উৎসর্গ........
পৃথিবীতে যদি সেরা বড়-ভাইদের তালিকা করা হয় তাহলে আমার বিশ্বাস,
তোমার নামটা প্রথম তিনজনের মধ্যে থাকবে। আমার কত ভুল তুমি স্রেফ
কিছু না বলেই ক্ষমা করে দিয়েছ !!!!! আজও আমি শুদ্ধতার প্রতীক্ষায় !!!!
প্রিয় আরিফ ভাইয়া, সাথে প্রিয় খুশী ভাবী।
ভূমিকা ...
নটরডেম কলেজে পড়ার সময় প্রায়ই ঢাকা ভার্সিটির মধুর ক্যান্টিনে বড় ভাইদের সাথে আড্ডা দিতাম। একদিন হঠাৎ এক বড় আপুর সাথে দেখা হয়, কথা হয়। পরে এক বড় ভাইয়ের মুখে শুনি উনার কাষ্টলি অতীতের কথা। বেশ কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। আপুর ঠিকানা জানি না। জানলে, এই লিখাটা পাঠিয়ে দিতাম। আর লিখতাম-আপনার গল্প নিয়ে কিছু একটা লিখার চেষ্টা করেছি। বলুনতো লিখাটা কেমন হয়েছে ?????
১।
ধাক্কা লাগার পরও কয়েক পা এগিয়ে গেল অন্তী। কিন্তু হঠাৎ কি মনে করে ঘুরে দাঁড়াল। পিছন ফিরেই তাকিয়ে দেখে, একজন বৃদ্ধ মানুষ মাটি থেকে কাগজপত্র তুলছে।
অন্তী কিছু বুঝতে পারে না এই মুহুর্তে তার কি করা করা উচিত।
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সে। কিছুটা দ্বিধা বিভক্তি নিয়ে সে এগিয়ে যায়।
আঙ্কেল, আপনি কি ব্যথা পেয়েছেন ???
মাটি থেকে কাগজগুলো তুলে সোজা হয়ে মানুষটি বলে; না, ব্যথা পাই নি।
বাবার বয়সী একটি মানুষকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য অপরাধবোধে ভুগতে থাকে।
আঙ্কেল আমি নিচে দেখে হাঁটছিলাম তো, তাই দেখতে পাই নি।
স্যরি, আমায় মাফ করবেন।
নাকের উপরের চশমাটা একটু উপরে তুলে বলেন, এতে ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই মা। তুমিতো আর ইচ্ছে করে ধাক্কা দাও নি।
একটা প্রশ্ন করি, কিছু মনে করবে না তো ?
না, মনে করবো না আঙ্কেল।
এখনতো সন্ধ্যা হতে চলেছে প্রায়, তবুও তুমি সানগ্লাস পড়ে আছো কেন ???
কিছুক্ষণ ভাবলেশহীণ ভাবে অন্তী দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নিচু করে।
আড়মোরা ভেঙে বলে, ওটা আমার অতীত আঙ্কেল, আমার কাষ্টলী অতীত। আমার অর্ধেক পৃথিবী.......
আপনি এই বিশাল বসুন্ধরার সৌন্দর্য যতটুকু দেখেন, আমি তার অর্ধেক দেখি, উড়ে যাওয়া পাখির দৃশ্য এমনকি আনমনে লেজ নাচানো পাখির মন কেমন করা দৃশ্যও আমি উপভোগ করতে পারি না, আমার মমতাময়ী মায়ের মুখটাও ভালোমত দেখতে পারি না। বাবা যখন আমার হাত ধরে বারান্দায় গিয়ে আমাকে আকাশের তারা দেখিয়ে বলে, এই তারাটির নাম জানিস ??? আমি বলি, জানি না। বাবা গভীর মমতা নিয়ে তারা গুলো দেখিয়ে আমায় তাদের নাম বলে। আকাশের সব তারাগুলো আমার চোখে ধরা পড়ে না; অর্ধেক ধরা দেয়......।
কিছুটা ছটফট করতে থাকে বৃদ্ধ মানুষটি। বলে, মা তোমার কি কোন সমস্যা আছে ????
অন্তী বৃদ্ধ মানুষটির কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে বলে, আঙ্কেল আমার যে সমস্যা তা তো শুধু সমস্যা না,
মরে যাওয়ার মত সমস্যা..........।
২।
সাধারণত অন্তীর রুমে ঢোকার আগে দরজায় নক করে বলে, আপু আমি রাহাত, আসব ???
ওর অভ্যাস-ই এটা। অন্তীর রুমে সে এভাবেই ঢুকে।
মাঝে মাঝে শুধু রুমে ঢুকার আগে দরজায় নক করে। কে বলে চিৎকার করলেও উত্তর দেয় না। অন্তী কিছুটা বিরক্ত হয়ে ভিতরে আসার জন্য বলে।
আর এভাবে রাহাত আসলে অন্তী বুঝতে পারে, আজ সে গোপন কিছু বলবে অথবা তার মন খারাপ...।
যেদিন সে গোপনকিছু বলতে চায় সেদিন সে আমার সাথে প্রথমে কিছু অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে কথা বলে।কথার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট প্রশ্ন করে, যা জানতে চেয়েছে তা জেনে নেবে কৌশলে।
আমি রাহাতের হাত ধরে বলি, কিছু বলবি ভাইয়া ???
