Monday, March 19, 2012

ক্ষমা নিয়েই বেঁচে থাকা…

উৎসর্গ…

জান্নাত-ই ফেরদৌস লিপু, প্রিয় লিপু আপা :আমার এই বোনটি কেবলই দুঃখকে জড়িয়ে বেঁচে থাকতে চায়!কেবল দুঃখকে জড়িয়ে বেঁচে থাকলে দুঃখেরও যে একটা সৌন্দর্য আছে, যেটা নষ্ট হয়ে যায়, সে বোঝে কি না, আমি জানি না। কিন্তু জানি, আজীবনই সে আমায় ভুল বুঝে গেছে !

তামান্না মুনতাকা, প্রিয় তামান্না :পরিচিত হয়েও এখন অপরিচিত একজন । কষ্ট নিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকতে হয় তা আমার চেনা,কিন্তু ক্ষমা নিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকতে হয় তাই এবার শেখার পালা।তবুও এই লেখাটা আপনার কাছে পৌছবে না আমি জানি ।




ফোনটা ধরলেই ওপাশ থেকে একটা গম্ভীর স্বর বলে, “ কইরে তুই” ?

আমি উত্তর দিই না। বরং মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকাই, কে ফোন করেছে লক্ষ্য করি। এবার মোবাইলটা কানে ঠেকাতেই শুনতে পাই, এক

পরিচিত মুখ হাসতে হাসতে বলছে,

“ভয় পেয়ো না।আমি নাসির। কোথায় আছ এখন ?

আমি এখন আলি’র ক্যান্টিনে খাচ্ছি।

তাহলে খাওয়া শেষ করে মেইন স্টেয়ার্স এর সামনে আস, দু’জনে একটু গল্প করি।

ওকে ঠিক আছে, আমি আসছি।



২০ মিনিট পর সিফাত আসে।সে দেখে নাসির মেইন স্টেয়ার্স এর সিঁড়িতে এক কোণায় বসে আছে। কাছে গিয়েই বলি, কি মন খারাপ নাকি বন্ধু ?

নাসির সিফাতের দিকে তাকিয়ে বলে, “ভালবাসা মানুষকে মহৎ করে। অথচ এই ভালবাসাই আমায় করেছে পদদলিত; মানুষের কাছে সন্দেহের পাত্র;দিয়েছে কষ্টের উৎস; আর আমায় করেছে নিঃসঙ্গতার সঙ্গী”।

ম্লান হাসি দিয়ে বলি,একবার গভীর ভাবে তাকাও নিজের দিকে, নিজের ফেলে আসা স্মৃতিগুলোর দিকে। যাপিত জীবনের কর্মকান্ডে কি কোনই ভুল ছিল না তোমার ?

ঠিক তখনই তুমি উত্তর পেয়ে যাবে। হাহাকারকে সঙ্গী করে তুমি একটু ক্ষমা’র জন্য পথচেয়ে থাকবে।

স্রষ্টা নারীদের অনেক মানসিক শক্তি দিয়ে পাঠিয়েছেন অনেক ক্ষেত্রে। আমার এক বান্ধবী ছিল হিয়া; একদিন হঠাৎ শুনি সে একটি ছেলেকে বিয়ে করেছে। আমাদের জানা মতে ছেলেটা খুব একটা ভাল ছিল না।

আমি ব্যগ্রকন্ঠে জিঞ্জেস করি, “এই ছেলেটিকেই কেন বিয়ে করলি”?

উত্তরে বলেছে, সে আমায় ভালো নাও বাসতে পারে তবে আমিতো তাকে ভালবাসি। সেটাই বড়। আমার লক্ষ্যই হলো ভালবাসা দিয়ে তাকে অন্ধকার জগত থেকে ইসলামের পথে, আলোর পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসা।

বিশ্বাস কর, এর কথা শুনে সেদিন চোখে পানি এসে গিয়েছিল।

সত্যিই নারীরা পারে ! নারীরা ভালবেসে ক্ষমা করতে শিখেছে জন্ম থেকেই। আমরা পুরুষরাতো কেবল ভোগ করি, কিন্তু ভোগান্তি হয় নারীর। নারীর নিঃস্বার্থ ভালবাসা আর মমতা কত পুরুষকে করেছে সত্য, কত বিপথীকে দিয়েছে পথের সন্ধান, কত হাহাকার সর্বস্ব মানুষকে দিয়েছে সুখময় ও দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ সম্পন্ন জীবনের আঁধার, কত মানুষকে অন্ধকার থেকে তুলে এনে দিয়েছে আলোর সন্ধান তা কেবল স্রষ্টাই জনেন !
নাসির কিছু বলে না, কেবলই মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে সিফাতের দিকে।

খানিকক্ষণ পর নাসির বলে, তোমায় বিষন্ন দেখাচ্ছে। কেন ?

