবে হাসতে পারাটা একটা গুণ ! কোন দিন আপনার সাথে দেখা হবে কি না জানি না। তবুও দূর থেকে দোয়া করি, আপনি ভালো থাকেন, স্রস্টা যেন আপনাকে সুখের সন্ধান পাইয়ে দেন।
১।
দু’ঠোঁট বাঁকা করে শীষ বাজাচ্ছে হিয়া । শীষ বাজাচ্ছে আর কিছুক্ষণ পর পর পাশের বান্ধবী গুলোকে কি যেন বলছে।
হিয়া যে শিল্পীকে উদ্দেশ্য করে শীষ বাজাচ্ছে তা সে জানে। হিয়া ক্রমাগত শীষ বাজিয়েই যাচ্ছে।
খানিকক্ষণ পর হিয়া তার বান্ধবীদের নিয়ে শিল্পীর পাশে এসে বসল।
কি রে শিল্পী, মন খারাপ ? এমন করে বসে আছিস কেন ??
সাথে সাথেই শিল্পীর বুকটা ধ্ক করে ওঠে। শিল্পী বলে, এমনি।
স্বামী বুঝি ফোন করে নি, তাই না ???
না, না সে কারনে নয়। এমনি মন খারাপ।
হিয়া বলে, ইদানিং তো তোকে মোবাইলে কথা বলতেই দেখি না। জামাইবাবু কি ছেড়ে দিল নাকি তোকে ? নাকি আবার অন্য কোন মেয়ের পাল্লায় পড়েছে ???
কথাটা বলেই হিয়া আর তার বান্ধবীরা হাসতে থাকে।
শিল্পী কিছু বলে না। কেবল অপরাধীর মত চুপ করে থাকে। এদের মত আরো অনেক মানুষ আছে যারা তার ক্ষতস্থানে লবণ দিয়ে তার কষ্ট বাড়াতে ভালোবাসে।
একসময় হাসি থামিয়ে হিয়া বলে: দেখ তোর স্বামী নিশ্চিত অন্য কোন মেয়ের হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
স্বরটাকে দুঃখী দুঃখী করে বলে, তোর জন্য আমার খুব দুঃখ হয়রে শিল্পী।
কথাটা শুনেই শিল্পীর পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। সে বুঝতে পারে, হিয়া সমবেদনায় ব্যাথিত হয়ে কথাটা বলে নি. বরং করুনা করে কথাটা বলেছে।
আর করুণা শিল্পীর একদম পছন্দ না।
কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটিতে শিল্পী পড়ছে। অন্তত এতটুকু বোঝার তার ক্ষমতা হয়েছে যে, কোন মানুষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কোন কথা বলে। কোনটা করুনা, কোনটা সমবেদনায় ব্যথিত হওয়ার ভাষা।
২।
রাত হলেই বাবা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে কি যেন খোঁজেন !
একটু দূর থেকে দেখলে মনে হবে, বাবা যেন মূর্তির মত তাকিয়ে আছেন।
মাঝে মাঝে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বাবা হো হো করে হেসে ওঠেন।
এভাবে একা একা হাসেন, আবার হঠাৎ করেই হাসি থেমে যায়।
আমি বাবার কাছে গিয়ে বসি। কৌতুহলী হয়ে বলি, বাবা প্রতিদিন আপনি কি খোঁজেন ???
অসীম আগ্রহ নিয়ে বাবার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করি।
বাবা বলে, ও শিল্পী.........। স্রস্টাকে খুঁজিরে মা। তিনাকে যে আমার অনেক প্রশ্ন জিঞ্জেস করার আছে।
সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্যই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি।
মা রান্নাঘর থেকে এসে বলেন, শিল্পীর বাবা, প্রতি রাতে কি আপনার এই পাগলামি গুলো না করলে ভালো লাগে না ?
