Tuesday, November 15, 2011

হৃদয়ের অন্তরালে

উৎসর্গ…
আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি, এই পৃথিবীতে যে কয়টি সত্যিকারের ভালো মানুষ দেখেছি তাদের মাঝে তিনিও একজন । সৎ, নির্ভেজাল, পরপোকারী, সদা হাস্যোজ্জ্বল, পিতা-মাতার একান্ত অনুগত এই মানুষটির মাঝে অহংকারবোধের ছিটেফোঁটাও নেই। বরং বিনয়ী মানুষটির ব্যবহার আমাদের মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেয় প্রতিনিয়ত।পদ-দলিত মানবতার এই ক্রান্তিলগ্নে এ রকম মানুষগুলোর বড্ড বেশি প্রয়োজন।
প্রিয় অমিও ভাইয়া, ডাঃ অমিও, মিনহাজ রশীদ ভুঁইয়া (অমিও)
আমি প্রতিদিন প্রার্থনা করি, স্রষ্টা যেন আমায় আপনার মত একজন মানুষ হওয়ার সার্মথ্য দান করেন।


বিকেল হলেই তমা’র মাঝে অজানা এক উৎকন্ঠা কাজ করে। তখন সে কোথাও স্থির হয়ে থাকতে পারে না। সারা ঘরে কেবল হাঁটাহাঁটি করে।মাঝে মাঝে কোথাও দাঁড়িয়ে আনমনে ভাবতে শুরু করে দেয়। প্রয়োজনীয় নয়, হাবিজাবি সব ভাবনা।
এভাবে এলোমেলো ভাবে হাঁটতে হাঁটতে সে রকিবের রুমের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।
রকিবের রুমের বারান্দাটা বেশ বড়। এর এক-কোণায় দুটো চড়ূই পাখি সংসার বেঁধেছে। তমা বারান্দায় গেলেই তাদের সংসার দেখে, তাদের সাথে আলোছায়ার কথা বলে।
আরো আছে বেশ কিছু ফুলের গাছ। নীলকন্ঠ ফুলের গাছটি তমার বেশপ্রিয়। বারান্দায় আসলেই তমা বেশ খানিকটা সময় প্রগাঢ় মমতা দিয়ে নীলকন্ঠ গাছটিকে ছুঁয়ে দেয়। দূর থেকে দেখলে আপনার মনেই হবে, কোন মমতাময়ী যেন তার মমতার পরশ বিলিয়ে দিচ্ছে গাছটিকে। আরো আছে দোলনচাঁপা। এই ফুলটির প্রতি তমার আগ্রহ একটু বেশিই বটে।
তমার মা একদিন এই ফুলের গাছটিকে ফেলে দিতে চেয়েছিল। সেই কথা শুনে তো তমা একেবারে রাগে-ক্ষোভে অস্থির। কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিল। এমনকি একদিন না খেয়ে ছিল মায়ের উপর অভিমান করে !!!
প্রায় সন্ধ্যে হয়ে আসছে। অথচ রকিব এখনো বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। তমা গিয়ে রকিবের মাথার চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডাকে, রকিব -ভাইয়া। উঠ না…… সন্ধ্যে হয়ে এল রে….. নামায পড়বি না ????
আরেকটু ঘুমিয়ে নিই আপু…. এখন যা তো, জালাস না খালিখালি…..।
রকিবের ঘরের একেবারের সামনের ফ্ল্যাটের ওই ঘরটায় থাকে সৌম্য।
কিছুদিন ধরেই সৌম্য লক্ষ্য করছে, বিকেল হলেই তাদের সামনের ফ্ল্যাটের বারান্দায় একটি মেয়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। বারান্দার গ্রিল ধরে মুগ্ধ-দৃষ্টিতে নীল আকাশের জোড়া-জোড়া মেঘরাশির দিকে তাকিয়ে থাকে। কখনো-বা বারান্দার কোণায় বাসা বাঁধা চড়ূই পাখি দুটিকে গান শোনায় :
“দীবশ রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি। তাই চমকিত মন
চকিত শ্রবণ, তৃষিত আকুল আঁখি….”
