Tuesday, August 12, 2014

স্পর্শের বাইরে…


উ।ৎ।স।র্গ

কোনদিন দেখা হয় নি মানুষটির সাথে, ফেসবুকে পরিচয়। তবুও অল্প দিনেই তার শব্দ চয়ন, বাক্যবুনন আর অনুভূতির প্রকাশ আমায় মুগ্ধ করেছে।
আর মুগ্ধ করতে পারার আতিশায্যে তিনি হয়ে উঠেছেন আরো বিনয়ী। একদিন কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন, “উপলব্ধিতা আর আকুলতার
এই পরশই বারে বার আপনাকে তার শুদ্ধ অনুভূতির জানান দেবে। ঘুণেধরা কি না জানি না, আপনি পরাজিত নন।
কেননা পরাজয় কেবল তা মেনে নিলেই আসে, অন্যথায় নয়। যে অনুভূতির তীব্রতাকে এলো করতে জানে, সে অতটা দূর্বল কখনোই নয়।
আপনার অনুপ্রেরণা আমাদের জন্য আনন্দের”। এই কথা পড়ে সাথে সাথেই শ্রদ্ধায় কুঁকড়ে গেছি !

প্রিয় মাহবুব ভাইয়া; প্রিয় মাহবুবুল আলম

কোন এক বর্ষাস্নাত বিকেলে আপনার সাথে আড্ডা দেওয়ার স্বপ্ন দেখি…
হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার প্রককালে প্রশ্ন করব, ভাইয়া- অস্তিত্বের দহন কথাটির অর্থ কি বলতে পারেন ?




টুং করে শব্দ হলো। ফেসবুকে নোটিফিকেশনের শব্দ। রিসাদ চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে গল্পের বই পড়ছে। শব্দ শুনেই ল্যাপটপের দিকে তাকাল।
একজন দুটি ছবি শেয়ার দিয়েছে। প্রথম ছবিটায় কেবলমাত্র একজোড়া পায়ের ছবি। প্রথমে খুব স্বাভাবিক মনে হল রিসাদের।
কই বিশেষ কিছুতো নেই। তারপর একটু গভীরভাবে তাকাল। মেয়ে মানুষের পা। যত্ন করে নেলপালিস দিয়েছে, আলতা পড়েছে।
রিসাদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে আলতো করে হাসি দিল। তারপর দ্বিতীয় ছবিটায় ক্লিক করল।

দুটো মানুষ হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে; তাদের ছায়ার ছবি। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, প্রিয়তীর হাতে ঝুলছে চুড়ী।

ছো্ট্ট একটা লাইক দিয়ে রিসাদ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ ঐ ছায়া জড়ানো ছবিটার কথা ভাবতে লাগল। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, ৪ বছর আগের কথা …

টিএসসির সামনে বসে আছে রিসাদ। অপেক্ষা করছে তরুর জন্য। আসার কথা ছিল বিকেল ৫টার দিকে। এখন ঘড়িতে বাজে বিকাল ৫টা ২৫ মিনিট তবুও তার আসা হল না ! রিসাদ খানিকটা বিরক্ত। হঠাৎ এক বাদামওয়ালা এসে বলে, মামা দিব নাকি ৫টাকার বাদাম ?
উত্তরে রিসাদ বলে, না মামা। তোমার মামী আসুক তখন দিও।

বাদামওয়ালা আবারও প্রশ্ন করে, ক্যান মামা, অহন লন, তখনও নিবেন।

বিরক্তির ভঙ্গিতে রিসাদ বলে, তোমার মামী আসুক তখন দিও। একসাথে ১৫ টাকার দিও। ৫ টাকার আমি খাব, ৫ টাকার খাবে তোমার মামী আর বাকি ৫ টাকার বাদাম তুমি খাবে। ঠিক আছে মামা ?