বাবা বলে, পাগলামি না শিল্পীর মা, বল অন্বেষণ। আমার সাথে তুমিও বোস। আকাশের দিকে তকাও। অন্ধকারেরও একটা সৌন্দর্য আছে।
তোমার আমার প্রত্যেকেরই জীবনে কিছু কিছু অন্ধকার মুহূর্ত আছে।
সাথে সাথে শিল্পীর মা বলে, কি সব আবোল-তাবোল বলেন !!!
এর ফাঁকে আমি আস্তে করে আমার রুমের দিকে পা বাড়াই। রুমে ঢুকতেই কি যেন মনে করে আমি আবার মা-বাবার দিকে ফিরে চাই ।
দেখি বাবা মায়ের হাতটা ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।
আমি জানি, তারা আমার জন্যই কাঁদেন। অতি অল্প বয়সে ডিভোর্স পাওয়া মেয়ের অসহায়ত্বে কাঁদেন। আশেপাশের মানুষ যে আমায় নিয়ে নানান কথা বলে, আমায় নিয়ে বাজে মন্তব্য করে সেগুলোর জন্য কাঁদেন।
তাদের কষ্ট দেখে আমার চোখও ঝাপসা হয়ে ওঠে।
মুখ ফিরিয়ে আমি রুমে গিয়ে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে পড়ি। আর চোখের কোণা দিয়ে নীরবে গরম জল গড়িয়ে পড়ে।
কোথা থেকে যেন একটুকরো বিষন্নতা এসে ঠাঁই নিল শিল্পীর মনে, আর সেটি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল তার সমস্ত অস্তিত্ব আর একাকীত্বে।
৩।
কখন যে ঘুম ভেঙে গেছে টেরই পাই নি। টপ টপ করে পানি পড়ার শব্দ কানে আসছে।
তাহলে কি আপু ট্যাপটি খোলা রেখেছে ? আপুর কথা মাথায় আসতেই রাজ্যের চিন্তা এসে মাথায় ভর করল।
আচ্ছা কি করছে আপু ? ঘুমোচ্ছে না কি জেগে আছে ? ধক করে উঠল বুকের ভিতর।
কি করব ? আপুর ঘরে গিয়ে কি একবার দেখে আসব ? না, থাক ।
মাথার ভিতর একপ্রকার শূন্যতার ছড়াছড়ি। মনেহচ্ছে, সময় যেন থমকে গেছে। কোন উৎকন্ঠা নেই। সব কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। চারদিকে নির্লিপ্ততার আবেশ। হঠাৎ বিছানা থেকে উঠতে গিয়েও পারলাম না। স্থির হয়েই রইলাম।
হঠাৎ ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখলাম, শিল্পী আপু দেয়ালের পাশে দাড়িয়ে আছে। একটু পরে দেয়ালে মাথা ঠেকাল। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বলছে, আমার কোন কষ্ট নেই, কোন কষ্ট নেই। আপু কাঁদছে আর কথাটা বলছে।
নিজেকে যেন নিজেই সান্তনা দিচ্ছে। আর কষ্টগুলো গড়িয়ে পড়ছে চোখের লোনা জল হয়ে। দুই বছর প্রেম করার পর বাবা-মায়ের অসম্মতি সত্ত্বেও বিয়ে করা, আবার বিয়ের ৬ মাসের মাথায় ডিভোর্স হয়ে যাওয়া আর মৌন দুঃখে তার মন ভরে গেছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন তার মনের ভিতর।
কাঁদুক আরো বেশি করে কাঁদুক আপু। মনের ভিতর জমে থাকা কষ্ট আর দীর্ঘশ্বাস গুলো যদি তাতে একটু হলেও কমে। তাহলেও যদি একটু হালকা হতে পারে ...........।
আধঘন্টা পরে আমি আপুর রুমে গিয়ে দেখি. সে হাটুতে থুতলি লাগিয়ে বসে আছে। এভাবে আপুকে দেখে আমার খুব মায়া লাগে। আমি কাছে গিয়ে তার পিঠে হাত রাখি।
