Wednesday, June 29, 2011

উপলব্ধি

উৎসর্গ…
প্রিয় আনোয়ার ভাই…
আপনার চমৎকার ব্যবহার শুধু আমাকেই না বরং আরো
অনেককেই মুগ্ধ করেছে, কিন্তু আপনি জানেন না !!!



এই শুনছো ? কই তুমি ? এতবার ডাকতে হয় তোমায় !!!!!! কি কাজে যে এত ব্যস্ত থাক তোমরা !!!!
খানিকক্ষণ পর রান্নাঘর থেকে শাড়ীর আঁচলে হাত মুছতে মুছতে আশরাফ সাহেবের স্ত্রী এসে বলে, কি ব্যাপার ? এত চিৎকার করে ডাকছেন কেন ???
আশরাফ সাহেব মুখটা গম্ভীর করে বলেন, চিৎকার করব না !!! এমন একটা খবর আছে যে তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে।
ভ্রু কুঁচকে তার স্ত্রী জিঞ্জেস করেন, কি খবর ???
আশরাফ সাহেব খানিকটা কাছে এসে মুখে হাসি এনে বলেন, তোমার ছেলে মেডিকেলে চান্স পেয়েছে।
ভাবলেশহীণ কন্ঠে তার স্ত্রী বলেন, এই সকাল সকাল কি আপনার দুষ্টুমি না করলে হয় না ???
আশরাফ সাহেব তার দুটো হাত দিয়ে আলতো করে তার স্ত্রীর গালদুটো ধরে বললেন, সত্যি তোমার ছেলে মেডিকেলে চান্স পেয়েছে।
এবার কথাটা শুনেই তার স্ত্রী হতবাক হয়ে যান। যেন কথাটা বিশ্বাসই হয় না…
আশরাফ সাহেব তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তোমার মত মা পেয়েছে বলেই আজ সিফাত মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। তুমি কত যত্ন করে ওদের মানুষ করেছ এবং এখনো করছো !!!
কথাগুলো শুনতে শুনতে সিফাতের মায়ের চোখের কোণায় কখন যে জল জমে গেছে তিনি টেরই পান নি ….
শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, এত খুশির খবর অথচ মিষ্টি আনেন নি !!!
আশরাফ সাহেব জিভে কামর দিয়ে বলেন, ঠিকই তো ! আসলে তোমায় খবরটা না জানানো পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিলাম না। যাচ্ছি, এখনই মিষ্টি নিয়ে আসছি…..
সিফাত এরই মধ্যে তার রেজাল্টের খবর জেনেছে। বাড়ি ফিরলেই তার মা তাকে অসীম মমতা নিয়ে জড়িয়ে ধরে, কপালের ঠিক মাঝখানটায় আলতো করে চুমু খায়। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে একনয়নে।
ওভাবে কি দেখছো মা ???
কিছু না। তোর চাঁদ মুখখানা দেখছি…
কথাটা শুনেই সিফাত লজ্জা পেয়ে যায়। চোখের চশমাটা একটু উপরে তুলে বলে, আমি একটু আমার রুমে যাচ্ছি মা…
খানিকক্ষণ পর তিতি লাফাতে লাফাতে সিফাতের রুমে এসেই বলে, ভাইয়া, তুমি এত বড় রেজাল্ট করলে কিভাবে ??? তোমার রেজাল্ট তো আমার মাথায়ই ঢুকছে না।
কাথাটা বলতে বলতে তিতি সিফাতের পাশে গিয়ে বসে। সিফাত মুচকি হেসে তিতির একটা হাত ধরে বলে, তোকে আর বুঝতে হবে না এখন, পরে বুঝলেই চলবে।