রাহাত বলে, না তেমন কিছু না। এমনি গল্প করতে এসেছি।
আপু তুমি কি জান তোমার জন্য একটা সুখবর আছে ???
ম্লান হাসে অন্তী ! রাহাত বলে, ওরকম উৎফুল্লহীণ ভাবে হাসছো কেন ?
অন্তী বলে, এমনি।
সুখবরটা শুনবে না ?? না, শুনতে ইচ্ছে করছে না।
রাহাত অন্তীর হাত-টা ধরে বলে, আহা ! শোনই না প্লিজ। তোমার ভালো লাগবে ।
আবারও ম্লান হাসি হাসে অন্তী।
গভীর চোখে বলে, আমার জন্য কোন সুখবর থাকতে পারে সেটা কবেই ভুলে গেছি। আমি জানি, আমার জন্য কোন সুখবর কখনোই থাকতে পারে না; আগামীতেও আসবে না কখনো।
কথাটা শুনেই রাহাতের মন খারাপ হয়ে যায়।
অন্তী আলতো করে রাহাতের গালে হাত রেখে বলে, তোর মন খারাপ করে দিলাম তাই না ?
বাদ-দে এসব কথা। আচ্ছা বলতো, মানুষ শ্রেষ্ঠ না বৃক্ষ ???
৩।
ঘুম ভেঙে গেল মা’র চিৎকারে।
গতরাতে কেন যেন ঘুম আসছিল না। ছন্নছাড়া চিন্তা আসছিল একটার পর একটা। মাঝরাতে বিছানায় বসেছিলাম। ভেবেছিলাম, কে আমি ? কেন এমন হলো আমার ? কি দোষ ছিল আমার ???
আমার রুমের দরজা খোলা। কাজ নেই তাই রবীন্দ্রসংগীত শুনছি।
আপু তোমায় মা ডাকছে। কথাটা বলতে বলতে রুমে ঢোকে রাহাত।
আমি বিছানা থেকে নামতেই স্যান্ডেলগুলো এগিয়ে দেয়।
রাহাতের এসব কিছু কাজ আমার বেশ ভালো লাগে। আমার কোন কিছু প্রয়োজন হলে সাথে সাথেই সে এনে দেয়। আমার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে নিজেই রিক্সা ডেকে দেয় এমনকি সময় থাকলে সাথেও যায়।
বাইরে থেকে ফিরেই বা স্কুল থেকে ফিরেই প্রথমে আমার খবর নেয়। মাঝে মাঝে নিজেই আমায় আবৃত্তি করে শুনায়..................।
আমি গম্ভীর হয়ে বলি, আমার প্রতি তোর এত ভালবাসা কেন ???
রাহাত বলে, ওভাবে বলছো কেন গম্ভীর হয়ে ???? বোনের প্রতি ভাইয়ের ভালবাসা থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক।
মাথা নিচু করে বলি, মানুষের একটা স্বভাব কি জানিস ?
মানুষ তার ব্যর্থতার কথা গুলো বেশ গম্ভীর করেই বলে।
কোন এক গল্পের বইতে পড়েছিলাম, ভালবাসলে নাকি ছোট্ট করে হলেও তার প্রতিদান দিতে হয়।
কিন্তু আমার না আছে সামর্থ্য, না আছে যোগ্যতা। আমার কাছে এমন কিছুই নেই যে আমি নিজেকে কারো উপযুক্ত ভাবতে পারি।
রাহাত কিছু বলে না। গ্রিল ধরে বাইরের দিকে কেবলই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
আশেপাশের পরিবেশটা বেশ শান্ত, খানিকটা অসহনীয়ও.......
কিছুক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকে রাহাত চলে যায়। আমি জানি, ওর এখন মন খারাপ। এখন সে তার রুমের দরজা লাগিয়ে রুমের মধ্যেই পায়েচারি করবে, আর ভাববে কি করে সে আমার কষ্টগুলো দূর করে দিবে ????
অনেক ভাববে কিন্তু কোন কুল-কিনারা পাবে না। না পেয়ে অবশেষে স্রস্টার কাছে আত্মসমর্পণ করে নীরবে চোখের জ্বল ফেলবে – আমি জানি।
৪।
হ্যালো অন্তী, কই তুই ????
আমি কলা ভবনের সামনে। তোরা কই ?
রনি বলে, কিছু ছোট ভাই এসেছে, তাদের সাথে মধুর ক্যান্টিনে আড্ডা দিচ্ছি। চলে আয়।
অন্তী বলে, আসছি তবে একটু দেরি হবে।
রনি ভাই, অন্তী আপুটা কে ?? আগে আসুক তবেই জানতে পারবি।
ওই যে, ধীর পায়ে হেঁটে আসছে অন্তী।
অন্তী আসতেই রনি দরজার সামনে গিয়ে অন্তীর হাত ধরে তাকে ক্যান্টিনে নিয়ে আসে।
রনি বলে, বোস এখানে। ওরা হলো আমার ছোট ভাই। তোরা পরিচয় দে তোদের.......।
আমি আসিফ; নটরডেম কলেজ, বিঞ্জান, ১ম বর্ষ।
আমি সৌম্য; নটরডেম কলেজ, ১ম বর্ষ মানবিক।
আমি কাজল; নটরডেম কলেজ, ১ম বর্ষ মানবিক।
অন্তী বলে, এবার আমার পরিচয়টা দিই। আমি অন্তী। আই.ই.আর, ঢকা বিশ্ববিদ্যালয়, অনার্স (৪র্থ বর্ষ)।
মাঝে মাঝে চলে এসো ভাইয়ারা, সবাই মিলে গল্প করা যাবে।
রনি, আজ আমি যাই। রাহাতের শরীরটা ভালো নেই। মাথা ব্যথাটা বেড়েছে।
একা যেতে পারবি ??? কল্পনা আছে, ও বলেছে আমার সাথে যাবে।
যাওয়া শুরু করতেই অন্তী, সৌম্য-কাজল’দের দিকে ফিরে তাকাল। সাবলীল ভাবে বলল, আমি জানি তোমাদের মনে এখন একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটার উত্তর রনি দিয়ে দিবে।
কথাটা শেষ করেই অন্তী হাঁটতে শুরু করে।
কাজল আড়মোরা ভেঙে প্রশ্ন করে, প্রায় সন্ধ্যা হতে চলেছে। তারপরও অন্তী আপু সানগ্লাস পরে ছিল কেন ???