বাদামওয়ালা কিছু বলে না। কয়েক সেকেন্ড ভ্রু-কুচকিয়ে তাকিয়ে থেকে চলে গেল। যেতে যেতে বলতে লাগল, এই বাদাম হবে বাদাম…মচমচা, টাটকা বাদাম…

অবশেষে ৫টা ৩৫ মিনিটে তরু এল। সে জানে, রিসাদ খানিকটা বিরক্ত। আর তাই ঠোঁটের কোণে সর্বদা একটা হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হবে তাকে,
তাহলে রিসাদ আর কোন অভিযোগ করতে পারবে না, রাগ করতে পারবে না।
সামনে এসে দাঁড়িয়ে তরু তাই করল। সে আজ লাল রঙের সালোয়ার-কামিজ পড়েছে। বরাবরের মত হাতে কাঁচের চূড়ী পড়েছে তবে একটাই পরিবর্তন।
আজ সে কপালে টিপ দেয় নি, চোখে কাজল পড়ে নি।
খুব ভাল ভাবে লক্ষ্য করে রিসাদ। না, এই ড্রেসেও তাকে খুব চমৎকার লাগছে, মায়াবী লাগছে। খানিকটা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে রিসাদ।

সদ্য বিশ পেরুনো এই মেয়েটির ভ্রুর নিচে চঞ্চল চোখ আর বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠা অবিন্যস্ত চুল… অন্যরকম মায়াবী লাগছে। সে পায়ে হেঁটে নয়, রথে চড়ে এখানে এসেছে !

ঠোঁটে মুগ্ধ করা হাসি, দোলন চাপার গন্ধে ভেসে যাওয়া বাতাস আর হঠাৎ হঠাৎ লজ্জায় প্রেয়সীর চোখ নামিয়ে নেওয়া- সবমিলিয়ে নিথর দেহটা রিসাদের কেঁপে ওঠে, তার অস্তিত্ব জানিয়ে দেয়, এইত- এইত কাঙ্খিত মানুষটি।

মুচকি হেসে জিঞ্জেস করে, তুমি কি শ্যামল ছায়া ?

চোখ নামিয়ে তরু পড়া না পারা ছাত্রীর মত বলে, জানি না। তবে তুমি ভালবাস বলেই আমার ছায়া আজ শ্যামল হয়েছে, হয়েছে আবেশী।

তরু জিঞ্জেস করে, কখন এসেছ ?

এইত। খুব বেশি না, মাত্র ৫০ মিনিট আগে !
কথাটা শুনেই তরু জিহ্বায় কামড় দেয়। সর্যিল, অনেকক্ষণ দাড়িয়ে রেখেছি !

খানিকক্ষণ পর রিসাদ বলে, আজ কিন্তু তোমার তাড়াতাড়ি ছুটি নেই।

কেন ? এতক্ষণ কি করব ? স্বাভাবিক ভাবে জিঞ্জেস করে তরু।

রিক্সায় চড়ে ঘুরব, যা ইচ্ছে তাই করব। রাতের ঢাকা দেখব। গাড়ির হর্ণ শুনব, মানুষের ছুটোছুটি দেখব, অজানা পথিকের ঘরে ফেরার গান শুনব, পিচঢালা রাস্তায় নগ্ন পায়ে হাঁটব।
ছোট্ট করে তরু বলে, তাই ?
হুম তাই, একদম তাই, ঠিক তাই।

চল এবার মধুর ক্যান্টিনের দিকে যাই, ওখানে গিয়ে গল্প করি।

রিসাদ আর তরু মধুর ক্যান্টিনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। আচ্ছা এভাবে কতক্ষণ হাঁটতে পারবা তুমি আমার পাশে ? প্রশ্নটা করেই তরু রিসাদের দিকে তাকায়।
বিশ্বাসী সুরে রিসাদ উত্তর দেয়, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি ক্লান্ত না হও।
ভালবাসার এই হাঁটায়তো ক্লান্তি নেই, নেই কোন তাড়া। বরং আছে তৃপ্তি !
হাঁটতে হাঁটতে রিসাদের ডান হাতটা আলতো করে তরুর বাম হাতের সাথে স্পর্শ লাগে। সাথে সাথেই লজ্জা পেয়ে যায় তরু।

খানিকক্ষণ পর তরু বলে, তৃপ্তিটা কিসের জান ?