হঠাৎ উঠে দাড়িয়ে তিতি বলে, এই ড্রেসটা পরে আমায় কেমন লাগছে বলতো ???
খুব সুন্দর লাগছে। একেবারে পরীর মত…।
শুধু ওড়নার এই জায়গাটায় ইঁদুর কেটেছে। কি বিচ্ছিরি লাগছে দেখ তো ?
কথাটা শুনেই মন খারাপ হয়ে যায় সিফাতের। মাথা নিচু করে বলে, আমি সামনের মাসের মাইনে পেলে তোকে একটা জামা কিনে দেব।
সাথে সাথে তিতি বলে, ধুর বোকা ছেলে ! আমি জামা কিনে চেয়েছি নাকি ???
আচ্ছা ভাইয়া, আমরা বড়লোক হলে কেমন হতো ? কথাটা বলেই তিতি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে থাকে…।
সিফাত বলে, না- ভালো হত না। আমার এই জীবনটাই খুব পছন্দের।
তোর কলেজে-তো অনেক ধনী মানুষের মেয়েরা পড়ে। একদিন তাদের জিঞ্জেস করিস তো, তারা কি বলতে পারে বর্ষাকালে টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ কি রকম ? জ্যোৎস্না রাতে চাঁদ দেখার আনন্দ কতটুকু ? মায়ের হাতে শীতের সকালে খিঁচুড়ি আর ডিমভাজি খাওয়ার মজা কতটুকু ? ছেলেমেয়ের অল্প আনন্দেই মায়ের চোখে আনন্দের বন্যা বয়ে যাওয়ার অপূর্ব দৃশ্য কি দেখেছে ? কিংবা শীতকালে, ছোট ভাই-বোনদের নিজের একমাত্র কাঁথাটুকু দিয়ে দেওয়ার মত সেক্রিফাইস কাকে বলে ?
আড়মোরা ভেঙে তিতি বলে, অসম্ভব ! তারা তো এসবের কোনটাই জানে না। তাদের মুখে গল্প শুনে যতদূর জেনেছি, তারা নাকি বৃষ্টিতে ভেজার কিংবা জ্যোৎস্না রাতে চাঁদ দেখার সময়ই পায় না !!! বাসায় বুয়া এসে রান্না করে দিয়ে যায়। তাদের মা নাকি বছরে ২/১ দিন রান্নাঘরে যায় ! তাদের নাকি বড় ভাই-বোনদের সাথে সারাদিনে কখনও একবার কথাও হয় না !!!
অপূর্ব মমতা নিয়ে তিতি সিফাতের দিকে তাকায়।
আমি খুব ভাগ্যবতী ভাইয়া। তোমার মত একটি ভাইয়া পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের বিষয়।
তুমি কি জান ভাইয়া, তুমি একটা পাগল ???
সিফাত মুখে হাসি এনে বলে, কেন ???
তুমি এমন একজন মানুষ, যে কিনা তার বোনের পরীক্ষার সময় সারাটাক্ষণ হলের বাইরে ছাতা আর জুস নিয়ে দাড়িয়ে থাকে। টিউশনির মাইনে পেলে পুরোটাই এনে মায়ের হাতে তুলে দেয়। মাঝে মধ্যেই ছোট বোনকে নিয়ে ফুচকা কেতে যায়। পরীক্ষার সময় নিজে, গ্লাসে রাখা দুধটুকু না খেয়ে, বিভিন্ন বাহানা করে-গল্প বানিয়ে ছোট বোনকে খাওয়ায়। পরিবারের কারো মন খারাপ হলে তার মন ভাল করার জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকে। কারো কোন প্রয়োজন হলেই সাধ্যমত সাহায্য করে। নিজের তৈরি করা নোট সে কি না নিজের প্রতিদ্বন্দীকে পড়তে দেয় অবলীলায়….!!!
আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমার ভাইয়ের মত একটা ভাইও পৃথিবীতে পাওয়া যাবে না। আমি যদি দ্বিতীয় বার জন্মগ্রহণ করি তাহলেও আমি তোমাকেই আমার ভাই হিসেবে পেতে চাই। তোমার মাথার নিচের অনাবিল আশ্রয়ে ঠাঁই পেতে চাই।
সিফাতের চোখের কোণায় পানি চমতে শুরু করেছে।
মায়াভরা কন্ঠে তিতি বলে, বলতে পার কিভাবে তোমার মত একজন পরপোকারী, বিশ্বাসী আর শুদ্ধ মানুষ হওয়া যায় ??? বল না, ভাইয়া ???....
আশরাফ সাহেব বারান্দায় চেয়ারে বসে কি যেন ভাবছিলেন।
ঘড়িতে বাজে প্রায় রাত ন’টা। সিফাত কখন তার পাশে এসে বসেছে তিনি টেরই পান নি।
কি ভাবছো বাবা ???
মাথা ঘুড়িয়ে বলেন, ও সিফাত ! কিছু না রে …. এমনি…..
আজ জ্যোৎস্না উঠেছে। দেখ, চারদিক জ্যোৎস্নার রূপালী রং ধারণ করেছে। যেন আজ প্রকৃতির পূর্ণজন্মের দিন।
হ্যাঁ ঠিক ই বলেছিস।
আচ্ছা সিফাত, তোর কাছে জীবনের মানে কি ???
ভ্রু কুঁচকে সিফাত বলে, হঠাৎ এ প্রশ্ন বাবা ??? না, এমনি করলাম।
জ্যোস্নার রূপালী আলোয় আলোকিত আকাশের দিকে তাকিয়ে সিফাত বলে, আমার মতে ‘পাওয়া আর না পাওয়ার দোদুল্যমানই হচ্ছে জীবন’। তবে বাবা জীবনের আর একটা অর্থ আছে আর সেটা হল অপেক্ষা। এই অপেক্ষার পালাবদল হয় আমাদের ক্ষণে ক্ষণে…।
এবার বল, তোমার কাছে জীবনের সঙ্গা কি ???
আমি খুবই সাদাসিধে একজন মানুষ। তাই আমার সঙ্গাটাও সরল। আমার মতে, ‘জীবন মানে উপলব্ধি’। এক-একটি জিনিসের অভিঙ্গতা লাভ করা।
আর তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই উপভোগ করা উচিত।
আশরাফ সাহেব জিঞ্জেস করেন, তুই তোর জীবনকে কতটুকু উপভোগ করিস ???
বাবা, জীবনের কাছে আমার কোন অভিযোগ নেই। প্রতি সকালে মা অতি মমতা নিয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে আমায় নাস্তা খেতে দেন। আর সাথে একরাশ মমতা নিয়ে তাকিয়ে সন্তানের খাওয়া দেখেন। আমি এটা উপভোগ করি। ক্লাসের পর আমি টিউশনি করাতে যাই। টিউশনি থেকে ফেরার সময় দেখি, বন্ধুরা বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেয় অথচ আমি পারি না। আমি এটাও উপভোগ করি। অনেকেই রিক্সায় কিংবা বাসে চড়ে কলেজে যায়। আমি পিচঢালা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কলেজে যাই। আমি এটাও উপভোগ করি। ক্লাসের পর কিংবা ছুটির দিনে বন্ধুরা তাদের প্রিয়মানুষকে নিয়ে এখানে ওখানে বেড়াতে যায়। অথচ আমি বাড়ি ফিরে আমার পরিবারের সাথে সময় কাটাই। আমি এটাও উপভোগ করি। আমাদের রাজনীতিবিদদের অকথ্য গালাগালি শুনলে আমার হাসি পায় অপর দিকে গরীব দু:খী মানুষ দেখলেই আমার বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে তাদের কষ্টের কথা ভেবে। আমি এগুলোও উপভোগ করি।