মধুর ক্যান্টিনে চলছে বিভিন্ন টেবিলে জমজমাট আড্ডা, কেউ আবার হাত তুলে ওয়েটারকে ডাকছে।
এমন সময় রনি বলে, “অন্তীর একটা চোখ নষ্ট” !!!!!!!
কথাটা কিছুটা কাঁটার মত বিধে আসিফ-সৌম্য আর কাজলের মনে।
অন্তী যাকে ভালবাসত সেই মানুষটিই তার এক চোখ অন্ধ করে দিয়েছে।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তিনজনই রনির দিকে তাকিয়ে আছে।
আসিফ একটু একটু করে রেগে যাচ্ছে আর ঘামছে। মানুষ হয়ে অপর একটি মানুষের এতবড় ক্ষতি করতে তার এতটুকু বাঁধল না !!!!!!!!!!!!!
আড়মোরা ভেঙে চিৎকার করে আসিফ বলে ওঠে, ধিক্কার তোমাদের প্রতি হে মানবসম্প্রদায়, তোমরা যারা অসহায় নারীদের এসিড মারো, ধর্ষণ করো..........
তোমাদের জন্য লজ্জিত হোক আজ গোটা পুরুষ জাতি মানবিকতার অবক্ষয়ের জন্য........
খানিকক্ষণ পরে কাজল বলে ওঠে, মানবতা বিরোধী কাজ করে কেউ টিকে থাকে নি। টিকে থাকে নি নমরুদ, ফেরাউন পর্যন্ত........ তোমরাও একদিন ধ্বংস হবে, তোদের ধ্বংস অনিবার্য....।
৫।
কি করছো বাবা ????
পিছন ফিরে তাকাতেই আসলাম সাহেব দেখতে পান, তার বড় মেয়ে অন্তী !
ও অন্তী ! আয় মা। কিছু করছি না। এমনি বাড়ান্দায় বসে আছি।
না, তুমি কি যেন ভাবছিলে !!!! বল না বাবা .......
সে রকম কিছু নারে মা। ভাবছিলাম, আমি একজন ব্যর্থ মানুষ।
যে মানুষ তার সন্তানদের দুঃখ-কষ্ট দূর করতে পারে না !!!!!
অন্তী তার বাবার হাতটা ধরে বলে, ছিঃ বাবা, ওসব কথা বলে না। কত ভালো শিক্ষায় শিক্ষিত করেছ তুমি আমাদের দুই ভাই-বোনকে !!! মানুষকে মানুষ ভাবতে শিখিয়েছ। মানুষের জন্য, সমাজের জন্য ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণাতো আমরা তুমি আর মা’র কাছেই পেয়েছি বাবা।
একসময় আমাদের গাড়ি ছিল, বড় বাড়ি ছিল। তখন আমরা প্রতিদিনই ভালো খেতাম। ইচ্ছে হলেই বাইরে যেতাম সবাই মিলে........।
আর এখন ! সপ্তাহে মাত্র একদিন মাছ, একদিন গোশত খেতে পারি। সবাই মিলে বাইরে একসাথে বেড়াতে যাওয়াও হয় না।
তখন একপ্রকার সুখ ছিল আর এখন এখনও সুখ আছে কিন্তু একটু অন্যরকম।
তখন মনে হয়েছিল, পৃথিবীটা বুঝি এমনই। রাস্তায় ঘুমানো মানুষগুলোকে দেখলে কষ্ট হত, ভাবতাম, তাদের জন্য যদি কিছু করা যেত !!!!!!!!
আর এখন বস্তির মানুষ গুলোকে দেখলে মায়া হয়। কারন তাদের সাথে আমাদের জীবনযাত্রার কত মিল !!!!!
জীমন মানেই সংগ্রাম, বেঁচে থাকার চেষ্টা.........।
কথাগুলো শুনে বাবা কাঁদতে শুরু করেন।
আমার হাতদুটি চেপে ধরে বলেন, আমায় ক্ষমা করে দিস রে মা। তোর জন্য কিছুই করতে পারলাম না। আমায় ক্ষমা করিস !!!!!
আমি কিছু বলি না। বাবাকে জড়িয়ে ধরি। নীরবে জ্বল গড়িয়ে পড়ে ।
বাবা-মায়েরা এরকমই। সন্তানের ছোট-খাট কষ্টে এমনকি সমস্যায় তারা কাঁদে। কেঁদে বুক ভাসায়। আর আমারতো মহা সমস্যা.........