এমন-কি খুব মমতা দিয়ে বারান্দার ফুলের গাছগুলোকে আদর করে দেয়। যেন তাদেরকে মায়ের মত আদর করছে।
সৌম্য বেশ আরো লক্ষ্য করে, মেয়েটি দেখতে খুব সাধারণ। ওড়না গায়ে জড়ানোর ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায়, সে ভদ্র ও নম্রও। কিন্তু মেয়েটি এই ভর-বিকেলে চোখে সানগ্লাস পড়েছে ……..!!!!!

মাথায় কোন একটা বিষয় একবার গেঁথে গেলেই হলো। তখন ওই বিষয়টিকে নিয়ে সৌম্য’র আর চিন্তার শেষ থাকে না। মেয়েটি কেন বিকেল বেলা সানগ্লাস পড়ে ছিল এই নিয়ে যতগুলো যুক্তি থাকতে পারে প্রায় তার সবগুলো নিয়েই সৌম্য ভেবেছে কিন্তু কোনটিই তার মনে ধরে নি।
অবশেষে সে সিন্ধান্ত নিয়েছে, মেয়েটিকে নিজেই জিঞ্জেস করবে…….।
আজ তমার মন ভাল নেই। তাই সে আজ অনেক আগেই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। যেদিন তমার মন খারাপ থাকে, সেদিন সে বারান্দায় দীর্ঘ সময় কাটায়। গ্রিল ধরে কেবলই আকাশের সারিসারি মেঘরাশির দিকে তাকিয়ে থাকে আর বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়ায়।
তমাদের ফ্ল্যাটে আগেও অনেক রকম ভাড়াটে এসেছে। নতুন অনেক মেয়েই এসে দাঁড়াত কিন্তু তাদের কেউই মন কাড়তে পারে নি। এই মেয়েটিকে একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে।
মাথার চুলগুলো তমার চোখের সামনে এসে পড়ায় তার মুখের একটা পাশ দেখা যাচ্ছে না, তবুও সে চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছে না।
সৌম্য’র খুব ইচ্ছে করছে তমার সাথে কথা বলতে। রহস্য উদঘাটন করতে তার মন ব্যাকুল হয়ে আছে।
অবশেষে লজ্জা,সংকোচ বিসর্জন দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সৌম্য।
তমা এখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আনমনে।
বেশ নরম সুরে সৌম্য জিঞ্জেস করে, আজ কি আপনার মন খারাপ ?
কেমন যেন চমকে ওঠে তমা ! পরে সৌম্য’র দিকে তাকালেই সৌম্য একা ম্লান হাসি দেয়। সাথে সাথেই মাথা নিচু করে ফেলে তমা।
প্রায় প্রতিদিন আপনি নির্দিষ্ট সময়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ান। তারপর অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে। মনে হয় আপনি কি যেন খোঁজেন ???
ঠিক বলেছেন আপনি। আমি তাকিয়ে থাকি তবে কিছু খুঁজি না।
আমি তাকিয়ে স্রষ্টার নিপুণ কারিগরের মত তৈরি করা নীল আকাশ দেখি আর ভাবি, আমার মনটাও যদি আকাশের মত বিশাল হত ! আমি বর্ণিল প্রজাপতির উড়ে বেড়ানো দেখি। যার সৌন্দর্য মানুষের মুখে অতি সহজেই আনন্দের হাসি এনে দেয়। ঠিক তখনই আমি ভাবি, ইস ! এভাবে যদি আমিও মানুষকে আনন্দ দিতে পারতাম !!! আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়া দেখি। এই বৃষ্টি হল স্রষ্টার রহমত। আমি হাত বাড়িয়ে সেই বৃষ্টির জ্বলে আমার হাত ভেজাই। আর ভাবি, স্রষ্টার রহমত যদি আমার জীবনটাকেও একটু পাল্টে দিত…………….