আশরাফ সাহেব ম্লান কন্ঠে বলেন, আমি তোর জন্য কিছুই করতে পারলাম না রে !!!
সিফাত বলে, বাবা তুমি এমনিতেই এতকিছু করেছ যে, আমি সারাজীবন চেষ্টা করলেও এর প্রতিদান দিতে পারব না।
আমরা প্রতিদিন মাছ-গোশত খেতে না পারি, প্রতিমাসে কিংবা বছরে চাইনিজ খেতে না পারি, এয়ার কন্ডিশন রুমে ঘুমাতে না পারি, নতুন নতুন জামা-কাপড় চাইলেই পড়তে না পারি, আমরা অন্য আরেকটা জিনিস পারি যা অনেকেই পারে না। পাহাড় সমান সম্পদ থাকা সত্ত্বেও অনেকে পারে না।
আর সেটা হল, অনেক অল্প জিনিসের মাঝেই আনন্দ খুঁজে নেওয়া আর জীবনকে উপভোগ করা। …..
সিফাতের ৪র্থ বর্ষের রেজাল্ট বেরিয়েছে। সবমিলিয়ে সে এবারও প্রথম হয়েছে। বাসার সবাই মহাখুশি।
সেই খুশিতে আজ আশরাফ সাহেব সবাইকে ফুচকা খাওয়াবে।
ছোটবোন তিতি কাপড় পরে রেডি হয়ে গিয়েছে। তার মায়ের রুমে গেলেই তিতি লক্ষ্য করে, আজ তার মা ঠোঁটে হালকা লিপষ্টিক দিয়েছে, কপালের ঠিক মাঝখানে একটা বড় টিপ দিয়েছে।
দীর্য ২১ বছরের সংসার জীবনে তিতির মা হাতে গোণা মাত্র ২/৩ বার সেজেছে।
তিতি মুচকি হেসে বলে, মা তোমায় বেশ সুন্দরী লাগছে।
সাথে সাথে লজ্জা পেয়ে যায় তার মা। নিজেকে আড়াল করার জন্য কি যেন খুঁজতে শুরু করে।
তিতি বলে, যাই বাবাকে গিয়ে বলি আমরা সবাই রেডি……
ফজরের আযান হয়েছে। নামায আদায় করে আশরাফ সাহেব সিফাতের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। তিনি সিফাতের মাথার কাছে গিয়ে বসে আলতো করে তার চুলে হাত বুলাতে থাকে।
ধীর কন্ঠে ডাকে, সিফাত, বাবা সিফাত। ঘুম থেকে ওঠ। ফজরের নামায পড়বি না ???
ঘুম থেকে ওঠে বিছানায় বসে সিফাত বলে, ভালোই করেছ আমায় ডেকে। নইলে নামাযটা মিস হয়ে যেত।
আশরাফ সাহেব বলেন, একজন মানুষ তার জীবনে সবকিছু পায় না কখনই। আর যদি পেত তাহলে জীবনের স্বার্থকতা বলে কিছু থাকত না। তবে প্রতিটি মানুষই কিছু কিছু মূল্যবান জিনিস পায়। আমিও পেয়েছি।
জানিস সেটা কি ???? না, জানি না বাবা।
আমার সেই মূল্যবান জিনিসটা হল, তুই – আমার সন্তান।
এক জীবনে যে কতগুলো পূণ্য করলেই তোর মত সন্তান পাওয়া যায় তা আল্লাহই জানেন। কিন্তু আমি তোর বাবা হতে পেরে ধন্য।
সিফাত কিছু বলে না, কেবল মাথা নিচু করে থাকে।
দু’জনের চোখ চিকচিক করছে। খানিকক্ষণ পরেই বর্ষার জলধারার মত জ্বল গড়িয়ে পড়বে।
বাইরে রাতজাগা পাখিগুলো কিচিরমিচির করছে।
আস্তে আস্তে সকাল হচ্ছে।
একবুক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে উদিত হচ্ছে নতুন দিনের সূর্য……….