মাঝে মাঝেই মা আমার ঘরে আসেন বেশ রাত করে। আমার মাথার কাছে বসে মাথার চুলে, কপালে হাত বুলিয়ে দেন। আমি সব টের পাই, ভাল লাগে আমার। কিন্তু খানিকক্ষণ পর মা যখন নাক টানেন তখন আমার বুকের মাঝখান টাতে ব্যথা শুরু হয়।
বুকের ভেতর থেকে সবকিছু ভেঙে আসতে চায়। ব্যর্থ মনে হয় আমার জীবনটা.....।
এই অন্তী ! তোর বাবাকে নিয়ে খেতে আয়।
চল বাবা খেতে যাই। আসলাম সাহেব বলে, তুই যা আমি আসছি।
খাবার টেবিলে খেতে খেতে অন্তী বলে, বাবা ! রবিনের মাথা ব্যথাটা বেড়েছে। আজ দুপুরে সে একবার মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।
অসহায় ভঙ্গিতে বাবা বলে, আমার হাতে তো ডাক্তার দেখানোর টাকা নাইরে মা !!!!!!
আমি কাল ওকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাব বাবা। তুমি ওসব চিন্তা করো না।
৬।
আজ খুব গরম পড়েছে তাই না রে ????
রাহাত বলে, হ্যাঁ।
আপু একটা প্রশ্ন করি, সত্যি করে উত্তর দিবে তো ???
অন্তী বলে, আগে প্রশ্নটা করেই দেখ না বোকা ।
তোমার কানের দুলগুলো কি হলো ????
চুপ করে থেকে অন্তী। রাহাত জিঞ্জেস করে, কি চুপ কেন ???
অপরাধী সুরে বলে, ওগুলো মা’র কাছে রেখে এসেছি। দুল পড়লে আমার কানগুলো আমার কাছেই বড্ড বেশি ভারি লাগে।
অমলিন হাসি হেসে রাহাত বলে, আপু ! যে মিথ্যে বলতে জানে না, তার মিথ্যা কথা বলার চেষ্টা করা মোটেও সাজে না। ধরা পড়ে যায় অতি সহজেই........ যেমনঃ তুমি..........
সাথে সাথেই চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসে দু’জনের.............
আপনি কি হোন রোগীর ??? আমি ওর বড় বোন।
ওর কি কি সমস্যা খুলে বলুন তো........
ওর খুব মাথা ব্যথা হয়। মাঝে মাঝে এমন ব্যথা ওঠে যে ও চিৎকার করতে থাকে। এক সময় ছটফট করতে করতে অঞ্জান হয়ে যায়। আবার কিছুদিন হলো, মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে......।
আর কিছু ??? খাইতে চায় না একদম। গোসলের সময় প্রচুর মাথার চুল ওঠে।
আচ্ছা ঠিক আছে। এই টেষ্টগুলো করিয়ে আমার সাথে দেখা করবেন।
অন্তী বলে, ঠিক আছে। ডাক্তার মিষ্টি হাসে বলে, আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার ভাই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।
এরপর রাহাত আর অন্তী মিলে, হাসপাতালে গিয়ে টেষ্টগুলো করায়।
বাবা দোকান থেকে বাসায় ফিরে জিঞ্জেস করে, কিরে অন্তী ? ডাক্তার কি বললো ???
অন্তী বলে, ডাক্তার টেষ্ট করাতে বলেছে। কাল রিপোর্ট নিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে যাব।
হ্যালো, রনি ? কই তুই ?
আমি এই মুহুর্তে মধুতে। তুই কোথায় ? আমি ল্যাবএইড এ।
রাহাত এর রিপোর্টগুলো ডাক্তারকে দেখাব। তুই একটু আসবি ???
রনি বলে, তুই দাঁড়া আমি আসছি।
আধঘন্টা পর রনি এসে দেখে, অন্তী একটি দেয়ালে মাথা দিয়ে হেলান দিয়ে আছে। এভাবে অন্তীকে দেখে রনি’র বেশ মায়া হয়।
রনি অন্তীর কাঁধে আলতো করে হাত রেখে ডাকে, অন্তী !!!
চমকে ওঠে অন্তী ! ও রনি ! চল ডাক্তারের কাছে যাই .....
রনি, অন্তীর হাত ধরে তাকে ডাক্তারের রুমে নিয়ে যায়।
অন্তী রনির হাত ধরে রেখেছে। তার হাত-দুটি কাঁপছে। বুকটা ধক ধক করছে।
অন্তী কাঁপা কাঁপা গলায় জিঞ্জেস করে, রাহাতের কি হয়েছে ????
ডাক্তার অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলে, সিটি স্ক্যান এর রিপোর্ট-টা ভালো আসে নি .......!!
আমি একাধিকবার চেক করেছি কিন্তু রেজাল্ট একই।
কি রেজাল্ট ? চোখ বড় বড় করে রনি জিঞ্জেস করে ।
ডাক্তার অতি শান্ত গলায় বলে, পেসেন্ট এর ব্রেইন টিউমার হয়েছে.........