কথাগুলো শেষ করেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তমা।
সৌম্য এতক্ষণ পর্যন্ত কথাগুলো তন্ময় হয়ে শুনছিল। একটু একটু করে আরো মুগ্ধ হয়ে যায় সে।
পরের দিন সৌম্য তমার আসার আগেই বারান্দায় এসে দাড়ায়। দু’হাত দিয়ে গ্রিল ধরে তমার কথাগুলো ভাবতে থাকে।
আড়মোরা ভেঙ্গে হঠাৎ লক্ষ্য করে তমা বারান্দায় এসে নীলকন্ঠ ফুলের গাছটিকে আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর খুব ধীরে গ্রিলটা ধরে ডাকে, তমা ?
ঠিক তখনই গাছটিতে হাত বুলাতে বুলাতে তমা জিঞ্জেস করে, কি ভাবলেন এতক্ষণ ???
কথাটা শুনেই লজ্জা পেয়ে যায় সৌম্য।
মাথা নিচু করে ফেলে আর বলে, কই ! কিছু নাতো ।
মুচকি হেসে তমা বলে, নারীর মন সবই বোঝে, কিছু ঘটে যাওয়ার আগেই। টের পেয়ে যায় কে তার দিকে কোন দৃষ্টিতে তাঁকায় ? বুঝে যায় তাকিয়ে থাকা মানুষটির চোখের ভাষা । কারন, স্রষ্টা মেয়েদের পৃথিবীতে পাঠানোর সময় এই ক্ষমতাটা দিয়ে দেন।
কি বুঝেছেন ? ছোট্ট করে সৌম্য বলে, হ্যাঁ বুঝেছি।

এভাবে প্রায় প্রতিদিন সৌম্য আর তমা বারান্দায় দাড়িয়ে কথা বলে। নিজেদের স্বপ্ন, ভাললাগা-মন্দলাগা সবকিছু শেয়ার করে। বিশ্বাসের জায়গাটা একটু একটু করে পোক্ত হতে থাকে।
সৌম্য জিঞ্জেস করে, আচ্ছা আপনার কোন ইচ্ছেটা প্রতিনিয়তই করে ???
তমা ঠিক তখনই মুগ্ধ চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, আমার পাখি হতে খুব ইচ্ছে করে। পাখিদের বেড়ানোর কোন সীমানা নেই, বাঁধা নেই। যেদিকে ইচ্ছে যেতে পারে, যাকে ইচ্ছে সঙ্গী করে নিতে পারে। যেখানে ইচ্ছে সেখানে গিয়ে স্রষ্টার সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারে।
আচ্ছা, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপর কি বলেন তো ???
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আমাদের মন সবসময় কিছু না কিছুর জন্য অপেক্ষা করে যায়। এই অপেক্ষার কোন অন্ত হয় না।
আমাদের দেশে অনেক শিল্পপতি আছে, যারা একটু অসুস্থ হলেই কোটি কোটি টাকা খরচ করে। অথচ আমরা কিন্তু দিব্যি ভালো আছি।
ঠিক কতদিন বেঁচে থাকার ইচ্ছে আপনার ???
তমা বলে, ঠিক ততদিন যতদিন না পর্যন্ত আমি মঙ্গলগ্রহ আর চাঁদের দেশে ভ্রমণ করতে পরছি; যতদিন না পর্যন্ত প্রতিটি মানুষ অপর মানুষের হৃদয়ে পৌছতে পারছে; যতদিন না পর্যন্ত পৃথিবীর সকল সৌন্দর্যকে আমি আমার চোখের ক্যামেরায় বন্দী করবো, ঠিক ততদিন পর্যন্ত।
কথা বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে আসে তমার। গম্ভীর হয়ে বলে, কিন্তু এই পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য আমার কখনোই দেখা হবে না, আমি জানি।
সৌম্য জিঞ্জেস করে, এমন গম্ভীর স্বরে কেন বলছেন ???
মানুষ যে তার ব্যর্থতার কথাগুলো গম্ভীর হয়েই বলে !
