উৎসর্গ…
জনপ্রিয় লেখিকা, সুচিত্রা ভট্টাচার্য
“কাছের মানুষ” উপন্যাসে আপনি মানুষের জীবনের একাকীত্বের সার্থক চিত্র যেভাবে তুলে ধরেছেন, সেভাবে অন্য কেউ এত চমৎকার করে উপস্থাপন করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না।
আপনি জানেন না, এই উপন্যাসটা আমার সবচেয়ে প্রিয়। কারন, এই উপন্যাসের মাঝে আমি আমার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাই।
ভূমিকা…
আমার এক বন্ধুর জীবন থেকে নেওয়া এই গল্পটি। দেশের বাইরে পড়তে আসা একটি ছেলে যেসব অবহেলার অভিঙ্গতা লাভ করে তার মাঝে দু-একটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। প্রিয় বন্ধু, একটা গানের কয়েকটি লাইন কেবল বলতে চাই তোকে,
“যদি সবাই ফিরে যায়, ওরে ও অভাগা সবাই ফিরে যায়। ফিরবে না যে জানবি সে তোর, ফিরবে না যে জানবি সে তোর -ভাবনার মোরকে আছে ডুবে।ছিঁড়বে মোরক ফিরবে সে তার আপনও কুলায়……”।
নিজের রুমের চেয়ারে বসে লিমন বিড়বিড় করে বলছে,
Sharing is caring…….
তবে কেন আমার কাছের মানুষগুলো এত উদাসীন ???
গত দুইদিন ধরে লিমনের সাথে তার মা-বাবার কথা হয় না। যখন তার মা-বাবার তাঁর কথা খুব মনে পড়ে, তখন লিমনকে একদিন পর পর ফোন দেয়।
আর এভাবে কিছু দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আবার সেই আগের অবস্থা। ২-৩দিন এ একবার খবর নেওয়া।
প্রতিদিন সন্ধ্যের পর থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত লিমন আনমনে ভাবে, এই বুঝি তার মা-বাবা ফোন দিল। তার কোন কাছের মানুষ তার খবর নিল।
মাঝে মাঝে সে প্রশ্ন করে, আচ্ছা-আমাকে কেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠাল ???
মেনে নিলাম আমার সুন্দর একটি ভবিষ্যতের জন্য। তাই বলে কি, আমি কেমন আছি, কি করছি এসব খবর নেওয়ার ইচ্ছেও করে না আমার কাছের মানুষগুলোর ???
লিমন আসলে এসব প্রশ্ন গুলো নিজেকেই করছিলো।
রাতের খাবার ক্যান্টিনে সেরে লিমন নিজের রুমের দিকে ফিরছিল। হঠাৎ তার মোবাইলে ফোন আসে।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে, রানা ফোন করেছে।
হ্যালো, লিমন ? কি করছো ?
কিছু না। খেয়ে ফিরছি।
সময় থাকলে চল না ভিসি’র বাড়ির সামনে বসার জায়গাটায় গিয়ে একটু বসি। গল্প করি।
ঠিক আছে। আমি আসছি….
লিমন রানার কাছে গিয়েই প্রশ্ন করে, মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচেয়ে বড় কষ্ট কি বলতে পার ???
রানা বেশ হকচকিয়ে যায়।চোখের চশমাটা একটু ওপরে তুলে হাসিমুখ করে বলে, বুঝলাম না।
লিমন রানার পাশে বসতে বসতে বলে, তোমাকে আর বুঝতে হবে না।
তুমি কি জান, সুমি তোমায় ছেড়ে চলে গেল কেন ???
রানা বলে, জানি। আমার মত খারাপ মানুষকে সে কেন ভালবাসবে ? কেন আমার সাথে থাকবে ???