Sunday, June 26, 2011

নীল তেপান্তরে

উৎসর্গ…

জনপ্রিয় লেখিকা, সুচিত্রা ভট্টাচার্য

“কাছের মানুষ” উপন্যাসে আপনি মানুষের জীবনের একাকীত্বের সার্থক চিত্র যেভাবে তুলে ধরেছেন, সেভাবে অন্য কেউ এত চমৎকার করে উপস্থাপন করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না।

আপনি জানেন না, এই উপন্যাসটা আমার সবচেয়ে প্রিয়। কারন, এই উপন্যাসের মাঝে আমি আমার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাই।



ভূমিকা…

আমার এক বন্ধুর জীবন থেকে নেওয়া এই গল্পটি। দেশের বাইরে পড়তে আসা একটি ছেলে যেসব অবহেলার অভিঙ্গতা লাভ করে তার মাঝে দু-একটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। প্রিয় বন্ধু, একটা গানের কয়েকটি লাইন কেবল বলতে চাই তোকে,

“যদি সবাই ফিরে যায়, ওরে ও অভাগা সবাই ফিরে যায়। ফিরবে না যে জানবি সে তোর, ফিরবে না যে জানবি সে তোর -ভাবনার মোরকে আছে ডুবে।ছিঁড়বে মোরক ফিরবে সে তার আপনও কুলায়……”।





নিজের রুমের চেয়ারে বসে লিমন বিড়বিড় করে বলছে,

Sharing is caring…….

তবে কেন আমার কাছের মানুষগুলো এত উদাসীন ???

গত দুইদিন ধরে লিমনের সাথে তার মা-বাবার কথা হয় না। যখন তার মা-বাবার তাঁর কথা খুব মনে পড়ে, তখন লিমনকে একদিন পর পর ফোন দেয়।

আর এভাবে কিছু দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আবার সেই আগের অবস্থা। ২-৩দিন এ একবার খবর নেওয়া।

প্রতিদিন সন্ধ্যের পর থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত লিমন আনমনে ভাবে, এই বুঝি তার মা-বাবা ফোন দিল। তার কোন কাছের মানুষ তার খবর নিল।

মাঝে মাঝে সে প্রশ্ন করে, আচ্ছা-আমাকে কেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠাল ???

মেনে নিলাম আমার সুন্দর একটি ভবিষ্যতের জন্য। তাই বলে কি, আমি কেমন আছি, কি করছি এসব খবর নেওয়ার ইচ্ছেও করে না আমার কাছের মানুষগুলোর ???

লিমন আসলে এসব প্রশ্ন গুলো নিজেকেই করছিলো।

রাতের খাবার ক্যান্টিনে সেরে লিমন নিজের রুমের দিকে ফিরছিল। হঠাৎ তার মোবাইলে ফোন আসে।

মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে, রানা ফোন করেছে।

হ্যালো, লিমন ? কি করছো ?

কিছু না। খেয়ে ফিরছি।

সময় থাকলে চল না ভিসি’র বাড়ির সামনে বসার জায়গাটায় গিয়ে একটু বসি। গল্প করি।

ঠিক আছে। আমি আসছি….

লিমন রানার কাছে গিয়েই প্রশ্ন করে, মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচেয়ে বড় কষ্ট কি বলতে পার ???

রানা বেশ হকচকিয়ে যায়।চোখের চশমাটা একটু ওপরে তুলে হাসিমুখ করে বলে, বুঝলাম না।

লিমন রানার পাশে বসতে বসতে বলে, তোমাকে আর বুঝতে হবে না।

তুমি কি জান, সুমি তোমায় ছেড়ে চলে গেল কেন ???



রানা বলে, জানি। আমার মত খারাপ মানুষকে সে কেন ভালবাসবে ? কেন আমার সাথে থাকবে ???