কথাটা শুনে অন্তী আর রনি দু’জনেই ধাক্কা খায়। অন্তী যেন কথাটা বিশ্বাস করতে পারছে না।
চোখ বড় করে বিস্ময়ের ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। তার হাত-পা কাঁপছে। শক্ত করে ধরে রেখেছে রনি’র হাতটা।
একটা চোখ দিয়েই এই পৃথিবীটা দেখে অন্তী। সেই চোখটাও তার কষ্টের লোনাজ্বলে ঝাপসা হয়ে আসে।
ডাক্তার বলে, এটা যে ধরনের টিউমার তাতে অপারেশনের কোন বিকল্প নেই। আপনারা যতদূত সম্ভব অপারেশনের ব্যবস্থা করুন।
অন্তী বুঝতে পারে না সে কি বলবে !!!!!!!!!
ঝাপসা চোখ নিয়েই সে অবাক দুষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নীরবে জ্বল গড়িয়ে পড়ে চিবুক বেয়ে। তার মনের ভিতর জ্বলতে থাকে কষ্টের আগুন।
সবকিছু, সবকিছু অর্থহীণ, আর ফালতু মনে হয় তার।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে অন্তীকে বাড়িতে পৌছে দেয় রনি।
এতটা রাস্তা দু’জনের কেউ কথা বলে নি। বোবা হয়ে গেছে দু’জনেই..........
নীল, একেবারে নীল হয়ে গেছে অন্তী.......... কষ্ট আর আশাভঙ্গের বেদনায়...............।
৭।
দু’দিন হলো রাহাতকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রায় সারাদিনই অন্তী, রাহাতের সাথে থাকে। মা দুপুরবেলা খাবার নিয়ে আসে। আবার সন্ধ্যা হলেই বাসায় চলে যান। রাতে আসে বাবা..........
আমি যখন ঘুমোই তখন সারাক্ষণ আপু আমার দিকে তাকিয়ে থাকে আর আমার হাত ধরে থাকে। মাঝে মাঝে আমার গাল ছুঁয়ে দেয়, কপালে হাত বুলিয়ে দেয়।
আমি স্পষ্ট সব টের পাই..........
হঠাৎ ঘুম ভেঙে চোখ খুলতেই দেখি, আপু আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর তার চোখের কোণা দিয়ে টুপ টুপ করে জ্বল পড়ছে। আমি তাকাতেই কি যেন খোঁজার ভান করে অন্য দিকে তাকিয়ে চোখ মুছে ফেলে।
কিছু খাবি ভাইয়া ??? জুস করে দিই ?????
না রে, এখন খাব না। পরে......
আমি জানি, আমি খুব তাড়াতাড়ি মারা যাব।
ইদানিং মা হাসপাতালে আসলেই আমার হাত-টা শক্ত করে ধরে রাখে। মাঝে মাঝে আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদে। তখন আমার খুব কষ্ট হয়। স্থির হয়ে শুয়েও থাকতে পারি না। বুকের ভেতর থেকে সবকিছু বের হয়ে আসতে চায়। মা আমায় জড়িয়ে ধরে থাকেন পরম মমতায়, অসীম নির্ভরতায়।
যেন আমায় কোথাও যেতে দিবেন না। যতবড় ঝড় আসুক না কেন; আমায় নিয়ে যেতে দিবে না। মাতৃত্বের আবরনে আমার চারপাশে দেয়াল তৈরি করে রেখেছে।
আর বাবা !!!!!!!! বাবা আমাকে প্রতিদিনই দেখতে আসেন। কিন্তু কোন দিন আমার কাছে আসেন না। দরজায় দাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
বাবা দেখতে এমনিতে একটু কালো। কষ্টের আগুনে পুড়ে তার মুখখানা আরো বেশি কালো হয়ে গেছে।
বাবাকে আমি কাছে ডাকি কিন্তু তিনি আসেন না !!!!!!!!
আমি বুঝতে পারি, বাবা লজ্জায় আমার কাছে আসেন না।
পিতা হয়েও সন্তানের জন্য কিছু করতে না পারার কষ্টে তিনি নিজেকে ধিক্কার দেন প্রতি মুহুর্তে। নিজের অসহায়ত্বে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন।
সন্ধ্যার দিকে রনি ভাইয়া এসেছিল। অন্তী আপুর সাথে গল্প করছিল। এমন সময় হঠাৎ আমার কানে আসে, অন্তী আপু বলছে –
আমাদের গ্রামে যে ৪ বিঘা জমি ছিল তা বাবা বিক্রি করে দিচ্ছে। বাবা তার দোকানটাও বন্ধক রেখেছে ব্যাংকের কাছে। যা টাকা হয় তা দিয়েই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।
কথাটা শুনেই বুকটা ধক করে ওঠে। মৃত্যু-পথযাত্রী এই আমার বাঁচার আকুল ইচ্ছা প্রকাশের আশা জাগে। তবুও আশা মাড়িয়ে আমি চুপ করে থাকি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই, গন্তব্যহীণ ভাবে ছুটে চলা পাখিদের দেখি........।
মৃত্যু-পথযাত্রী এই আমার জন্য নিজের সমস্তকিছু বিলীন করে দেওয়ার কোন মানেই হয় না। তবুও মা-বাবা তাই করেন সন্তানের জন্যে। নাড়ীর বন্ধন বলে কথা.........
৮।
হ্যালো, রনি ? আমি অন্তী !
এত রাতে কল করলি যে !!!!!! কোন সমস্যা ?