ঘন-কালো অন্ধকার, তবুও দূরে কোথাও একটু আলো দেখা যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর আস্তে করে আপুকে বলি, আপু.....! সরলতা মানুষকে ছোট করে, কষ্ট দেয় প্রতি মুহূর্তে। জগতে এ সরল মানুষেরাই বাস্তবকে পাশ কাটিয়ে আবেগে ভেসে বেড়ায়। এরা না পায় সুখ, না পায় মর্যাদা।
সাথে সাথেই ফোঁত করে কেঁদে ওঠে আপু। জ্যোৎস্নার ম্লান আলোয় তার চোখদুটো চিক চিক করতে থাকে। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আপু আমার দিকে তাকায়।
আমার কি করা উচিত রে নিতু ? আপুর এই প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাই না। খুব চেষ্টা করি তবুও কিছু মাথায় আসে না। সান্তনা দেওয়ার মত কিছু খুঁজে পাই না। স্থবির মনে হয় সবকিছু- মাথার উপর বিশাল আকাশ এমনকি সময়টাকেও......।
৪।
সেই সন্ধ্যা থেকে একনাগারে পড়ছে শিল্পী। বাইরে কি হচ্ছে কোন খবর নেই। যেন বাইরের উথাল-পাথাল সমুদ্রের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। নির্লিপ্ত হয়ে কেবলমাত্র নিজের জগত নিয়েই ব্যস্ত।
পড়তে পড়তে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে দেখে লিপু তার বিছানায় এসে চুপ করে বসে আছে।
কখন আসলা লিপু ? আমিতো বুঝতেই পারি নি।
বই বন্ধ করে শিল্পী লিপুর পাশে এসে বসে।
লিপু শিল্পীর বেশ ভক্ত। কিছু কিছু মানুষ থাকে যারা অপর কোন মানুষকে অকারনেই অসম্ভব ভালবাসে। লিপুও ঠিক তেমন।
শিল্পী বলে, কি রে মন খারাপ ?
লিপু বলে, হুঁ। কেন রে ?
মা খুব অসুস্থ......। কথাটা বলেই লিপু কাঁদতে কাঁদতে শিল্পীর বুকে শিশুদের মত আচড়ে পড়ে। সাথে সাথেই শিল্পী লিপুকে জড়িয়ে ধরে।
পরম মমতা নিয়ে লিপুর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, কাদিঁস না লিপু। দেখবি অতি অল্প দিনেই মা সুস্থ হয়ে উঠবে। এভাবে বাচ্চা মেয়েদের মত কেউ কাঁদে !!!!!!!!!
তোকে আজ আর তোর রুমে যেতে হবে না, আমার সাথে ঘুমাবি।
কই শুয়ে পড়। আমি তোর কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, তুই ঘুমা।
নিজের যোজন যোজন কষ্ট থাকার পরও অন্য কোন মানুষের কষ্ট দেখলেই তাকে স্থান দেয় হৃদয়ের একেবারে গভীরে.........। হয়ে যায় তারও কাছের মানুষ..........।
৫।
রিক্সায় করে কাজলা থেকে হলের দিকে ফিরছিল শিল্পী।
আশেপাশের দাড়িয়ে থাকা মানুষগুলো ফিসফিস করছে আর বলছে, দেখ ঐ যে শিল্পী, আরে সেই মেয়েটা যে স্বামীর সাথে ৬ মাস সঙসার করার পর ডিভোর্স হয়ে যায়। নিশ্চই মেয়েটার খারাপ কিছু ছিল তাই স্বামী ছেড়ে দিয়েছে।
শিল্পী কিছু বলে না, কেবলই মাথা নিচু করে রিক্সায় বসে থাকে। মাঝে মাঝে ভাবে, আচ্ছা এই পৃথিবীতে কি আমিই একমাত্র ডিভোর্স পাওয়া মেয়ে, আর নেই ??? ডিভোর্স পাওয়াটা কি আমার পাপ, নাকি জীবনের মস্তবড় ভুল যার জন্য প্রায় প্রতিটি মানুষ আমায় খোঁচা দিয়ে কথা বলে ??????