নিজে প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দেয়।পথ পেরুনোর তৃপ্তি, হৃদয় দিয়ে অন্য হৃদয় ছুঁয়ে দেওয়ার তৃপ্তি, চোখের পাতায় একমুঠো স্বপ্ন বুনে দেওয়ার তৃপ্তি। …


অনেকদিন পর পুরনো স্মৃতির কথা পড়ে গেল রিসাদের। ঠিক তেমনি আড়াই বছর আগের কথা-

একদিন হঠাৎ তরুর ইচ্ছে হল, নগ্ন পায়ে সোডিয়াম বাতির নিচে হাঁটবে। যেই ইচ্ছা সেই কাজ। অনেককষ্টে রিসাদকে রাজি করিয়ে দুজনে রিক্সায় করে শাহবাগ আসে।
ঘড়িতে বাজে তখন রাত সাড়ে নয়টা। শাহবাগ তখনও পূর্ণরূপে প্রাণবন্ত। দেড়শ ফিট রাস্তার দু’পাশই গাড়ি দিয়ে গিজগিজ করছে।

রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে তরু রিসাদকে বলে, কোন কথা হবে না কেবল হাঁটব। নীরবতায় হবে ভাবের সকল আদান-প্রদান।

পায়ের স্যান্ডল গুলো হাতে নিয়ে তরু ধীর পায়ে টিএসসির দিকে হাঁটা শুরু করল। এই দেখে মুচকি হেঁসে রিসাদ বলে, পাগল মেয়ে…।

পায়ের স্যান্ডলগুলো হাতে নিয়ে সেও তুরুর পাশাপাশি হাঁটছে। সোডিয়াম বাতির আলোয় আলোকিত রাস্তায় দুটি মানুষ নগ্ন পায়ে হেঁটে চলছে।
পাশে দিয়ে শতশত রিক্সা আর কখনো কখনো ৪/৫টি গাড়ি যাচ্ছে-আসতেছে। রিসাদ আর তরু হাঁটছে তাদের মতই, আনন্দ নিয়ে।
তরু অনুভব করে, শান্ত লাগছে, বেশ শান্ত লাগছে।

রিসাদের বাম হাতটা আলতো করে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে সে।

অন্ধ, অবিকল অন্ধ মেয়ের মত হাঁটছে। সে জানে রিসাদ তার হাত ধরে আছে- বিশ্বাসী বন্ধুর মত, সাহসী পথ-নির্দেশকের মত, প্রেমিকের মায়ায়, জীবনের পূর্ণতার আকাঙ্খায়।…
বিছানায় শুয়ে আছে রিসাদ। শুয়ে শুয়েই পুরনো স্মৃতিগুলো মনে করছে। না, কেমন যেন অস্থির লাগছে। কেমন যেন একটা গুমোট পরিবেশ, অনেকটা দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম।
টেবিল থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে সে তার মাকে কল দেয়।

হ্যালো মা, কেমন আছ ?
ভাল বাবা। তোর খবর কি ?
ভালই আছি। কি রে ? তোর কণ্ঠ ভারী লাগছে কেন ?

তেমন কিছু না মা। আচ্ছা বাবা কই ?
কই আবার ! এলাকার নেতাদের নিয়ে ড্রইং রুমে মিটিং করছে আর খানিকক্ষণ পর পর বলছে, চা পাঠাও।

মা একটা প্রশ্ন করি ? সাবলীল ভাবে রিসাদের মা বলে, হ্যাঁ কর।

সমাজসেবা ভাল কাজ যদি সেটা হয় পূর্ণ সততায়। কিন্তু কি জান মা, প্রতিটি মানুষের জীবনেই কিছু অপূর্ণতা থাকে। বাবা কি পারবে সে অপূর্ণতাগুলো পূরণ করতে ?
আগামীতে কি এগুলো বাড়বে না ?

খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর রিসাদের মা বলে, জানি না। বলেই ফোনটা কেটে দেয়।

শূন্যমনে রিসাদ নিজেকে প্রশ্ন করে, কেন এই ছুটোছুটি ? কেন বাস্তবতার মোড়কে আমাদের সাবলীলতার সাথে, সৃজনশীলতার সাথে সমঝতা করতে হয় ? কেন ?