হ্যাঁ, রাহাতের শরীর বেশি খারাপ করেছে। বারবার বমি করছে, আর মাথা ব্যথায় চিৎকার করছে। তুই কি একটু আসতে পারবি ????
ঠিক আছে, আমি আসছি।
রনি হাসপাতালে এসে দেখে অন্তী আর তার মা স্থির হয়ে বসে আছে।
অন্তী রনিকে দেখেই বলে, বাবা ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গিয়েছেন। তুই একটু গিয়ে বাবার সাথে থাক তো .....
রনি ডাক্তারের রুমে ঢুকতেই হঠাৎ কি মনেকরে যেন থমকে দাঁড়াল।
ডাক্তার বলছে, আপনাকে আগে অপারেশনের টাকা আর কিছু ঔষধ-পত্রের টাকা পরিশোধ করতে হবে। নইলে আমরা অপারেশনে যাব না।
অন্তীর বাবা হাত জোর করে বলছে,
ডাক্তার সাহেব, আমার সমস্ত সম্পদ বিক্রি করে যা টাকা হয়েছে তার সবটুকু আমি দিয়ে দিয়েছি। আমার আর কিছুই নেই যে আমি তা বিক্রি করে বাকি টাকা দিতে পারি।
প্লিজ ডাক্তার সাহেব, আমার ছেলেকে বাঁচান।
কথাটা বলতে বলতে, অন্তীর বাবা ডাক্তারের পা পর্যন্ত ধরেন......
পা ধরতেই ডাক্তার বলে, আমরা কিছু করতে পারবো না। সম্পূর্ণ টাকা না দেওয়া পর্যন্ত আমরা অপারেশনে যেতে পারব না। কাল সকালের মধ্যেই আপনি টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করুন।
অসহায় আর পরাজিত মানুষের মত মাথা নিচু করে অন্তীর বাবা ডাক্তারের রুম থেকে বের হয়ে আসে।
বাবাকে দেখেই অন্তী এগিয়ে আসে। বলে, কি হল বাবা ? ডাক্তার কি বলল ?
অন্তীর বাবা মাথা নিচু করেই থাকে। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে, আগামীকাল সকালের মধ্যে সব টাকা পরিশোধ করতে হবে। না হলে তারা অপারেশনে যাবে না।
কথাটা বলেই বাবা অন্যদিকে হাটতে থাকেন।
কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না অন্তী, এমনকি রনি’ও..........
একটাকা বা একহাজার টাকার কথা না.........। পুরো পাঁচ লক্ষ টাকার দরকার।
অন্তী মনে মনে ভাবে, আশরাফুল মাখলুকাত হয়েও মানুষ সত্যিই কত অসহায়, কত নিরীহ !!!!!!!!
আচ্ছা, এটাই কি স্রস্টার কৃতিত্ব ???
কোন উত্তর খুঁজে পায় না অন্তী। কেবল স্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ..........।
রাহাতকে ঘুমের ইনজেকশান দেওয়া হয়েছে। সে ঘুমোচ্ছে।
রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। অন্তীর মা, রাহাতের মাথার পাশে বসে আছে। কোন কথা নেই কারো মুখে।
অন্তী বিছানার পাশে চেয়ারে বসে রাহাতের হাত ধরে তার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আর চোখের কোণা দিয়ে জ্বল ঝড়ছে নীরবে, রাতের নিঃস্তব্ধ পরিবেশের মতই............।
ফজরের আযানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। অন্তীর বাবা আর রনি নামাযে গিয়েছে।
হঠাৎ অন্তী অনুভব করে, রাহাতের শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে।
অন্তী চিৎকার করে ডাকে, নার্স, নার্স।ওর শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। ডাক্তার ডাকুন........
অন্তীর চিৎকার শুনে দায়িত্বে থাকা ডাক্তার আর নার্স ছুটে আসে।
ডাক্তার এসে রাহাতের পার্লস চেক করে। পার্লস নেই।
ডাক্তার রাহাতের বুকে চাপ দেয়.......। কোন কাজ হয় না.....
বুকের ভিতর হার্ট-টাও ধুক ধুক করছে না।
কিছুক্ষণ থেমে ডাক্তার রাহাতের গায়ে জড়িয়ে থাকা সাদা চাদর টা মাথা পর্যন্ত ঢেকে দেয়.......।
দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রাহাতের মা দৌড়ে এসে রাহাতের পা দুটি জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলে ওঠে, বাবারে...... ফিরে আয় আমার কোলে......... আর কাঁদতে থাকে ....... জ্বল গড়িয়ে পড়ে অঝর ধারায়.......
অন্তী মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখের জ্বল যেন শুকিয়ে গেছে।
তারপর ধির পায়ে অন্তী রাহাতের কানের কাছে গিয়ে বলে,
“ ভাইয়া, চলে গেলি রে !!!! ভালোই করেছিস। এই পৃথিবী আমাদের মত অসহায় আর পরাজিত মানুষদের জন্য নয়। বাবা অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু পারে নি......। মনুষ্যত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে কেউ এগিয়েও আসে নি.....। এমনকি ডাক্তার গুলোও নয় !!!!! তুই আমাদের ক্ষমা করিস !!!!! যাবার আগে অন্তত একটি বার আমার সাথে কথাও বললি না ” !!!!!!!!!