কেউ শিল্পীর এসব প্রশ্নের উত্তর দেয় না।
মাথা নিচু করেই আছে শিল্পী। হঠাৎ এক নারীকণ্ঠ শিল্পী নামে চিৎকার করছে।
রিক্সার পিছনের ফাঁকা অংশ দিয়ে ফিরে তাকাতেই দেখে, তার কলেজ জীবনের বান্ধবী হীরা তাকে ডাকছে।
সাথে সাথেই রিক্সা থামিয়ে সে রিক্সা থেকে নামে।
হীরা কাছে এসেই শিল্পীকে জড়িয়ে ধরে বলে, কতদিন পর দেখা !!!!!!!!!!
বলেই হীরার চোখে আনন্দে জ্বল এসে যায়।
শিল্পী বলে, চল রুমে যাই।
রুমে গিয়েই বিছানায় দুই পা উঠিয়ে হীরা বসে পড়ে। শিল্পী বলে, কি খাবি ?
কিছু না। বোস, দু’জনে গল্প করি।
হীরা অনেকক্ষণ ধরে শিল্পীর দিকে তাকিয়ে আছে। শিল্পী বলে, ওভাবে কি দেখছিস ?
হীরা বলে, তোকে। তোর মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। নিজের যত্ন নেওয়া কি ছেড়ে দিয়েছিস নাকি ??
খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে শিল্পী বলে, না ছেড়ে দিই নি।
হীরা শিল্পীর গালে আলতো করে হাত রেখে বলে, কি হয়েছে রে তোর ?
আমার না ডিভোর্স হয়ে গেছে ........।
কথাটা শুনেই হীরার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়। কি বলিস এসব ??? বিস্ময়ের ভঙ্গিতে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আাছে হীরা। যেন সবকিছু থেমে গিয়েছে। অস্ত যাওয়া সূর্য, মাথার উপর বিশাল আকাশ, সময় কিংবা স্বপ্নবাজ মানুষের স্বপুনাও কিছুক্ষনের জন্য থমকে গেছে।
শিল্পী বলে,
তুই তো জানিস আমি অভিককে ভালোবাসতাম। বিশ্বাস কর, খুব মমতা নিয়ে ভালোবেসেছিলাম। এমন অনেক দিন গিয়েছে, আমরা সারাদিন বাইরে বেড়িয়েছি। আমার অন্য অনেক বান্ধবী বলত, এসব নাকি একদম ঠিক না। আমি বলতাম, কি জানি !
দুজন দুজনকে সারাদিনের সব কথাই বলতাম। আমার পরীক্ষার কথা ও আমায় মনে করিয়ে দিত; আর আমি ওকে ওর পরীক্ষার কথা মনে করিয়ে দিতাম। আমাদের মাঝে ঝগড়া হতো না, তবুও আমরা ঝগড়া করতাম- সামাজিক অসংগতি, বৈষম্য, অধিকার বিভিন্ন বিষয়ে। পরিশেষে আমরা দু’জনেই একই সিদ্ধান্তে উপনীত হতাম যে, আমরা সবাই সমান। সুন্দর সমাজ আর বসবাসযোগ্য বসুন্ধরা গঠনের জন্য সবার ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ।
দু’জনে পাশাপাশি বসে স্বপ্ন আঁকতাম। বর্ণিল প্রজাপতি, সুনীল আকাশ, রঙিন মেঘ এসে আমাদের স্বপ্নে রং ছড়িয়ে যেত। এভাবে একসময় পারিবারিক অনেক মানুষের অমত কিন্তু আমার প্রবল ইচ্ছায় আমাদের বিয়ে হয়। ছয় মাস আমরা বেশ ভালোভাবেই সংসার করি। চারদিক ভালোবাসার মূর্ছনায় পরিপূর্ণ ছিল। হঠাৎ একদিন একটা ব্যাপার টের পেয়ে যাই আমি । স্রস্টা এই একটা জায়গায় নারীদের পক্ষ নিয়েছেন। নারীরা আগে থেকেই টের পেয়ে যায় কিছু বিষয়। একটু বয়স হলেই টের পায় পৃথিবীর মানুষগুলো তার দিকে কিভাবে তাকাচ্ছে। টের পেয়ে যায় তাকে কিভাবে চলতে বলা হচ্ছে। তেমনি আমিও টের পেয়ে যাই, অভিক অন্য একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। ঐ মেয়েটা তার মনে এতটাই জায়গা করে নিয়েছে যে, সেখানে আর আমার কোন স্থানই ছিল না।
