Tuesday, August 12, 2014

স্পর্শের বাইরে…


উ।ৎ।স।র্গ

কোনদিন দেখা হয় নি মানুষটির সাথে, ফেসবুকে পরিচয়। তবুও অল্প দিনেই তার শব্দ চয়ন, বাক্যবুনন আর অনুভূতির প্রকাশ আমায় মুগ্ধ করেছে।
আর মুগ্ধ করতে পারার আতিশায্যে তিনি হয়ে উঠেছেন আরো বিনয়ী। একদিন কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন, “উপলব্ধিতা আর আকুলতার
এই পরশই বারে বার আপনাকে তার শুদ্ধ অনুভূতির জানান দেবে। ঘুণেধরা কি না জানি না, আপনি পরাজিত নন।
কেননা পরাজয় কেবল তা মেনে নিলেই আসে, অন্যথায় নয়। যে অনুভূতির তীব্রতাকে এলো করতে জানে, সে অতটা দূর্বল কখনোই নয়।
আপনার অনুপ্রেরণা আমাদের জন্য আনন্দের”। এই কথা পড়ে সাথে সাথেই শ্রদ্ধায় কুঁকড়ে গেছি !

প্রিয় মাহবুব ভাইয়া; প্রিয় মাহবুবুল আলম

কোন এক বর্ষাস্নাত বিকেলে আপনার সাথে আড্ডা দেওয়ার স্বপ্ন দেখি…
হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার প্রককালে প্রশ্ন করব, ভাইয়া- অস্তিত্বের দহন কথাটির অর্থ কি বলতে পারেন ?




টুং করে শব্দ হলো। ফেসবুকে নোটিফিকেশনের শব্দ। রিসাদ চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে গল্পের বই পড়ছে। শব্দ শুনেই ল্যাপটপের দিকে তাকাল।
একজন দুটি ছবি শেয়ার দিয়েছে। প্রথম ছবিটায় কেবলমাত্র একজোড়া পায়ের ছবি। প্রথমে খুব স্বাভাবিক মনে হল রিসাদের।
কই বিশেষ কিছুতো নেই। তারপর একটু গভীরভাবে তাকাল। মেয়ে মানুষের পা। যত্ন করে নেলপালিস দিয়েছে, আলতা পড়েছে।
রিসাদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে আলতো করে হাসি দিল। তারপর দ্বিতীয় ছবিটায় ক্লিক করল।

দুটো মানুষ হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে; তাদের ছায়ার ছবি। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, প্রিয়তীর হাতে ঝুলছে চুড়ী।

ছো্ট্ট একটা লাইক দিয়ে রিসাদ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ ঐ ছায়া জড়ানো ছবিটার কথা ভাবতে লাগল। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, ৪ বছর আগের কথা …

টিএসসির সামনে বসে আছে রিসাদ। অপেক্ষা করছে তরুর জন্য। আসার কথা ছিল বিকেল ৫টার দিকে। এখন ঘড়িতে বাজে বিকাল ৫টা ২৫ মিনিট তবুও তার আসা হল না ! রিসাদ খানিকটা বিরক্ত। হঠাৎ এক বাদামওয়ালা এসে বলে, মামা দিব নাকি ৫টাকার বাদাম ?
উত্তরে রিসাদ বলে, না মামা। তোমার মামী আসুক তখন দিও।

বাদামওয়ালা আবারও প্রশ্ন করে, ক্যান মামা, অহন লন, তখনও নিবেন।

বিরক্তির ভঙ্গিতে রিসাদ বলে, তোমার মামী আসুক তখন দিও। একসাথে ১৫ টাকার দিও। ৫ টাকার আমি খাব, ৫ টাকার খাবে তোমার মামী আর বাকি ৫ টাকার বাদাম তুমি খাবে। ঠিক আছে মামা ?