রুমের বাইরে অন্তী দাঁড়িয়ে আছে। বাবা আর রনিকে আসতে দেখেই সে এগিয়ে যায়।
এগিয়ে গিয়েই সে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে।
বাবা বলে, চিন্তা করিস না মা। একটা উপায় বের হবেই।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর হৃদয়ের সমস্ত বাতাস বের করে দিয়ে অন্তী বলে, বাবা ! তোমার ছেলে পৃথিবীর সব বন্ধন আর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে। সে আর কোনদিন তোমায় বাবা বলে ডাকবে না; আমায় নিয়ে বাইরে যাবে না........
কেবলই স্মৃতি হয়ে থাকবে...........।
৯।
রাহাত মারা যাবার পর অনেক রকম দুঃচিন্তা ছিল, মা-বাবা কিভাবে সামলাবে নিজেদের, পরিবারটাকে বাবা কিভাবে চালাবে !!!!!!!
কিন্তু রাহাতের জন্য কোন কিছুই আটকে থাকল না। জীবন চলতেই থাকল। খালি সময়গুলোকে আগের চেয়ে বেশি অস্বস্তিকর মনে হতে লাগল। মনেহয় গভীর শূন্যতায় তলিয়ে যাচ্ছি একটু একটু করে।
মাঝে মাঝে ভাবি, একটু বাইরে থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।
রাহাত বেঁচে থাকতে কতদিন ঠিক করেছি- এবার ছুটিতে আমরা সীতাকুন্ড, সিলেট, অথবা কক্সবাজার বেড়াতে যাব।
কিন্তু যাওয়া হয়নি তখনও......। আর এখন ? এখনতো আমি একা। কিভাবে যাব !!!!!!!!
একদিন হঠাৎ করে রাহাতের ট্রাঙ্কটা খুললাম। কত কি সাজিয়ে রেখেছে। আমি জীবনে প্রথম বেতন পেয়ে একটা কলম তাকে উপহার দিয়েছিলাম। সেই কলমটাও অতি যত্নে রেখেছে সে।
স্কুলের প্রতিযোগিতায় যে পৃরস্কার গুলো পেয়েছিল সেগুলোও সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে।
হঠাৎ একটা ডায়েরি দেখতে পেলাম। হাতে নিয়েই পড়তে শুরু করলাম :-
২২-৪-০৬ ইং
রনি ভাইয়া আমায় এমন একটা কথা বলেছে যে আমি সম্পূর্ণ অবাক। বলেছে, তিনি নাকি অনেক চেষ্টা করেও একটা কথা অন্তী আপুকে বলতে পারে নি। কত ভীতু একটা মানুষ !! আরও বলেছে আমি যেন অন্তী আপুকে কোন ভাবেই না বলি।
১৮-৫-০৬ ইং
প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় গণিতে ৯৬ নম্বর পাওয়ার পর ক্লাসের সবাই হাততালি দিয়েছিল। ক্লাস শেষে একটা মেয়ে আসে আমায় বলে, অভিনন্দন। যা লজ্জা পেয়েছিলাম !!!!!!! উত্তরে কিছুই বলতে পারি নি।
২৯-৬-০৬ইং
অন্তী আপুর কষ্টের কথা মনে পড়লেই আমার ভিতরের সবকিছু বের হয়ে আসতে চায়। স্রস্টা যদি আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও আপুর জীবনের সব-কষ্ট দূর করে দিত !!!!!!
১২-৮-০৬ ইং
আপু আজ তোমার জন্মদিন। বাবা-মায়ের অফুরন্ত ভালবাসা তুমি পেয়েছ। সাথে সাথে পেয়েছিলে অন্য একটি মানুষেরও। অথচ তার পরও তোমার জীবনে কত কষ্ট !!! এত ভালবাসা পাওয়ার পরও তুমি প্রতি রাতেই কাঁদ, আমি টের পাই। তুমি কি জান, তোমার কষ্টে আমিও মাঝে মাঝে কেঁদে বুক ভাসাতাম.........?
ডায়েরির লিখাগুলো আর পড়তে ভালো লাগে না। সাথে সাথেই ডায়েরিটা বন্ধ করে রাখি। বিষন্নতায় ডুবে যাই সম্পূর্ণ আমি । ঝাপসা দেখি সব-সবকিছু...........
১০।
ছয় বছর লাগল অনার্স শেষ করতে। রেজাল্ট বেরিয়েছে গত পরশু দিন। আট মাস হল ভার্সিটি যাওয়া হয় না।
মাঝখানে বাড়ি পাল্টেছি বলে, কোন বন্ধু-ই নতুন বাড়ির ঠিকানা জানে না।
ভার্সিটিতে গিয়ে রেজাল্ট দেখছি। হঠাৎ শুনলাম, পেছন থেকে কে যেন অন্তী বলে চিৎকার করছে। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি রনি ।
কাছে এসেই বলে, কত দিন তোকে দেখি না !!!!! তোর কোন খবরও নেই। বাড়ি পাল্টেছিস কিন্তু ঠিকানা পর্যন্ত দিস নি।
চল ! মধুতে গিয়ে গল্প করব......।
মাস্টার্স করবি না ????
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর অন্তী বলে, অনার্সটাই করা হচ্ছিল না ! আর মাস্টার্স !!!!! জানিসতো একবছর বাবা কোন টাকা দিতে পারে নি ।
রনি, আর থাকতে ভালো লাগছে না। আমি যাই। পরে কথা হবে। কথাটা বলেই অন্তী উঠে চলে যায়।
১১।
মা-অন্তী ? আসব ? হ্যাঁ বাবা আস। কিছু বলবে ?