আমি ওকে এই বিষয় নিয়ে প্রশআন করলেই সে এড়িয়ে যেত। একদিন সে সত্যি সত্যি ধরা পড়ে যায়। অবশেষে সে আমার কাছে মুক্তি চায়। আমি তাকে সাথে সাথেই মুক্তি দিয়ে দিই। আমাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। সেইদিন অভিক এর চোখে ছিল মুক্তির আনন্দ, আমার চোখে ছিল কষ্ট আর ভালোবাসার বেদনায় নীল হয়ে যাওয়ার আগুন।
জানিস আমি এখন বাইরে বের হতে পারি না, বাড়িতেও যেতে পারি না। বাড়িতে গেলেই পাড়া-প্রতিবেশিরা বিভিন্ন কথা বলে। আমায় কুলটা, অলক্ষনী বলে গালি দেয়। আবার বলে, আমার নাকি স্বামীর ঘর করার যোগ্যতা নেই বলেই নাকি আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। আর বাসায় আসলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। মা-বাবা প্রায় সারাক্ষণই কাঁদতে থাকেন। অল্প বয়সে ডিভোর্স পাওয়া মেয়ের অসহায়ত্বে কাঁদেন, সন্তানের কষ্ট লাঘব করতে না পারার কষ্টে কাদেঁন........। আর এখানে ..... ?
আগে এই বিষয়টা কেউ জানত না। অভিক এর কথা জিঞ্জেস করলেই বলতাম, ও ভালো আছে। এখন বিষয়টা সবাই জানে। তবুও আছে যারা আমায় খোটা দেওয়ার জন্য সর্বদা তৈরি থাকে। সুযোগ পেলেই দু’চারটা কথা শুনিয়ে দেয়। হীরা শিল্পীর হাত ধরে রেখেছে। তার হাত দুটি কাঁপছে। শিল্পী বলে, বিশ্বাস কর হীরা, অভিককে ভালবেসে কতবার যে সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করেছে আমার, ও জানে না !!! ও জানে না !!! আজও আমি ওকে আমার হৃদয়ের একেবারে গভীরে অতি যত্নে রেখেছি। ও জানবে না, জানবে না কখনো। জানিস, আমার জীবনে যতগুলো আনন্দ এসেছিল তার সবগুলি কেড়ে নিয়েছে ও একচিলতে......: আর তাইতো আজ আমার হৃদয়ে আজ বাধভাঙা কান্নার আওয়াজ.......
বলতে বলতে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হীরাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমার কী দোষ ছিল রে হীরা ?? বল না হীরা ? ভালোবাসাটাই কি দোষ ???
হীরা কিছু বলে না। শিল্পীকে জড়িয়ে ধরে থাকে কেবলই। সাথে সাথে হীরার চোখ দিয়েও অবিরাম জ্বল গড়িয়ে পড়ে। বাইরে থেকে একটি মানুষকে দেখতে যতই শক্ত মনে হোক না কেন, তার ভিতর কি চলছে তাকি সহজে বোঝা যায় ??? না, যায় না। যোজন যোজন কষ্ট নিয়েও তারা পথ চলে ........নীরবে.......নীভৃতিতে.....