না ঠিক বিষন্ন নই, একটু ক্ষমা পাবার আকাঙ্খায় দিন কাটাচ্ছি, এটুকুই যা।

তমাকে খুব ভালবেসেছিলাম কিন্তু তাকে নিজের কাছে সযত্নে রাখতে পারি নি। জানো, প্রতিটি ভালবাসারই একটা অন্ধ দিক থাকে যা কোন কিছুই বোঝে না, দেখে না। সেও ভালবাসার মোহে এমন কিছু কাজ করেছে যেগুলোকে ছাড় দিলে আমায় অস্তিত্ব হারাতে হবে; অপরদিকে তাকে প্রত্যাখান করলে আমায় হাহাকারকে সঙ্গী করে চলতে হবে।

নাসির বলে, অবশেষে তুমি অস্তিত্বকে বাঁচতে হাহাকারকে সঙ্গী করে নিলে ?

সিফাত বলে, আমার কাছে যে কোন উপায় ছিল না। হাতে অপশন একটাই ! ইদানিং মাঝে মাঝেই তার কথা খুব মনে পড়ে। কখনো তার সাথে আমি ভাল ব্যবহার করেছি বলে মনে পড়ে না। যখনই ফোন করেছে কোন না কোন কথা বলে ধমক দিয়েছি। যখনই দেখা করতে চেয়েছে, তখনই হাজারো কথা শুনিয়েছি। কখনো বা পাশাপাশি বসে আছি; সে ঝালমুড়ি কিনে আমায় এগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি সেগুলো না খেয়ে বলেছি, “তুমি কিনেছ তুমিই খাও”।

আমি নিশ্চিত জানি, সে অনেক কষ্ট পেয়েছে। চোখের জ্বলে বুক ভাসিয়েছে অনেক রাত।

তারপর ? তারপর কি হলো ? নাসির জিঞ্জেস করে।

কি আর হবে ! মধ্যবিত্ত পরিবারের কোন সন্তানের সেই ভালবাসার শেষ পরিণতি – বিচ্ছেদ !

বিচ্ছেদের আগে বলেছিল, “আমি আপনাকে যতটা ভালবাসি, আমি কোনদিন হাসানকে ততটা ভালবাসতে পারবো না। আর হাসান আমায় যতটা ভালবাসে আপনি কোনদিন আমায় ততটা ভালবাসতে পারেন নি”।

সেদিনের পর থেকে আমি অনুভব করেছি, আমি তমাকে কতটা ভালবাসি। এমন কোন রাত কাটে নি, যে রাতে জানালায় দাঁড়িয়ে আমি তমার কথা ভাবি নি ! তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, কাঁদিয়েছি; এ-সবের জন্য আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত।

আলতো করে নাসির সিফাতের কাঁধে হাত রেখে বলে, “অনুতপ্ত হলে সে ক্ষমা পেয়ে যায়, পায়ও। দ্বিতীয়বার ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না বন্ধু”।

হৃদয়ের সমস্ত বাতাস বের করে সিফাত বলে, কিন্তু আমি তার কাছে একবার ক্ষমা চাইতে চাই। একবার……… স্রেফ একবারের জন্য হলেও…….

কিছু কিছু মুহূর্ত আছে যখন কিছুই ভালো লাগে না। না ভাবতে, না বসে থাকতে। তখন আস্তে আস্তে দেয়ালের কাছে গিয়ে দেয়ালকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করি।

কিছুক্ষণ পর দেয়ালে আমার কপালটা ঠেকিয়ে দিই। অল্প অল্প টান্ডা অনুভূত হয়। ভালই লাগে। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পরই আমি হঠাৎ করে পাল্টে যাই। আর তখন কেবল দেয়ালে মাথা দিয়ে বাড়ি দিই আর বলি, “আমার কিছুই হয় নি। আমি ক্ষমা পেয়ে যাব, ক্ষমা পেয়ে যাব”।

মাঝে মাঝে নিজের রুমটাকে অসহ্য মনে হয়। তখন দৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে ব্যাডমিন্টন কোর্টে এসে দাঁড়াই। চোখ মেলে দিই তারা ভরা আকাশে। যতদূর চোখ যায়, মন যায়….

কিন্তু কিছুই ভাল লাগে না। মনে প্রশান্তি না থাকলে তারা ভরা আকাশও বড্ড বেশি বিরক্তিকর মনে হয়।

কিছু কিছু সময় মনে হয় কেউ একজন আলতো করে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁর গায়ের গন্ধ আমি অনুভব করি। তবুও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি আমি। শিরদাড়া বেয়ে প্রশান্তি নিচে নেমে যায়; আমার রক্তচলাচল কেবলই দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকে।বুকটা যে প্রচন্ড জোরে ধকধক করছে তা নিজেই অনুভব করছি ! কিন্তু সেই ধকধক শব্দকে ছাপিয়ে আমি শুনতে পাই, কেউ একজন পেছন থেকে আমার কানের কাছে এসে বলছে “সিফাত-তুমি কষ্ট পেয়ো না; আমি তোমায় কবেই ক্ষমা করে দিয়েছি ! তবুও তোমায় ভালবাসি আজও………”।

ঠিক তখনই প্রচন্ড আনন্দ নিয়ে আমি পেছনে তাকাই। দেখি, কেউ নেই ! একরাশ অন্ধকার বিদ্রুপ করে আর আমায় দেখে হাসে !