বাবা চোখের চশমাটা আরেকটু উপরে উঠিয়ে বলে, ইয়ে মানে !!!! না থাক !!!!!
বাবা চলে যেতে শুরু করে। পিছন থেকে আমি বলি, তুমি কি বলতে এসেছ আমি জানি বাবা।
উনাকে বসতে বল আমি আসছি। বাবা আমার দিকে একটা প্রশান্তির হাসি দিয়ে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
বিশ মিনিট পর অন্তী বসার ঘরে আসে। এসেই বলে, বাবা আমি উনার সাথে একটু গল্প করতে পারি ???
বাবা, চলে যেতেই উনার পাশের চেয়ারে আমি বসি।
মাথা নিচু করে বলি, আমার বিষয়ে আপনি কতটুকু জানেন ????
পাশের চেয়ারে বসে থাকা মানুষটি বলে, আমি প্রায় সবকিছুই জানি। আর জেনে শুনেই আপনাকে বিয়ে করতে চাই ।
অন্তী বলে,
আমার অন্ধকার অতীতের কিছু অংশ আপনি দেখেছেন ??? তবে আমার ভেতরটুকু কি আপনি দেখেছেন ??
না, দেখেন নি। সেখানে একটি নয়, হাজারো পলিপ আছে। আর এক-একটি পলিপ তৈরি হয়েছে এক-একটি কষ্টের জন্য, ব্যর্থতার জন্য। আপনার আগেও আমার জন্য ছয়টি প্রস্তাব এসেছিল। আমি ফিরিয়ে দিয়েছি কারন তারা বিনিময়ে বাবার কাছে তার সকল জায়গা-জমি চেয়েছিল। তবে আপনি শুধু বাবার কাছে একটি মোটরসাইকেল আর বাবার দোকানটা চেয়েছেন। তাই ভাবলাম আপনার সাথে একটু কথা বলি।
প্রথম ভালবাসার প্রতি মানুষের যেমন আকর্ষণ থাকে তেমনি আমারও ছিল। একটা ছেলেকে ভালবাসতাম। সেও আমায় ভালবেসেছিল। একবছর পর, হঠাৎ জানতে পারি, সে অন্য একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। একদিন আমার সামনে ধরা পড়ে যায় সে। তারপর আর যোগাযোগ হয় নি আমাদের।
বিচ্ছেদের ৮ মাস পর একদিন হঠাৎ আমাদের দেখা হয়। সে আমায় পুচকা খাওয়াতে চায়। কি মনে করে আমিও রাজি হই। কথা বলতে বলতে হঠাৎ সে আমায় জাপটে ধরে আমার মুখে কি যেন ঢেলে দেয়। আমি সরিয়ে দিতেই ওগুলো আমার চোখে এসে পড়ে। আর সেই থেকেই আমার একচোখ অন্ধ...........
আমি জানি, পৃথিবীতে মেয়ের অভাব পড়ে নি যে আমাকে আপনার বিয়ে করতে হবে। আপনি রাজি হয়েছেন কারন বিনিময়ে আপনি একটি মোটরসাইকেল আর বাবার দোকানটা পাবেন। আর সময়ে অসময়ে বাবার কাছে অনান্য সুবিধা নিবেন তাও আমি জানি। আজও আমাদের মত মেয়েরা আপনাদের কাছে পণ্যই রয়ে গেল। যখন ইচ্ছে এসিড মারেন, ধর্ষণ করেন তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেন অব্যবহৃত প্লাস্টিকের মত।
বিনিময়ে কিছু পাওয়ার লোভে আমায় বিয়ে করবেন- এতে আমাদের মাঝে কতটুকু ভালোবাসা থাকবে বলুন ??? কোন দিন কি আপনার উপর আমার সত্যিকারের শ্রদ্ধাবোধ জন্মাবে ??? আমি কি কোন দিন বলতে পারব, আমার স্বামী সত্যিই একজন বড় মনের মানুষ ????
প্রতিরাতেই মা নীরবে কলপাড়ে গিয়ে কাঁদেন। আমার জন্য..........। কখনো একলা চলতে না পারা মেয়ের কষ্টে কাঁদেন, বিয়ে দিতে না পারার কষ্টে কাঁদেন, পদে পদে হোঁচট খাই এই কষ্টে কাঁদেন..........।
দেখুন, বাবাকে যৌতুক দিতে হলে আমি বিয়ে করতে রাজি নই। আমি সেই মানুষটিকে বিয়ে করব না, যে বিনিময়ে কিছু পাওয়ার লোভে আমাকে বিয়ে করবে........। আমি বিয়ে করব সেই মানুষটিকে যে আমার কাষ্টলি অতীতের কথা জেনে কেবল আমার জন্যই আমাকে বিয়ে করবে। আর বিনিময়ে ???
বিনিময়ে আমার কাছে চাইবে শুধু একবুক ভালোবাসা............।
পাশে থাকা মানুষটি মাথা নিচু করে আছে।
অন্তী চেয়ার থেকে উঠে তার রুমের দিকে চলে যেতে শুরু করে।
হঠাৎ পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে, বুকে হাত দিয়ে একবার ভাবুন তো, আপনি কি সেরকম একজন মানুষ ??????