না, তুমি ভুল বলেছ। আমরা অতি চমৎকার করে ভালবাসতে পারি যা অনেকেই পারে না। আর মানুষ সেটা বুঝে না। তাই ভুল বুঝে, অভিমান করে চলে যায় দূরে…



রানা কিছু বলে না, কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।



বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর লিমন গান ধরে,

দেখেছি, দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।

তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলে আর মেলে না

দেখেছি, দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।

গান শেষ হলে ক্ষীণ কন্ঠে রানা জিঞ্জেস করে, তোমার কি মন খারাপ ?



লিমন কিছু বলে না। চুপচাপ নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাদের সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তার দিকে। যাকে আলোকিত করে রেখেছে ছোট ছোট সোডিয়াম বাতি।

হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে লিমন পায়েচারি করতে শুরু করে।



সাবলীল কন্ঠে বলে, মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচেয়ে বড় কষ্ট হল, যা বলতে প্রাণ কাঁদে তা কখনও বলা হয় না। আর মানুষ কেবলই সেই কথাটা বলার কাঙ্খিত সময়ের অপেক্ষায় থাকে…



জান রানা, আমার পরিবারের সবাই আমার উপর বেশ বিরক্ত। সেদিন বড় আপুর সাথে কথা হল। কি বলল শুনবা ?

রানা বলে, নিশ্চই তোমায় তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বলেছে।



না, সেটা বলে নি। বলেছে, ‘তোকে তো কেউ কিছু বলে না, যা বলে সব আমাকে। তোর জন্য সবাইকে ম্যানেজ করতে হয়। তোকে যেন কেউ কিছু না বলে তাই আমি

সামনে গিয়ে দাঁড়াই। যে করেই হোক সিজিপিএ টা একটু ভালো কর। আর কথা শুনতে ভাল লাগে না’।



বড় মামাও আমার সিজিপিএ নিয়ে আমার উপর বিরক্ত। আমি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি এটা তার পছন্দ নয়।

আমার বড় চাচা সেদিন আমায় ফোন করে বলেছে, তোর পেছনে অযথা টাকা নষ্ট হচ্ছে। পড়তে না পারলে চলে আয়।

বড় ভাইয়া আর ভাবীর সাথে আমার শেষ কবে কথা হয়েছে আমি নিজেও বলতে পারবে না।



মা’র হাতে টাকা থাকে না বলে, মা’ও নিয়মিত খবর নিতে পারে না। তবে তারাও যে আমার উপর বিরক্ত তা বোঝা যায়।

হাতে গোণা ২-৪ জন যেই বন্ধু আছে, তাদেরকে আমারই ফোন দিয়ে আমার অস্তিত্বের কথা মনে করিয়ে দিতে হয়। অথচ এই সব মানুষগুলোকে আমি প্রতিদিন কত মমতা নিয়ে ভাবি !!!!!



একটা মেয়েকে ভালবেসেছিলাম। হঠাৎ তারও বিয়ে হয়ে গেল। আমায় একা করে চলে গেল, কিন্তু যাওয়ার আগে একবার বলেও গেল না।

রানা কিছু বলে না। কেবলই গম্ভীর হয়ে মাটির নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।



অনেকক্ষণ পরে বলে, তুমি এভাবে ভাবছ কেন ? সবাই তোমায় নিয়ে ভাবে, তোমায় ভালবাসে, শুধু যোগাযোগ করতে পারে না। হয়ত ব্যস্ত থাকে বিভিন্ন কারনে।

লিমন বলে, মিথ্যে আশ্বাস দিও না। ভালবাসা এবং কৃতঙ্গতাবোধ- এগুলো প্রকাশ করতে হয়।



আমার খালারা আমায় নিয়ে কানাঘষা করে, আমি নাকি একটি মেয়ের সাথে নিয়মিত কথা বলি আর টাকা উড়াই। বিদেশে এসেও নাকি আমার ফোনে কথা বলার ভুতটা যায় নি। আর সে জন্যই নাকি আমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছি।

অথচ কি জান, আমার মোবাইলে তেমন একটা ফোন আসে না। আমি ভার্সিটির বাইরে হাতেগোণা মাত্র কয়েকজনের সাথে কথা বলি।

আসলে আমি এমন একজন মানুষ, যার প্রতিটি কাজই হল ভুল। সে যাই করে, যাই বলে সবই অন্যের চোখে ভুল। যাকে বলে, ভুলে ভরা মানুষ…..