কোন কোন দিন প্রচন্ড মাথাব্যথা ওঠে। মাথার চুলগুলোকে কেবল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। তখন চুপচাপ নিজের রুমের ইজি চেয়ারে বসে থাকি। অপূর্ব সাজানো আকাশ, নতুন বউয়ের মত তার সারা মুখে নক্ষত্রের ফুটিফুটি আলপোনা; সাথে রূপালী রঙের চাঁদ। যেন নতুন বউয়ের মত কপালে ঠিক মাঝখানে লাল টাকটকে একটা টিপ দিয়েছে।

এভাবেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি। আর ঘুমের মধ্যেই স্বপ্নে দেখি, “আমি দেশে গিয়েছি। এয়ারপোর্টে আমার প্রিয় দুই ভাই সাকিব-আদিব আমায় নিতে

এসেছে। দেখা মাত্রই আমায় এসে জড়িয়ে ধরে তারা। খানিকক্ষণ পর, পাঁজর ভাঙ্গার মত একটি আওয়াজ কানে আসে।

আওয়াজটা কানে আসতেই সমস্ত শরীরটা দুলে ওঠে। অনন্তকাল ধরে অপেক্ষায় থাকা পথিক, কাঙ্খিত জিনিসটি পেলে আনন্দের সাথে যেমন একটা উৎকণ্ঠা অনুভব করে ঠিক সে রকম অবস্থা।

খুব ধীরে তমা ডেকেছে, সিফাত ?

বেশ কিছুটা সময় নিয়ে পেছন ফিরে তাকাই। তমা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে রজনীগন্ধা ফুল। কপালের ঠিক মাঝখানটায় ঠোট্ট একটা টিপ। আমার সবচেয়ে পছন্দের গাঢ় নীল রঙের একটি সুন্দর সালোয়ার-কামিজ পড়েছে; হাতে কাঁচের চূড়ী যা টুংটাং করে বাজছে। অপূর্ব লাগছে তাকে ! আমি কেবলই নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

তমা আলতো পায়ে আমার কাছে আসতেই একরাশ সংকোচ এসে ভর করে আমার মাঝে। পড়া না পারা ছাত্রের মত আমি মাথা নিচু করে থাকি।

তমা আমার দিকে ফুলগুলো বাড়িয়ে দিতেই আমি ফুলগুলো নিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখি।
তমা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি জানি। তবুও চোখতুলে তার দিকে তাকাতে বেশ লজ্জা লাগছে।

খানিকক্ষণ পর বলে, “তুমি তোমার কিছু কাজের জন্য মনে মনে অনুশোচনায় ভুগছিলে। সে জন্যেই আমি আজ তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি”।

অবাক হয়ে জিঞ্জেস করি, “তুমি জানলে কিভাবে” ?

উত্তরে তমা বলে, “অপেক্ষার প্রহরগুলো যে এমনই হয়। আর মেয়েদের বুকের ভেতর একটা গোপন যন্ত্র আছে, যেটা সবকিছু আগে থেকেই বুঝতে পারে। সে অনুশোচনার কষ্টও বুঝে !”

মাথা নিচু করেই সিফাত বলে, আমি তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছি, কাঁদিয়েছি। আমায় ক্ষমা করে দিও প্লিজ। শেষের লাইনটা বলতে সিফাতের কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে।

অনুতপ্ত হলে ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন নেই সিফাত, ক্ষমা পেয়ে যায়। তবুও বলি, আমি তোমায় অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি।

ভাল থেকো। নিজের যত্ন নিও………

একটা কবিতার কয়েকটা লাইন শুনাই তোমাকে :

“Things get easier

But will never with you !

I’ll cry less

But pain will still be there

The love we shared and gave each other

Will always remain in heart.”

তমা আলতো পায়ে চলে যেতে শুরু করে। হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে সিফাত কি যেন বলতে চায় কিন্তু বলতে পারে না।

কেবলই বিড়বিড় করে বলে, “তোমার সাথে আমার জীবনের গল্পটার শেষ অংশ বুঝি এটাই! হয়ত জীবনে আর কখনো তোমার
সাথে দেখা হবে না; বর্ণিল বিকেলে তোমার সাথে গল্প করা হবে না; অনাবিল উৎকন্ঠা নিয়ে তোমার পাশাপাশি হাঁটা হবে না; পড়ন্ত বিকেলে গোধূলী সময়ে সুর্যের লালচে আলো তোমার মুখে এসে পড়লে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে তোমার মায়াভরা মুখখানির দিকে তাকিয়ে থাকা কবে না………… হয়ত কোন দিন হবে না”।

এক-একটি রাত নীরবে কেটে যাবে আমাদের জীবন থেকে। অসংখ্য নক্ষত্ররাজিকে সাথী করে চলে যাবে মহাকাল, জানব না আমি, তেমনি তুমিও জানবে না !

বেঁচে থাকব কেবল……………….ক্ষমা নিয়ে !