গভীরভাবে চিন্তা করে রিসাদ…কোন উত্তর আসে না ! জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি মেলে দেয়। কি যেন একটা পোকা চিকচিক করে ডাকছে। বাইরের আবহাওয়া বেশ শান্ত মনে হচ্ছে।
কর্মচাঞ্চল্য যেন একটু বিশ্রাম নিয়েছে।

কখনো কখনো এমন হয়, হৃদয়টা আবেশে পূর্ণ থাকলেও মাথায় কিছুই আসে না। তখন কোন কিছু করতেই ভাল লাগে না।
না শুয়ে থাকতে, না কথা বলতে ,না স্বপ্ন দেখতে ! রিসাদের ঠিক তেমনি লাগছে।

বিছানা থেকে উঠে টেবিলের সামনে গিয়ে বসে। ফেসবুকে নিজের প্রোফাইলে গেলেই লক্ষ্য করে একজন কমেন্ট করেছে, “ নিয়মিত বাস্তবতার দোলাচলে ক্ষয়ে যাওয়া এই আমরা নিজেকে খুঁজে পাইকবিতার মাঝে... সাথে সাথে এ্যাকুইরিয়ামের মাছের মত টুই করে ওঠে আমাদের বোধগুলো...চোঁখ তুলে তাকায় হৃদয়ের দেয়ালে জন্মানো শ্যাওলাগুলো...হয়ে যাই আমরা কবিতার ওই শব্দগুলোর মত প্রিয়... হয়ে যাই অনুতপ্ত...”।

কমেন্টটা পড়েই চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে আলতো করে চোখ বন্ধ করে রিসাদ।চোখ বন্ধ করতেই তরুর চেহারা ভেসে ওঠে…

আর সাথে সাথে চোখ খুলে ফেলে রিসাদ। খানিকক্ষণ পর আবার চোখ বন্ধ করে। এবারও একই ঘটনা ঘটে। অবাক হয় রিসাদ।
বুঝতে পারে, পুরনো স্মৃতি ভালো ভাবে জেঁকে বসেছে।

এমন সময় তার চোখ যায় টেবিলের ওপর রাখা খাতা ও কলমের দিকে। কতদিন ধরে অবিন্যস্তভাবে পড়ে আছে !
শেষ কবে- আবেগের কথা, আবেশের কথা, মানুষের কথা, বন্ধনের কথা লিখেছিল তার মনে নেই !
খাতা টেনে কলমটা হাতে নিয়ে গালে হাত দেয় রিসাদ। কি লিখবে ? কি নিয়ে লিখবে ? কার কথা লিখবে ?


প্রিয় তরু,
শেষবার তোমার সাথে দেখা হয়েছিল আড়াই বছর আগে…শেষবার কথা হয়েছিল আট মাস আগে ! অথচ কি আশ্চর্য, আজও তোমার বিশুদ্ধ ছোঁয়া অনুভব করি। অনুভব করি তোমার প্রতি ভাললাগার প্রতিফোঁটা আবেশ। প্রথম ভালবাসা জিনিসটি তো বরাবরই বিশেষকিছু ! আমাদের কাছেও তাই ছিল। তেমনি ছিল কিছুটা আড়ালের, কিছুটা গভীরতার, কিছুটা সম্মানের আর এগুলোর চেয়ে ঢের বেশি অনুভবের, বিশ্বাসের। অথচ স্বপ্নেও ভাবি নি, তোমার সাথে যোগাযোগই থাকবে না ! ৪ বছর হয়ে চলল আমাদের বন্ধন ছিঁড়েছে কিন্তু সেই প্রথম দেখার মত তুমি আজও আমার কাছে মোহনীয়, স্নিগ্ধ। বর্ষাকালের প্রথম কদম ফুলের মত বিশেষ কিছু, রজনীগন্ধার মত সৌরভের, জ্যোৎস্না স্নানের মত মায়াবী ! আর এই অনুভূতিই তো প্রমাণ করে, ভালবাসি এখনও ! গভীর মমতায় ছুঁয়ে দিলেই মন বলে দেয়- এইত, এখানেই মন বসেছে, এখানেই আমার আবাস। ভাললাগে সবকিছু, ভালবাসতে ইচ্ছে করে সবকিছু। ইচ্ছে করে তোমার ভালবাসার সাগরে ডুব দিয়ে শুদ্ধ হতে।

৪ টি বছর হয়ে গেল … !