বাদামওয়ালা কিছু বলে না। কয়েক সেকেন্ড ভ্রু-কুচকিয়ে তাকিয়ে থেকে চলে গেল। যেতে যেতে বলতে লাগল, এই বাদাম হবে বাদাম…মচমচা, টাটকা বাদাম…

অবশেষে ৫টা ৩৫ মিনিটে তরু এল। সে জানে, রিসাদ খানিকটা বিরক্ত। আর তাই ঠোঁটের কোণে সর্বদা একটা হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হবে তাকে,
তাহলে রিসাদ আর কোন অভিযোগ করতে পারবে না, রাগ করতে পারবে না।
সামনে এসে দাঁড়িয়ে তরু তাই করল। সে আজ লাল রঙের সালোয়ার-কামিজ পড়েছে। বরাবরের মত হাতে কাঁচের চূড়ী পড়েছে তবে একটাই পরিবর্তন।
আজ সে কপালে টিপ দেয় নি, চোখে কাজল পড়ে নি।
খুব ভাল ভাবে লক্ষ্য করে রিসাদ। না, এই ড্রেসেও তাকে খুব চমৎকার লাগছে, মায়াবী লাগছে। খানিকটা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে রিসাদ।

সদ্য বিশ পেরুনো এই মেয়েটির ভ্রুর নিচে চঞ্চল চোখ আর বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠা অবিন্যস্ত চুল… অন্যরকম মায়াবী লাগছে। সে পায়ে হেঁটে নয়, রথে চড়ে এখানে এসেছে !

ঠোঁটে মুগ্ধ করা হাসি, দোলন চাপার গন্ধে ভেসে যাওয়া বাতাস আর হঠাৎ হঠাৎ লজ্জায় প্রেয়সীর চোখ নামিয়ে নেওয়া- সবমিলিয়ে নিথর দেহটা রিসাদের কেঁপে ওঠে, তার অস্তিত্ব জানিয়ে দেয়, এইত- এইত কাঙ্খিত মানুষটি।

মুচকি হেসে জিঞ্জেস করে, তুমি কি শ্যামল ছায়া ?

চোখ নামিয়ে তরু পড়া না পারা ছাত্রীর মত বলে, জানি না। তবে তুমি ভালবাস বলেই আমার ছায়া আজ শ্যামল হয়েছে, হয়েছে আবেশী।

তরু জিঞ্জেস করে, কখন এসেছ ?

এইত। খুব বেশি না, মাত্র ৫০ মিনিট আগে !
কথাটা শুনেই তরু জিহ্বায় কামড় দেয়। সর্যিল, অনেকক্ষণ দাড়িয়ে রেখেছি !

খানিকক্ষণ পর রিসাদ বলে, আজ কিন্তু তোমার তাড়াতাড়ি ছুটি নেই।

কেন ? এতক্ষণ কি করব ? স্বাভাবিক ভাবে জিঞ্জেস করে তরু।

রিক্সায় চড়ে ঘুরব, যা ইচ্ছে তাই করব। রাতের ঢাকা দেখব। গাড়ির হর্ণ শুনব, মানুষের ছুটোছুটি দেখব, অজানা পথিকের ঘরে ফেরার গান শুনব, পিচঢালা রাস্তায় নগ্ন পায়ে হাঁটব।
ছোট্ট করে তরু বলে, তাই ?
হুম তাই, একদম তাই, ঠিক তাই।

চল এবার মধুর ক্যান্টিনের দিকে যাই, ওখানে গিয়ে গল্প করি।

রিসাদ আর তরু মধুর ক্যান্টিনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। আচ্ছা এভাবে কতক্ষণ হাঁটতে পারবা তুমি আমার পাশে ? প্রশ্নটা করেই তরু রিসাদের দিকে তাকায়।
বিশ্বাসী সুরে রিসাদ উত্তর দেয়, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি ক্লান্ত না হও।
ভালবাসার এই হাঁটায়তো ক্লান্তি নেই, নেই কোন তাড়া। বরং আছে তৃপ্তি !
হাঁটতে হাঁটতে রিসাদের ডান হাতটা আলতো করে তরুর বাম হাতের সাথে স্পর্শ লাগে। সাথে সাথেই লজ্জা পেয়ে যায় তরু।

খানিকক্ষণ পর তরু বলে, তৃপ্তিটা কিসের জান ?