এই পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা আ্যাকুইরিয়ামের মাছের মত, যাদের পৃথিবীটা খুব ছোট। আর এভাবেই তাদের স্বপ্নগুলো ঐ ছোট জায়গার মধ্যে একটু একটু করে ছোট হয়ে আসে। প্রাণ-রস বিহীন জীবে পরিণত হতে হতে একসময় তারাও নিঃশেষ হয়ে যায়। আমিও তাদেরই দলে……..।
পরিবেশটা কেমন যেন গুমোট বেঁধে আছে।নিস্তব্ধ নিরবতা কেবলই।
হাসি হাসি মুখে সৌম্য জিঞ্জেস করে, শরতের বিকেলে রূপবতী কোন নারীর সাথে কথা বলার আনন্দটা সীমাহীণ। অনেকে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলে। আমারও একটা আছে।
কিন্তু মানুষ চাইলেই কি তার সবকথা বলতে পারে বলুন ??? হারানোর কি একটা ভয় থাকে না ?
না, পারে না। তমা নরম সুরে বলে, মানুষ হয়ে জন্মানোর এই এক-সমস্যা। “ যা বলতে মন চায়, ঠোঁট তাতে সব সময় সায় দেয় না”।
আগামীকাল আমার একটা দিন। আমি আপনাকে একটা কথা বলবো।
কথাটা বলেই ঝট করে সৌম্য তার ঘরে চলে যায়।
হাত বাড়িয়ে তমা সৌম্যকে ডাকতে যায় কিন্তু পারে না।
মনে মনে বলে, আমারও আপনাকে কিছু বলার ছিল কিন্তু…….।
দীর্ঘম্বাস ছাড়ে তমা। আজকের বিকেলটা কেন যেন বড্ড বেশি অসহনীয় মনে হচ্ছে তার কাছে।
পরের দিন বেশ আগেভাগেই সৌম্য বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ তার বিশেষ দিন। আজ সে তার মনের কথা বলবে। প্রতিটি পুরুষই যেদিন তার প্রিয় মানুষটিকে মনের কথা বলে সেদিন তার বুক ধক্ ধক্ করতে থাকে। মনের মাঝে কেমন যেন একটা উৎকন্ঠা কাজ করে। অস্থির লাগে আবার একটু খুশি খুশিও অনুভব হয়। মিশ্র একটা অনুভূতি।
সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হয়ে যায় কিন্তু তমা বারান্দায় আসে না। এমনকি রকিবের ঘরের দরজাও বন্ধ থাকে।
এভাবে প্রতিদিন সৌম্য তমার জন্য অপেক্ষা করে।
সৌম্যর মা বারান্দায় এসে দাঁড়ান। আলতো করে ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন, সমুদ্রের যেমন একটা শেষ আছে; জীবনের যেমন একটা শেষ আছে; তেমনি কিন্তু অপেক্ষারও একটা শেষ আছে। এটা তোকে মেনে নিতেই হবে……।
মনে মনে সৌম্য বলে, শূন্য বারান্দা দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত প্রভু। এবার আমি একটু মানুষ দেখতে চাই। সেই মানুষটিকে যে কিনা অপার মমতা নিয়ে ফুলের গাছগুলোতে হাতবুলিয়ে দিত।
শূন্য বারান্দায় ফুলের গাছগুলোর অবহেলায় পড়ে থাকা।
কী নিদারুণ এই একাকীত্ব, প্রিয় মানুষটির জন্য অপেক্ষা, আর ?
ঝাপসা চোখে কেবল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ।
একমাস পরে সৌম্যর নামে একটা চিঠি আসে। ঘুম থেকে ওঠেই সৌম্য দেখে তার বালিশের পাশে একটি খাম আছে।
বেশ অবাক হয় সে। ভাবে, এ পৃথিবীতে এমন কে আছে যে তাকে চিঠি লিখতে পারে !!!!