জীবন আবেগী মানুষকে সমঝতা করতে শেখায় ! এই সমঝতা নিজের সাথে, আবেগের সাথে, ভালবাসার সাথে, পরিবারের সাথে, প্রাপ্তির সাথে, পরিণতির সাথে ! আর এভাবে সমঝতা করতে করতে একসময় নিজেকেই হারিয়ে ফেলা। তখন আর আমাদের মাঝে থাকে না শুদ্ধতা আর মমতার ছিঁটেফোটা। রক্তমাংসের নিথর দেহটাই কেবল অবশিষ্ট থাকে।

বিশ্বাস কর, চেষ্টা করেও মানাতে পারি নি কাছের মানুষগুলোকে ! আমার অন্য সকল বিষয়ে তাদের ছাড় থাকলেও এই তোমার বিষয়ে পাই নি কোন ছাড়, পাই নি কোন বিশ্বাসের আশ্বাস !

একটা গান শুনেছ, ক’ফোঁটা চোখের জ্বল ফেলেছ যে তুমি, ভালবাসবে ? প্রিয় তরু, ৪ টি বছর হৃদয়ের অদৃশ্য রক্তক্ষরণ কি কম নয় ? প্রতীক্ষার ৪ টি বছর যে কতটা কষ্টের, কতটা যন্ত্রণার তা আমি বুঝি ! আবার এটাও জানি, তোমার ফিরে আসা হবে না। কারন, আমাদের গল্পতো হল- ক্ষয়ে যাওয়া ডানার প্রজাপতির গল্প, পালহীণ নৌকার গল্প, অতৃপ্ত এক আত্মার গল্প, বিষন্ন এক হৃদয়ের গল্প, চড়ূই পাখির দীর্ঘশ্বাসের গল্প, পরাজিত এক পথিকের গল্প, ম্লান সূর্যের গল্প, স্যাঁতস্যাঁতে শ্যাওলার গল্প, পঁচে যাওয়া কচুরিপানার গল্প।

তবুও একসময় আমরা সকলে স্বপ্নের কাছেই হেরে যাই; যেমনটি হেরে গেলাম আমি আজও ! ওই স্বপ্নের ডানায় ভর করে আজও বিড়বিড় করে তোমার গল্প বলি। দূরে কোথাও এ্যাকুইরিয়ামের দুটো গোল্ডফিস সেই গল্প শুনে মুখ তুলে চায়; কোথাও কোন চড়ূই পাখি টিউটিউ করে ডেকে ওঠে। ওরা যে আজও আমার বিষন্নতার বন্ধু !

লেখা শেষ করেই রিসাদ দেখে তার হাত কাঁপছে। হৃদয়টা বড্ড ভারী হয়ে গেছে। কেউ একজন একটু মমতা নিয়ে টোকা দিলেই সবকিছু আঁচড়ে বেরিয়ে আসবে।
চেয়ার থেকে উঠে রিসাদ জানালার রেলিং ধরে দাড়ায়।

মাঝরাত্রি পেরিয়েছে সেই কখন, তাই প্রকৃতি বেশ শান্ত। আকাশ খানিকটা মেঘলা হলেও চাঁদের জ্যোৎস্না ঠিকই মেঘের আড়াল থেকে উকি দিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। কি যেন মনে করে মোবাইলটা হাতে নেয়। এক এক করে তরুর সবকটি নাম্বারে কল দেয়।

প্রত্যেকটিই বন্ধ…ফেসবুকেও তাকে ব্লক করেছে। নেই, কোন উপায় নেই যোগাযোগের।
অবসাদ ছেয়ে যায় রিসাদের সমস্ত শরীরে।

সম্পর্ক, সম্পর্কের মায়াগুলো একটু একটু করে হালকা হয়ে যাচ্ছে। জীবন এগুচ্ছে কিন্তু পিছুটান বাড়ছে। সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে সামনে এগুনোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ !

নাহ ! অনেক হয়েছে। এভাবে জেগে থেকে লাভ নেই। রিসাদ বিছানার বালিশগুলো ঠিক করতে থাকে।

কি মনে করে যেন টেবিলের দিকে তাকায়। ফ্যানের বাতাসে তরুকে লেখা চিঠিটা উড়ে জানালা দিয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম।

রিসাদ তড়িঘরি করে ছুটে গিয়েও চিঠিটা ধরতে পারল না ! তাকিয়ে দেখে, নিথর ভাবে মাটিতে পড়ছে ওটা…। কেবলই কি চিঠিটা পড়ছে ? না।

রিসাদের স্মৃতি, স্বপ্ন, মমতা, না বলা কথা সবকিছু, সবকিছু পড়ছে ঐক্যতানে !

Monday, March 19, 2012

ক্ষমা নিয়েই বেঁচে থাকা…

উৎসর্গ…

জান্নাত-ই ফেরদৌস লিপু, প্রিয় লিপু আপা :আমার এই বোনটি কেবলই দুঃখকে জড়িয়ে বেঁচে থাকতে চায়!কেবল দুঃখকে জড়িয়ে বেঁচে থাকলে দুঃখেরও যে একটা সৌন্দর্য আছে, যেটা নষ্ট হয়ে যায়, সে বোঝে কি না, আমি জানি না। কিন্তু জানি, আজীবনই সে আমায় ভুল বুঝে গেছে !

তামান্না মুনতাকা, প্রিয় তামান্না :পরিচিত হয়েও এখন অপরিচিত একজন । কষ্ট নিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকতে হয় তা আমার চেনা,কিন্তু ক্ষমা নিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকতে হয় তাই এবার শেখার পালা।তবুও এই লেখাটা আপনার কাছে পৌছবে না আমি জানি ।




ফোনটা ধরলেই ওপাশ থেকে একটা গম্ভীর স্বর বলে, “ কইরে তুই” ?

আমি উত্তর দিই না। বরং মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকাই, কে ফোন করেছে লক্ষ্য করি। এবার মোবাইলটা কানে ঠেকাতেই শুনতে পাই, এক

পরিচিত মুখ হাসতে হাসতে বলছে,

“ভয় পেয়ো না।আমি নাসির। কোথায় আছ এখন ?

আমি এখন আলি’র ক্যান্টিনে খাচ্ছি।

তাহলে খাওয়া শেষ করে মেইন স্টেয়ার্স এর সামনে আস, দু’জনে একটু গল্প করি।

ওকে ঠিক আছে, আমি আসছি।



২০ মিনিট পর সিফাত আসে।সে দেখে নাসির মেইন স্টেয়ার্স এর সিঁড়িতে এক কোণায় বসে আছে। কাছে গিয়েই বলি, কি মন খারাপ নাকি বন্ধু ?

নাসির সিফাতের দিকে তাকিয়ে বলে, “ভালবাসা মানুষকে মহৎ করে। অথচ এই ভালবাসাই আমায় করেছে পদদলিত; মানুষের কাছে সন্দেহের পাত্র;দিয়েছে কষ্টের উৎস; আর আমায় করেছে নিঃসঙ্গতার সঙ্গী”।

ম্লান হাসি দিয়ে বলি,একবার গভীর ভাবে তাকাও নিজের দিকে, নিজের ফেলে আসা স্মৃতিগুলোর দিকে। যাপিত জীবনের কর্মকান্ডে কি কোনই ভুল ছিল না তোমার ?

ঠিক তখনই তুমি উত্তর পেয়ে যাবে। হাহাকারকে সঙ্গী করে তুমি একটু ক্ষমা’র জন্য পথচেয়ে থাকবে।

স্রষ্টা নারীদের অনেক মানসিক শক্তি দিয়ে পাঠিয়েছেন অনেক ক্ষেত্রে। আমার এক বান্ধবী ছিল হিয়া; একদিন হঠাৎ শুনি সে একটি ছেলেকে বিয়ে করেছে। আমাদের জানা মতে ছেলেটা খুব একটা ভাল ছিল না।

আমি ব্যগ্রকন্ঠে জিঞ্জেস করি, “এই ছেলেটিকেই কেন বিয়ে করলি”?