নিজে প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দেয়।পথ পেরুনোর তৃপ্তি, হৃদয় দিয়ে অন্য হৃদয় ছুঁয়ে দেওয়ার তৃপ্তি, চোখের পাতায় একমুঠো স্বপ্ন বুনে দেওয়ার তৃপ্তি। …


অনেকদিন পর পুরনো স্মৃতির কথা পড়ে গেল রিসাদের। ঠিক তেমনি আড়াই বছর আগের কথা-

একদিন হঠাৎ তরুর ইচ্ছে হল, নগ্ন পায়ে সোডিয়াম বাতির নিচে হাঁটবে। যেই ইচ্ছা সেই কাজ। অনেককষ্টে রিসাদকে রাজি করিয়ে দুজনে রিক্সায় করে শাহবাগ আসে।
ঘড়িতে বাজে তখন রাত সাড়ে নয়টা। শাহবাগ তখনও পূর্ণরূপে প্রাণবন্ত। দেড়শ ফিট রাস্তার দু’পাশই গাড়ি দিয়ে গিজগিজ করছে।

রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে তরু রিসাদকে বলে, কোন কথা হবে না কেবল হাঁটব। নীরবতায় হবে ভাবের সকল আদান-প্রদান।

পায়ের স্যান্ডল গুলো হাতে নিয়ে তরু ধীর পায়ে টিএসসির দিকে হাঁটা শুরু করল। এই দেখে মুচকি হেঁসে রিসাদ বলে, পাগল মেয়ে…।

পায়ের স্যান্ডলগুলো হাতে নিয়ে সেও তুরুর পাশাপাশি হাঁটছে। সোডিয়াম বাতির আলোয় আলোকিত রাস্তায় দুটি মানুষ নগ্ন পায়ে হেঁটে চলছে।
পাশে দিয়ে শতশত রিক্সা আর কখনো কখনো ৪/৫টি গাড়ি যাচ্ছে-আসতেছে। রিসাদ আর তরু হাঁটছে তাদের মতই, আনন্দ নিয়ে।
তরু অনুভব করে, শান্ত লাগছে, বেশ শান্ত লাগছে।

রিসাদের বাম হাতটা আলতো করে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে সে।

অন্ধ, অবিকল অন্ধ মেয়ের মত হাঁটছে। সে জানে রিসাদ তার হাত ধরে আছে- বিশ্বাসী বন্ধুর মত, সাহসী পথ-নির্দেশকের মত, প্রেমিকের মায়ায়, জীবনের পূর্ণতার আকাঙ্খায়।…
বিছানায় শুয়ে আছে রিসাদ। শুয়ে শুয়েই পুরনো স্মৃতিগুলো মনে করছে। না, কেমন যেন অস্থির লাগছে। কেমন যেন একটা গুমোট পরিবেশ, অনেকটা দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম।
টেবিল থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে সে তার মাকে কল দেয়।

হ্যালো মা, কেমন আছ ?
ভাল বাবা। তোর খবর কি ?
ভালই আছি। কি রে ? তোর কণ্ঠ ভারী লাগছে কেন ?

তেমন কিছু না মা। আচ্ছা বাবা কই ?
কই আবার ! এলাকার নেতাদের নিয়ে ড্রইং রুমে মিটিং করছে আর খানিকক্ষণ পর পর বলছে, চা পাঠাও।

মা একটা প্রশ্ন করি ? সাবলীল ভাবে রিসাদের মা বলে, হ্যাঁ কর।

সমাজসেবা ভাল কাজ যদি সেটা হয় পূর্ণ সততায়। কিন্তু কি জান মা, প্রতিটি মানুষের জীবনেই কিছু অপূর্ণতা থাকে। বাবা কি পারবে সে অপূর্ণতাগুলো পূরণ করতে ?
আগামীতে কি এগুলো বাড়বে না ?

খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর রিসাদের মা বলে, জানি না। বলেই ফোনটা কেটে দেয়।

শূন্যমনে রিসাদ নিজেকে প্রশ্ন করে, কেন এই ছুটোছুটি ? কেন বাস্তবতার মোড়কে আমাদের সাবলীলতার সাথে, সৃজনশীলতার সাথে সমঝতা করতে হয় ? কেন ?

