উৎসর্গ…
মোঃ তৌফিক আরমান
আমার এই ভাইটা বেশ সরল।
বাইরের স্বার্থে ভরা পৃথিবীর অনেকটাই তার অজানা।
কোনদিন বলতে পারি নি, কত ভালবাসি তোকে…….
জানবি না……কোনদিন জানবি না……
আচ্ছা রাহুল ভাইয়া, চাচ্চু কতদূর ??? সেই গতকাল রাতে ঢাকা রওনা দিয়েছে, কিন্তু এখনো পৌছায় নি। একটু কল দিয়ে খবর নেন না প্লিজ…
তুইতো ঠিক-ই বলছিল। বাবা তো এখনো পৌছালো না !!!
সাথে সাথে মোবাইলটা হাতে নিয়ে রাহুল তার বাবাকে কল দেয়।
হ্যালো বাবা, আসসালামু আলাইকুম। কতদূর তুমি ? এখনো পৌছালা না !!!
এখন আমি সাভার পার হচ্ছি বাবা। আর হয়ত এক-দেড় ঘন্টার মধ্যে পৌছে যাব।
ফোন রাখার পর রাহুল কেমন যেন আনমোনা হয়ে যায়। বাসার ড্রইং রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। তার দুষ্টি যেন একজায়গায় স্থির হয়ে গেছে।
নীরব কখন যে তার পেছনে এসে দাড়িয়েছে সে টের-ই পায় নি। আলতো করে নীরব তার হাতখানা রাহুলের কাধেঁর উপর রাখে।
কী ভাবছেন ভাইয়া ??? বেশ ক্ষীণ কন্ঠে নীরব জিঞ্জেস করে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাহুল বলে, কিছু না রে…! বাবার কথা ভাবছি….
বয়স হয়েছে মানুষটার। তবুও সারারাত জার্নি করে ঢাকায় এসে, সারাদিন কাজ করে আবার রাতের কোচে বাড়ি ফেরে। কত কষ্ট হয়, তাই না রে …
ঠিক-ই বলেছেন ভাইয়া। চাচ্চুর বেশ কষ্ট হয়। তবে চাচ্চুকে থাকতে বললেও থাকে না। তিনি আবার রাতের কোচে চলে যায়।
বেশ করুণ স্বরে নীরব ডাকে, ভাইয়া …..!!!
বেশ ধীরে মাথা ঘুড়িয়ে রাহুল বলে, বল ।
চাচ্চুর শরীর বেশ খারাপ। কাউকে কিছু বলেন না। ডাক্তারও দেখাতে চায় না। তবে কিছুদিন আগে জোর করে ডাক্তার দেখানো হয়েছিল। আপনি কি জানেন, চাচ্চু অনেক গুলো ঔষধ খায় ? যতদূর শুনেছি তিনজন ডাক্তারের ঔষধ খেতে হয় তাকে।
রাহুল মাথা নিচু করে কথা গুলো শুনচ্ছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতার ঘরে প্রবেশ করছে। তবুও এই বাতাসকে রাহুলের বড্ড বেশি অসহ্য মনে হচ্ছে।
হঠাৎ একটুকরো বিষন্নতা এসে ঠাঁই নিল রাহুলের মনে। আর ধীরে ধীরে সেটা ছেয়ে গেল তার সমস্ত চেতনায়, সমস্ত অস্তিত্বে……
কিছু ভাল লাগছে না। সবকিছুর মধ্যেই যেন কিছুটা অসম ভাব আছে। কেবলই অন্তরের অন্তঃক্ষরণ এর মাঝে বাস করা।
এমন সময় রাহুলের মোবাইল বেজে ওঠে। তার বাবা ফোন করেছে।
দরজা খুলতেই রাহুল তার বাবার হাতের ব্যাগটা আর অন্যান্য জিনিসপত্র নিজের হাতে নেয়।
হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে এসে তিনি নাস্তা খাওয়া শুরু করেন।
বলেন, দুপুর হয়ে গেছে অথচ কিছুই খাই নি। খুব ক্ষিদে পেয়েছে।
রাহুল ক্ষীণ কন্ঠে তার বাবার জন্য হাফ কাপ চা বানাতে বলে। নাস্তা খাওয়া শেষ হলে রাহুলের বাবা সোফায় বসে চা খাওয়া শুরু করেন আর সিগারেট ধরান। আর আস্তে আস্তে গল্প জুড়ে দেন অনেকদিন পর দেশে ফেরা তার ছোট সন্তান রাহুলের সাথে। আর তার পাশে আছে তারই চাচাত ভাই নীরব।
অনেকক্ষণ গল্প করার পর রাহুলের বাবা, নীরব আর রাহুলের সাথে দুপুরের খাবার খেয়ে বাইরে বেড়িয়ে পড়েন কাজে। রাহুল আনমনে তাকিয়ে থাকে তার বাবার দিকে।
একজন মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে যান্ত্রিক শহরে তার পরিবারের জন্যে হালাল রিযিক উপার্জনের উদ্দেশ্যে। বয়সের ভার আর দায়িত্ববোধের চাপে তিনার ঘাড় একটু নুয়ে পড়লেও তিনি চলছেন তার মতই……সারাদিন রৌদ্রে বেড়ানোর জন্যে শ্যাম বর্ণের মানুষটির মুখ আরো একটু ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বয়সের কারনে চোখের চশমাটার পাওয়ার আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবুও নিজের সাধ্যমত তিনি পরিশ্রম করে যাচ্ছেন……….