উত্তরে বলেছে, সে আমায় ভালো নাও বাসতে পারে তবে আমিতো তাকে ভালবাসি। সেটাই বড়। আমার লক্ষ্যই হলো ভালবাসা দিয়ে তাকে অন্ধকার জগত থেকে ইসলামের পথে, আলোর পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসা।

বিশ্বাস কর, এর কথা শুনে সেদিন চোখে পানি এসে গিয়েছিল।

সত্যিই নারীরা পারে ! নারীরা ভালবেসে ক্ষমা করতে শিখেছে জন্ম থেকেই। আমরা পুরুষরাতো কেবল ভোগ করি, কিন্তু ভোগান্তি হয় নারীর। নারীর নিঃস্বার্থ ভালবাসা আর মমতা কত পুরুষকে করেছে সত্য, কত বিপথীকে দিয়েছে পথের সন্ধান, কত হাহাকার সর্বস্ব মানুষকে দিয়েছে সুখময় ও দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ সম্পন্ন জীবনের আঁধার, কত মানুষকে অন্ধকার থেকে তুলে এনে দিয়েছে আলোর সন্ধান তা কেবল স্রষ্টাই জনেন !
নাসির কিছু বলে না, কেবলই মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে সিফাতের দিকে।

খানিকক্ষণ পর নাসির বলে, তোমায় বিষন্ন দেখাচ্ছে। কেন ?

না ঠিক বিষন্ন নই, একটু ক্ষমা পাবার আকাঙ্খায় দিন কাটাচ্ছি, এটুকুই যা।

তমাকে খুব ভালবেসেছিলাম কিন্তু তাকে নিজের কাছে সযত্নে রাখতে পারি নি। জানো, প্রতিটি ভালবাসারই একটা অন্ধ দিক থাকে যা কোন কিছুই বোঝে না, দেখে না। সেও ভালবাসার মোহে এমন কিছু কাজ করেছে যেগুলোকে ছাড় দিলে আমায় অস্তিত্ব হারাতে হবে; অপরদিকে তাকে প্রত্যাখান করলে আমায় হাহাকারকে সঙ্গী করে চলতে হবে।

নাসির বলে, অবশেষে তুমি অস্তিত্বকে বাঁচতে হাহাকারকে সঙ্গী করে নিলে ?

সিফাত বলে, আমার কাছে যে কোন উপায় ছিল না। হাতে অপশন একটাই ! ইদানিং মাঝে মাঝেই তার কথা খুব মনে পড়ে। কখনো তার সাথে আমি ভাল ব্যবহার করেছি বলে মনে পড়ে না। যখনই ফোন করেছে কোন না কোন কথা বলে ধমক দিয়েছি। যখনই দেখা করতে চেয়েছে, তখনই হাজারো কথা শুনিয়েছি। কখনো বা পাশাপাশি বসে আছি; সে ঝালমুড়ি কিনে আমায় এগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি সেগুলো না খেয়ে বলেছি, “তুমি কিনেছ তুমিই খাও”।

আমি নিশ্চিত জানি, সে অনেক কষ্ট পেয়েছে। চোখের জ্বলে বুক ভাসিয়েছে অনেক রাত।

তারপর ? তারপর কি হলো ? নাসির জিঞ্জেস করে।

কি আর হবে ! মধ্যবিত্ত পরিবারের কোন সন্তানের সেই ভালবাসার শেষ পরিণতি – বিচ্ছেদ !