না, তুমি ভুল বলেছ। আমরা অতি চমৎকার করে ভালবাসতে পারি যা অনেকেই পারে না। আর মানুষ সেটা বুঝে না। তাই ভুল বুঝে, অভিমান করে চলে যায় দূরে…
রানা কিছু বলে না, কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর লিমন গান ধরে,
দেখেছি, দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।
তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলে আর মেলে না
দেখেছি, দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।
গান শেষ হলে ক্ষীণ কন্ঠে রানা জিঞ্জেস করে, তোমার কি মন খারাপ ?
লিমন কিছু বলে না। চুপচাপ নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাদের সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তার দিকে। যাকে আলোকিত করে রেখেছে ছোট ছোট সোডিয়াম বাতি।
হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে লিমন পায়েচারি করতে শুরু করে।
সাবলীল কন্ঠে বলে, মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচেয়ে বড় কষ্ট হল, যা বলতে প্রাণ কাঁদে তা কখনও বলা হয় না। আর মানুষ কেবলই সেই কথাটা বলার কাঙ্খিত সময়ের অপেক্ষায় থাকে…
জান রানা, আমার পরিবারের সবাই আমার উপর বেশ বিরক্ত। সেদিন বড় আপুর সাথে কথা হল। কি বলল শুনবা ?
রানা বলে, নিশ্চই তোমায় তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বলেছে।
না, সেটা বলে নি। বলেছে, ‘তোকে তো কেউ কিছু বলে না, যা বলে সব আমাকে। তোর জন্য সবাইকে ম্যানেজ করতে হয়। তোকে যেন কেউ কিছু না বলে তাই আমি
সামনে গিয়ে দাঁড়াই। যে করেই হোক সিজিপিএ টা একটু ভালো কর। আর কথা শুনতে ভাল লাগে না’।
বড় মামাও আমার সিজিপিএ নিয়ে আমার উপর বিরক্ত। আমি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি এটা তার পছন্দ নয়।
আমার বড় চাচা সেদিন আমায় ফোন করে বলেছে, তোর পেছনে অযথা টাকা নষ্ট হচ্ছে। পড়তে না পারলে চলে আয়।
বড় ভাইয়া আর ভাবীর সাথে আমার শেষ কবে কথা হয়েছে আমি নিজেও বলতে পারবে না।
মা’র হাতে টাকা থাকে না বলে, মা’ও নিয়মিত খবর নিতে পারে না। তবে তারাও যে আমার উপর বিরক্ত তা বোঝা যায়।
হাতে গোণা ২-৪ জন যেই বন্ধু আছে, তাদেরকে আমারই ফোন দিয়ে আমার অস্তিত্বের কথা মনে করিয়ে দিতে হয়। অথচ এই সব মানুষগুলোকে আমি প্রতিদিন কত মমতা নিয়ে ভাবি !!!!!
একটা মেয়েকে ভালবেসেছিলাম। হঠাৎ তারও বিয়ে হয়ে গেল। আমায় একা করে চলে গেল, কিন্তু যাওয়ার আগে একবার বলেও গেল না।
রানা কিছু বলে না। কেবলই গম্ভীর হয়ে মাটির নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
অনেকক্ষণ পরে বলে, তুমি এভাবে ভাবছ কেন ? সবাই তোমায় নিয়ে ভাবে, তোমায় ভালবাসে, শুধু যোগাযোগ করতে পারে না। হয়ত ব্যস্ত থাকে বিভিন্ন কারনে।
লিমন বলে, মিথ্যে আশ্বাস দিও না। ভালবাসা এবং কৃতঙ্গতাবোধ- এগুলো প্রকাশ করতে হয়।
আমার খালারা আমায় নিয়ে কানাঘষা করে, আমি নাকি একটি মেয়ের সাথে নিয়মিত কথা বলি আর টাকা উড়াই। বিদেশে এসেও নাকি আমার ফোনে কথা বলার ভুতটা যায় নি। আর সে জন্যই নাকি আমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছি।
অথচ কি জান, আমার মোবাইলে তেমন একটা ফোন আসে না। আমি ভার্সিটির বাইরে হাতেগোণা মাত্র কয়েকজনের সাথে কথা বলি।
আসলে আমি এমন একজন মানুষ, যার প্রতিটি কাজই হল ভুল। সে যাই করে, যাই বলে সবই অন্যের চোখে ভুল। যাকে বলে, ভুলে ভরা মানুষ…..