৬।
প্রায় প্রতিরাতেই শিল্পী জানালা দিয়ে ঐ দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি যেন ভাবে। অসংলগ্ন সব ভাবনা।
মাঝে মাঝে ভাবে, এই বুঝি অভিক তার কাছে এলো। এসে বললো, শিল্পী আমায় ক্ষমা করে দাও।
প্রথমে তোমায় ভালবাসলাম, অবশেষে বিয়েও করলাম। কিন্তু কিছুদিন পর হঠাৎ অন্য একটি মেয়ের প্রেমে পড়লাম। তারপর তোমায় ডিভোর্স দিয়ে দিলাম। কিন্তু মনের মাঝে সারাক্ষণই একটা অপরাধবোধ কাজ করত যা আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। আমি খুব কষ্টে আছি শিল্পী। আমায় ক্ষমা করে দাও। নইলে আমি এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাব না।
শিল্পী বলে, তুমি আগে আমার কাছে বাঁধন থেকে মুক্তি চেয়েছিলে, আমি তখনও তোমায় মুক্তি দিয়েছি। আর এখন অপরাধবোধ থেকে মুক্তি চাইছ !!!!!
আমি তো তোমায় কবেই ক্ষমা করে দিয়েছি অভিক। কারন, নারীরা ভালোবেসে ক্ষমা করতে শিখেছে জন্ম থেকেই। প্রতিদিন ভাবি আমি তোমায় ভুলে যাব। কিন্তু পারি না। তোমার দেওয়া কষ্ট আমায় ভুলতে দেয় না ..... কেবলই আমায় তাড়িয়ে বেড়ায়, যেভাবে ঠিক দুঃস্বপ্ন মানুষকে তাড়িয়ে ব্ড়োয়.....।
খানিকক্ষন পরে পিছন ফিরে দেখি সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমায় একা করে, নিঃস করে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে নিঃচিন্তে। কেবলই আমি জেগে আছি, দাড়িয়ে আছি রিক্ত হস্তে, তাকিয়ে আছি অপার শূন্যতা আর এক-সাগর কষ্টের লোনাজ্বল নিয়ে।
আচ্ছা, প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা, প্রবঞ্চিতকে দেয় দাহ। তাহলে অনুতপ্তকে কি দেয় ??????
হঠাৎ তার মন বলে ওঠে, প্রেম অনুতপ্তকে দেয় হাহাকার। তীব্র হাহাকার, পাঁজর ভাঙার মত হাহাকার। ঠিক সেই হাহাকার আজ আমারই মনে..........
কোন কোন পূর্ণিমার রাতে ঘরের জানালা দিয়ে রূপালী আলো ঘরের মেঝেতে এসে পড়ে। আমি জ্যোৎস্নার রূপালী আলোয় আমার ছায়া স্পষ্ট দেখতে পাই। রাতের নিস্তব্ধতায় আমি কেঁপে উঠি। নীরবে জ্বল গড়িয়ে পড়ে আমার দু’চোখের কোণা দিয়ে আর আমি আকুল হৃদয়ে প্রার্থনা করি – আল্লাহ, তুমিতো জানো আমার কষ্টগুলোর কথা। তুমিতো সব পারো, সব.....। পৃথিবীর সকল কিছু তোমারই সৃষ্টি। তোমার কত ক্ষমতা !!!!! তবে আমার কেন এত কষ্ট বলতে পারো ? কি দোষ ছিল আমার ? কবে আমার জীবনে সুখের পায়ড়া আনন্দের বার্তা নিয়ে আসবে ?????
আমি অসীম আগ্রহ নিয়ে স্রস্টার উত্তরের অপেক্ষা করি। অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করা পথিকের মত আমি তাকিয়ে থাকি অনাগত ভবিষ্যতের দিকে। বসন্ত এসে এক-সময় চলে যায়, পূর্ণিমা ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যায়। তবুও আমি স্রস্টার উত্তরের অপেক্ষায় থাকি।
আমার বিশ্বাস- স্রস্টা, কোন এক রাতে আমার সকল কষ্ট দূর করে দিবেন। সেদিন আমি বলবো; ‘আজ আমি সত্যি সুখী মানুষ। আমার আর কোন কষ্ট নেই। কোন কষ্ট নেই’..........