হঠাৎ রানা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, চল-এবার হলের দিকে পা বাড়াই। পরিবেশটা কেমন যেন অসহ্য মনে হচ্ছে।



প্রতিদিন রাতে বিছানায় গিয়ে লিমন ভাবে, ভুলে ভর্তি আমার জীবন। আচ্ছা কি করলে সবার চোখে আমার এই ভুল গুলো শুধরানো যায় ? কি করলে, আমি আমার কাছের মানুষগুলোর কাছে প্রিয় হতে পারব ?

অনেক ভাবে। ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে যায়।



গত ৭ দিন আগে লিমনের ছোট খালার বিয়ে হল। খুবই মজা হয়েছে সেখানে। সবাই এসেছিল, কেবল লিমনই যেতে পারে নি। কেউ লিমনকে জানায় নি, ওদিকে কি হচ্ছে। গায়ে হলুদ হয়েছে এটাও লিমন জানে না। বিয়ের অনুষ্টান শেষেও কেউ একটা ফোন করে লিমনকে কিছু জানায় নি। এমনকি লিমনের মা-বাবাও না। আর

লিমনের ভাই ? সে তো অনেক ব্যস্ত। কত দায়িত্ব তার মাথায় !!!



আমাদের এই পৃথিবীতে এক শ্রেণীর মানুষ আছে, যারা তার পরিবার, কাছের মানুষদের নিয়ে খুব বেশি কনসার্ন থাকে। লিমন সে ধরনের মানুষ।

অন্ধকারের একটা সুবিধা হল, এর মাঝে ক্ষীণ আলোর উপস্তিতিও সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়, যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। লিমন তেমনি আলো খোঁজার চেষ্টা করছে…



বিস্মৃতির অতল গভীরে ক্রমেই হারিয়ে যাওয়া লিমন ভাবে, সব ছেড়ে দিব, সব। আমার সব কাছের মানুষগুলোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবো। একলা চলার নীতি অনুসরণ করবো।



নিজের রুমে চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে লিমন এসব কথা ভাবছে।

হঠাৎ তার মন বলে ওঠে,

তুমি এমনটা করো না। তুমিও যদি অভিমানের বশবতী হয়ে অন্যান্য মানুষের মত আচরণ কর তবে

অতি সস্তা চিন্তার মানুষ আর তোমার মাঝে কি পার্থক্য থাকবে বল ??? তোমায় যে হতে হবে,

বসুন্ধরার মত সর্বংসহা; নদীর মত বেগবান, আকাশের মত উদার, বৃক্ষের মত পরপোকারী।



আড়মোরা ভেঙে লিমন পেছনে তাকায়।

দেখে, পেছনে কেউ নেই। কেবল ঘরের জানালা দিয়ে স্নিগ্ধ মৃদু বাতাস ঘরে প্রবেশ করছে।

সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। শীতল স্নিগ্ধ বাতাস তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।



অনাবিল প্রশান্তিতে লিমনের শরীর ভরে উঠছে।

হালকা ভাবে চোখ বন্ধ করে লিমন, সাবলীল কন্ঠে বলে,

আমি এক অনন্য মানুষ। আমার স্বকীয়তা আমায় বজায় রাখতেই হবে। কারন, স্বকীয়তা বিসর্জন দেওয়ার অর্থ হল নিজেকে হারিয়ে ফেলা। সকল সমালোচনা গ্রহণ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করবো আমি আর এগিয়ে যাব।

হ্যাঁ, আমি এগিয়ে যাব দীপ্ত পায়ে………