গভীরভাবে চিন্তা করে রিসাদ…কোন উত্তর আসে না ! জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি মেলে দেয়। কি যেন একটা পোকা চিকচিক করে ডাকছে। বাইরের আবহাওয়া বেশ শান্ত মনে হচ্ছে।
কর্মচাঞ্চল্য যেন একটু বিশ্রাম নিয়েছে।

কখনো কখনো এমন হয়, হৃদয়টা আবেশে পূর্ণ থাকলেও মাথায় কিছুই আসে না। তখন কোন কিছু করতেই ভাল লাগে না।
না শুয়ে থাকতে, না কথা বলতে ,না স্বপ্ন দেখতে ! রিসাদের ঠিক তেমনি লাগছে।

বিছানা থেকে উঠে টেবিলের সামনে গিয়ে বসে। ফেসবুকে নিজের প্রোফাইলে গেলেই লক্ষ্য করে একজন কমেন্ট করেছে, “ নিয়মিত বাস্তবতার দোলাচলে ক্ষয়ে যাওয়া এই আমরা নিজেকে খুঁজে পাইকবিতার মাঝে... সাথে সাথে এ্যাকুইরিয়ামের মাছের মত টুই করে ওঠে আমাদের বোধগুলো...চোঁখ তুলে তাকায় হৃদয়ের দেয়ালে জন্মানো শ্যাওলাগুলো...হয়ে যাই আমরা কবিতার ওই শব্দগুলোর মত প্রিয়... হয়ে যাই অনুতপ্ত...”।

কমেন্টটা পড়েই চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে আলতো করে চোখ বন্ধ করে রিসাদ।চোখ বন্ধ করতেই তরুর চেহারা ভেসে ওঠে…

আর সাথে সাথে চোখ খুলে ফেলে রিসাদ। খানিকক্ষণ পর আবার চোখ বন্ধ করে। এবারও একই ঘটনা ঘটে। অবাক হয় রিসাদ।
বুঝতে পারে, পুরনো স্মৃতি ভালো ভাবে জেঁকে বসেছে।

এমন সময় তার চোখ যায় টেবিলের ওপর রাখা খাতা ও কলমের দিকে। কতদিন ধরে অবিন্যস্তভাবে পড়ে আছে !
শেষ কবে- আবেগের কথা, আবেশের কথা, মানুষের কথা, বন্ধনের কথা লিখেছিল তার মনে নেই !
খাতা টেনে কলমটা হাতে নিয়ে গালে হাত দেয় রিসাদ। কি লিখবে ? কি নিয়ে লিখবে ? কার কথা লিখবে ?


প্রিয় তরু,
শেষবার তোমার সাথে দেখা হয়েছিল আড়াই বছর আগে…শেষবার কথা হয়েছিল আট মাস আগে ! অথচ কি আশ্চর্য, আজও তোমার বিশুদ্ধ ছোঁয়া অনুভব করি। অনুভব করি তোমার প্রতি ভাললাগার প্রতিফোঁটা আবেশ। প্রথম ভালবাসা জিনিসটি তো বরাবরই বিশেষকিছু ! আমাদের কাছেও তাই ছিল। তেমনি ছিল কিছুটা আড়ালের, কিছুটা গভীরতার, কিছুটা সম্মানের আর এগুলোর চেয়ে ঢের বেশি অনুভবের, বিশ্বাসের। অথচ স্বপ্নেও ভাবি নি, তোমার সাথে যোগাযোগই থাকবে না ! ৪ বছর হয়ে চলল আমাদের বন্ধন ছিঁড়েছে কিন্তু সেই প্রথম দেখার মত তুমি আজও আমার কাছে মোহনীয়, স্নিগ্ধ। বর্ষাকালের প্রথম কদম ফুলের মত বিশেষ কিছু, রজনীগন্ধার মত সৌরভের, জ্যোৎস্না স্নানের মত মায়াবী ! আর এই অনুভূতিই তো প্রমাণ করে, ভালবাসি এখনও ! গভীর মমতায় ছুঁয়ে দিলেই মন বলে দেয়- এইত, এখানেই মন বসেছে, এখানেই আমার আবাস। ভাললাগে সবকিছু, ভালবাসতে ইচ্ছে করে সবকিছু। ইচ্ছে করে তোমার ভালবাসার সাগরে ডুব দিয়ে শুদ্ধ হতে।

৪ টি বছর হয়ে গেল … !