সাথে সাথেই একরাশ আগ্রহ নিয়ে সে খামটা খুলে চিঠি বের করে পড়তে শুরু করে…

একাকীত্বে থেমে যাওয়া জীবনকে সচল করার জন্য মানুষ কত কি-ই না করে, কিন্তু আমি ? আমি এই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতাম, সময় কাটাতাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে সৌন্দর্য অবলোকনের সাথে সাথে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করতাম।আপনি একদিন বলেছিলেন, আমাদের মন প্রতিনিয়তই কিছু না কিছুর জন্য অপেক্ষা করে যায়। তেমনি আমিও অপেক্ষা করেছি, কঠিন একটি বাস্তবের। কবে আসবে আমার জীবনে ! কারন, সেই বাস্তবতাটির কথা মাথায় রেখেই যে আমায় বেঁচে থাকতে হয়।
ক্রমেই ছোট হয়ে আসা আমার পৃথিবীতে, আনন্দের বার্তা নিয়ে এসেছিলেন আপনি।কত চমৎকার মুহূর্ত কাটিয়েছি আমি আপনার সাথে ! মনের কথা বলেছি, স্বপ্ন বুনেছি, এমনকি কখনো ছেলেমেয়ের অধিকার নিয়ে ঝগড়াও করেছি ! আপনার নির্ভেজাল এই বন্ধুত্বের বন্ধনের কথা আমি কখনো ভুলবো না, কখনো না ।
আপনি আমায় সেদিন কি বলতে চেয়েছিলেন, আমি জানি। বুঝতে পেরেছি অনেক আগেই।আপনার কথাও যেমন শুনা হয় নি তেমনি আমার কথাও বলা হয় নি !আমি জানি, আপনার মনে প্রায়ই একটা প্রশ্ন জাগত, আমি কেন সবসময় সানগ্লাস পড়ে থাকি? মূলত এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যেই প্রথম আপনি আমার সাথে কথা বলেন। আপনি অনেক দিন জিঞ্জেস করতে গিয়েও শেষে জিঞ্জেস করতে পারেন নি। অথচ আপনি জানেন না, আমার জীবনের চরম সত্যটা ওখানেই লুকিয়ে আছে। আমার গ্লুকোমা আছে।ক্রমে ক্রমে আমার দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে,সাথে আমার পৃথিবীও। যেদিন আপনার সাথে আমার শেষ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা হয়েছিল, ঠিক সেই দিন রাতে বাবা আমায় নিয়ে লন্ডন চলে যান শেষ বারের মত আমার চোখদুটি ভালো করার ব্যর্থ চেষ্টায়। কিন্তু সপ্তম আসমানের ওপাড়ে যা আগেই লিখিত হয়ে গিয়েছে তা কিভাবে বদলানো যায় বলুন ? যা হবার তাই হলো। এখন আমার সবকিছুই অন্ধকার। এমন এক মানুষ যার কাছে আলো-অন্ধকার, এমনকি পৃথিবীর সৌন্দর্য সব একই রকম- কালো…… একদম কালো।
আমরা মানুষেরা বড়ই অদ্ভুত। সারাজীবন স্বপ্ন দেখে যাই একরকম আর আমাদের জীবনে ঘটে যায় অন্যরকম। ছেঁড়া ছেঁড়া পুঁথির মালার মত কখন রাত গড়িয়ে সকাল হয়; আবার দিন গড়িয়ে রাত হয় আমি টেরই পাই না।
তবুও…….তবুও বেঁচে থাকা।
ইতি
আপনার অতি সাধারণ বন্ধু-তমা


চিঠিটা পড়া শেষ হলেই সৌম্যর সমস্ত অস্তিত্ব দুলে ওঠে। বুকের ভেতর থেকে সবকিছু ঝড়ের বেগে বেড়িয়ে আসতে চায়।
না,কেউ ছিল না আমার, কখনো না। কোনদিনও ছিল না।
চোখদুটি ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসে। সবকিছু, আশে পাশের সবকিছুই বিবর্ণ, স্থির।
এভাবেই হয়ত মানুষ মানুষকে আশ্রয়হীণ, অবলম্বনহীণ করে চলে যায়।
চোখ বন্ধ করে চিঠিটাকে দু-হাত দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে বলে,
“ একবার ভালবেসে দেখ, আমি হারাব না…
শুধু একবার হাতটা ধরে দেখ,কখনোই ছেড়ে যেতে দিব না…
বরং দেখবে তুমি জগতটাকে, আমার দৃষ্টিসীমার মাঝে
আমার সাথে…… আমার হাত ধরে…………”।