হঠাৎ রানা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, চল-এবার হলের দিকে পা বাড়াই। পরিবেশটা কেমন যেন অসহ্য মনে হচ্ছে।
প্রতিদিন রাতে বিছানায় গিয়ে লিমন ভাবে, ভুলে ভর্তি আমার জীবন। আচ্ছা কি করলে সবার চোখে আমার এই ভুল গুলো শুধরানো যায় ? কি করলে, আমি আমার কাছের মানুষগুলোর কাছে প্রিয় হতে পারব ?
অনেক ভাবে। ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে যায়।
গত ৭ দিন আগে লিমনের ছোট খালার বিয়ে হল। খুবই মজা হয়েছে সেখানে। সবাই এসেছিল, কেবল লিমনই যেতে পারে নি। কেউ লিমনকে জানায় নি, ওদিকে কি হচ্ছে। গায়ে হলুদ হয়েছে এটাও লিমন জানে না। বিয়ের অনুষ্টান শেষেও কেউ একটা ফোন করে লিমনকে কিছু জানায় নি। এমনকি লিমনের মা-বাবাও না। আর
লিমনের ভাই ? সে তো অনেক ব্যস্ত। কত দায়িত্ব তার মাথায় !!!
আমাদের এই পৃথিবীতে এক শ্রেণীর মানুষ আছে, যারা তার পরিবার, কাছের মানুষদের নিয়ে খুব বেশি কনসার্ন থাকে। লিমন সে ধরনের মানুষ।
অন্ধকারের একটা সুবিধা হল, এর মাঝে ক্ষীণ আলোর উপস্তিতিও সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়, যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। লিমন তেমনি আলো খোঁজার চেষ্টা করছে…
বিস্মৃতির অতল গভীরে ক্রমেই হারিয়ে যাওয়া লিমন ভাবে, সব ছেড়ে দিব, সব। আমার সব কাছের মানুষগুলোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবো। একলা চলার নীতি অনুসরণ করবো।
নিজের রুমে চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে লিমন এসব কথা ভাবছে।
হঠাৎ তার মন বলে ওঠে,
তুমি এমনটা করো না। তুমিও যদি অভিমানের বশবতী হয়ে অন্যান্য মানুষের মত আচরণ কর তবে
অতি সস্তা চিন্তার মানুষ আর তোমার মাঝে কি পার্থক্য থাকবে বল ??? তোমায় যে হতে হবে,
বসুন্ধরার মত সর্বংসহা; নদীর মত বেগবান, আকাশের মত উদার, বৃক্ষের মত পরপোকারী।
আড়মোরা ভেঙে লিমন পেছনে তাকায়।
দেখে, পেছনে কেউ নেই। কেবল ঘরের জানালা দিয়ে স্নিগ্ধ মৃদু বাতাস ঘরে প্রবেশ করছে।
সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। শীতল স্নিগ্ধ বাতাস তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
অনাবিল প্রশান্তিতে লিমনের শরীর ভরে উঠছে।
হালকা ভাবে চোখ বন্ধ করে লিমন, সাবলীল কন্ঠে বলে,
আমি এক অনন্য মানুষ। আমার স্বকীয়তা আমায় বজায় রাখতেই হবে। কারন, স্বকীয়তা বিসর্জন দেওয়ার অর্থ হল নিজেকে হারিয়ে ফেলা। সকল সমালোচনা গ্রহণ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করবো আমি আর এগিয়ে যাব।
হ্যাঁ, আমি এগিয়ে যাব দীপ্ত পায়ে………