জীবন আবেগী মানুষকে সমঝতা করতে শেখায় ! এই সমঝতা নিজের সাথে, আবেগের সাথে, ভালবাসার সাথে, পরিবারের সাথে, প্রাপ্তির সাথে, পরিণতির সাথে ! আর এভাবে সমঝতা করতে করতে একসময় নিজেকেই হারিয়ে ফেলা। তখন আর আমাদের মাঝে থাকে না শুদ্ধতা আর মমতার ছিঁটেফোটা। রক্তমাংসের নিথর দেহটাই কেবল অবশিষ্ট থাকে।

বিশ্বাস কর, চেষ্টা করেও মানাতে পারি নি কাছের মানুষগুলোকে ! আমার অন্য সকল বিষয়ে তাদের ছাড় থাকলেও এই তোমার বিষয়ে পাই নি কোন ছাড়, পাই নি কোন বিশ্বাসের আশ্বাস !

একটা গান শুনেছ, ক’ফোঁটা চোখের জ্বল ফেলেছ যে তুমি, ভালবাসবে ? প্রিয় তরু, ৪ টি বছর হৃদয়ের অদৃশ্য রক্তক্ষরণ কি কম নয় ? প্রতীক্ষার ৪ টি বছর যে কতটা কষ্টের, কতটা যন্ত্রণার তা আমি বুঝি ! আবার এটাও জানি, তোমার ফিরে আসা হবে না। কারন, আমাদের গল্পতো হল- ক্ষয়ে যাওয়া ডানার প্রজাপতির গল্প, পালহীণ নৌকার গল্প, অতৃপ্ত এক আত্মার গল্প, বিষন্ন এক হৃদয়ের গল্প, চড়ূই পাখির দীর্ঘশ্বাসের গল্প, পরাজিত এক পথিকের গল্প, ম্লান সূর্যের গল্প, স্যাঁতস্যাঁতে শ্যাওলার গল্প, পঁচে যাওয়া কচুরিপানার গল্প।

তবুও একসময় আমরা সকলে স্বপ্নের কাছেই হেরে যাই; যেমনটি হেরে গেলাম আমি আজও ! ওই স্বপ্নের ডানায় ভর করে আজও বিড়বিড় করে তোমার গল্প বলি। দূরে কোথাও এ্যাকুইরিয়ামের দুটো গোল্ডফিস সেই গল্প শুনে মুখ তুলে চায়; কোথাও কোন চড়ূই পাখি টিউটিউ করে ডেকে ওঠে। ওরা যে আজও আমার বিষন্নতার বন্ধু !

লেখা শেষ করেই রিসাদ দেখে তার হাত কাঁপছে। হৃদয়টা বড্ড ভারী হয়ে গেছে। কেউ একজন একটু মমতা নিয়ে টোকা দিলেই সবকিছু আঁচড়ে বেরিয়ে আসবে।
চেয়ার থেকে উঠে রিসাদ জানালার রেলিং ধরে দাড়ায়।

মাঝরাত্রি পেরিয়েছে সেই কখন, তাই প্রকৃতি বেশ শান্ত। আকাশ খানিকটা মেঘলা হলেও চাঁদের জ্যোৎস্না ঠিকই মেঘের আড়াল থেকে উকি দিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। কি যেন মনে করে মোবাইলটা হাতে নেয়। এক এক করে তরুর সবকটি নাম্বারে কল দেয়।

প্রত্যেকটিই বন্ধ…ফেসবুকেও তাকে ব্লক করেছে। নেই, কোন উপায় নেই যোগাযোগের।
অবসাদ ছেয়ে যায় রিসাদের সমস্ত শরীরে।

সম্পর্ক, সম্পর্কের মায়াগুলো একটু একটু করে হালকা হয়ে যাচ্ছে। জীবন এগুচ্ছে কিন্তু পিছুটান বাড়ছে। সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে সামনে এগুনোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ !

নাহ ! অনেক হয়েছে। এভাবে জেগে থেকে লাভ নেই। রিসাদ বিছানার বালিশগুলো ঠিক করতে থাকে।

কি মনে করে যেন টেবিলের দিকে তাকায়। ফ্যানের বাতাসে তরুকে লেখা চিঠিটা উড়ে জানালা দিয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম।

রিসাদ তড়িঘরি করে ছুটে গিয়েও চিঠিটা ধরতে পারল না ! তাকিয়ে দেখে, নিথর ভাবে মাটিতে পড়ছে ওটা…। কেবলই কি চিঠিটা পড়ছে ? না।

রিসাদের স্মৃতি, স্বপ্ন, মমতা, না বলা কথা সবকিছু, সবকিছু পড়ছে ঐক্যতানে !