একেই হয়ত বলে পিতা….. পিতার পিতৃত্ব…… কিংবা দায়িত্ববোধ ….
রাত প্রায় ১০.৪৫ বেজে গেছে ঘড়িতে, কিন্তু এখনও রাহুলের বাবা বাড়িতে ফেরেন নি। অবশেষে রাত ১১.১৫ এর দিকে তিনি বাসায় ফেরেন। বাসায় ফিরলেই, রাহুল বেশ যত্ন নিয়ে তার বাবাকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এগিয়ে দেন।
রাতের খাওয়া শেষ হলে রাহুলের বাবা সোফায় বসে সিগারেট ধরান।
রাহুল ধীর কন্ঠে বলেন, বাবা ! বয়স হচ্ছে। এখন একটু সিগারেট খাওয়াটা কমানো দরকার।
রাহুলের বাবা সাথে সাথেই বলেন, হ্যাঁ কমানো দরকার, জানি। তুমিতো বাসা আসছোই। তখন একটু একটু করে কমাবো ইনসাল্লাহ।
আমিতো বাবা মাত্র কয়েকদিন থাকবো। এর মাঝে কি কমাতে পারবে ???
হ্যাঁ পারব। তুমি বললে ঠিকই পারবো।
চল বাবা, তোমার ঔষধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তুমি ঘরে যাও আমি পানি নিয়ে আসছি।
রাহুলের বাবা ঘরে গিয়ে ব্যাগ থেকে ঔষধ বের করেন। রাহুল একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে বলে, এগুলো কিসের ঔষধ ???
এগুলো টাইফয়েড এর ঔষধ বাবা।
পরের প্যাকেটটা খুলতেই রাহুলের বাবা বলে, এগুলো দাতেঁর ব্যথার ঔষধ। এই প্যাকেটের ঔষধ খাওয়ার পর তিনি বলেন আরো ঔষধ আছে।
আরেকটা প্যাকেটের ঔষধ ফুড়ে তিনি হাতে নেন। রাহুল পানির গ্লাস টা তিনার দিকে এগিয়ে দেন। নিজের বাবা কতটা অসুস্থ হলে এতগুলো ঔষধ খেতে হয় তাই ভাবছে রাহুর। অজানা কারনে তার চোখের কোণায় পানি জমতে শুরু করেছে।
ঔষধ খাওয়া শেষ করে তার বাবা বিছানায় শুলে, রাহুল বলে, বাবা তোমার পা’গুলো কি আমি একটু চিপে দেব তাহলে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে পারবেন ???
না, না লাগবে না বাবা। আমি এমনিতেই ঘুমোতে পারব। তুমি কখন ঘুমাবা ???
আমি এখন গোসল করে এশার নামায পড়ব, তারপর ঘুমাব।
তারপর রাহুল গোসল সেরে এশার নামায আদায় করে। ড্রইং রুমে চারপাশে বেশ অন্ধকার। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। চারদিক কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগছে রাহুলের।
জানালা দিয়ে ক্ষীণ আলো ঘরে প্রবেশ করছে। রাহুল এই ক্ষীণ আলোর মাঝেই নিজের ছায়া দেখার চেষ্টা করছে। আজ রাহুলের নিজেকেই বড্ড বেশি অচেনা মনে হচ্ছে। চারদিকের অন্ধকার আর রাতের নিস্তবদ্ধতায় রাহুল কেঁপে ওঠে।
আকুল হৃদয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে আর তার চোখের কোণা দিয়ে গরম, দগ্ধ জ্বল গড়িয়ে পড়ে নীরবে। আকুল হৃদয়ে প্রার্থনা করে, আল্লাহ তুমিতো সবার মনের খবর জানো, সবার কষ্টের কথা গুলো জানো। তবে কি তুমি পারো না আমাদের সবার কষ্টগুলো একচিলতে দূর করে দিতে। তোমার কত ক্ষমতা !!! তুমিতো বলেছ, বান্দা আমাকে যেমন মনে করে আমি তার কাছে তেমনই।
আমি রিক্ত, নিঃস হাত তুলে তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, আমার বাবাকে তুমি সুস্থ করে দাও। আমার বাবাকে তুমি সুস্থ করে দাও প্রভু। আমাদের ভুল কৃতকর্মের জন্যে তুমি আমাদের এতবড় শাস্তি দিও না খোদা, দিও না……….
রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। কিন্তু রাহুল এখনো নামাযে দাড়িয়ে মুনাজাত করছে।
আর চোখের গরম জ্বল রাহুলের চিবুক বেয়ে একটু একটু করে গড়িয়ে পড়ছে রাতের নিস্তবদ্ধতায়…….