বিচ্ছেদের আগে বলেছিল, “আমি আপনাকে যতটা ভালবাসি, আমি কোনদিন হাসানকে ততটা ভালবাসতে পারবো না। আর হাসান আমায় যতটা ভালবাসে আপনি কোনদিন আমায় ততটা ভালবাসতে পারেন নি”।

সেদিনের পর থেকে আমি অনুভব করেছি, আমি তমাকে কতটা ভালবাসি। এমন কোন রাত কাটে নি, যে রাতে জানালায় দাঁড়িয়ে আমি তমার কথা ভাবি নি ! তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, কাঁদিয়েছি; এ-সবের জন্য আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত।

আলতো করে নাসির সিফাতের কাঁধে হাত রেখে বলে, “অনুতপ্ত হলে সে ক্ষমা পেয়ে যায়, পায়ও। দ্বিতীয়বার ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না বন্ধু”।

হৃদয়ের সমস্ত বাতাস বের করে সিফাত বলে, কিন্তু আমি তার কাছে একবার ক্ষমা চাইতে চাই। একবার……… স্রেফ একবারের জন্য হলেও…….

কিছু কিছু মুহূর্ত আছে যখন কিছুই ভালো লাগে না। না ভাবতে, না বসে থাকতে। তখন আস্তে আস্তে দেয়ালের কাছে গিয়ে দেয়ালকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করি।

কিছুক্ষণ পর দেয়ালে আমার কপালটা ঠেকিয়ে দিই। অল্প অল্প টান্ডা অনুভূত হয়। ভালই লাগে। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পরই আমি হঠাৎ করে পাল্টে যাই। আর তখন কেবল দেয়ালে মাথা দিয়ে বাড়ি দিই আর বলি, “আমার কিছুই হয় নি। আমি ক্ষমা পেয়ে যাব, ক্ষমা পেয়ে যাব”।

মাঝে মাঝে নিজের রুমটাকে অসহ্য মনে হয়। তখন দৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে ব্যাডমিন্টন কোর্টে এসে দাঁড়াই। চোখ মেলে দিই তারা ভরা আকাশে। যতদূর চোখ যায়, মন যায়….

কিন্তু কিছুই ভাল লাগে না। মনে প্রশান্তি না থাকলে তারা ভরা আকাশও বড্ড বেশি বিরক্তিকর মনে হয়।

কিছু কিছু সময় মনে হয় কেউ একজন আলতো করে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁর গায়ের গন্ধ আমি অনুভব করি। তবুও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি আমি। শিরদাড়া বেয়ে প্রশান্তি নিচে নেমে যায়; আমার রক্তচলাচল কেবলই দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকে।বুকটা যে প্রচন্ড জোরে ধকধক করছে তা নিজেই অনুভব করছি ! কিন্তু সেই ধকধক শব্দকে ছাপিয়ে আমি শুনতে পাই, কেউ একজন পেছন থেকে আমার কানের কাছে এসে বলছে “সিফাত-তুমি কষ্ট পেয়ো না; আমি তোমায় কবেই ক্ষমা করে দিয়েছি ! তবুও তোমায় ভালবাসি আজও………”।

ঠিক তখনই প্রচন্ড আনন্দ নিয়ে আমি পেছনে তাকাই। দেখি, কেউ নেই ! একরাশ অন্ধকার বিদ্রুপ করে আর আমায় দেখে হাসে !

কোন কোন দিন প্রচন্ড মাথাব্যথা ওঠে। মাথার চুলগুলোকে কেবল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। তখন চুপচাপ নিজের রুমের ইজি চেয়ারে বসে থাকি। অপূর্ব সাজানো আকাশ, নতুন বউয়ের মত তার সারা মুখে নক্ষত্রের ফুটিফুটি আলপোনা; সাথে রূপালী রঙের চাঁদ। যেন নতুন বউয়ের মত কপালে ঠিক মাঝখানে লাল টাকটকে একটা টিপ দিয়েছে।

এভাবেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি। আর ঘুমের মধ্যেই স্বপ্নে দেখি, “আমি দেশে গিয়েছি। এয়ারপোর্টে আমার প্রিয় দুই ভাই সাকিব-আদিব আমায় নিতে

এসেছে। দেখা মাত্রই আমায় এসে জড়িয়ে ধরে তারা। খানিকক্ষণ পর, পাঁজর ভাঙ্গার মত একটি আওয়াজ কানে আসে।

আওয়াজটা কানে আসতেই সমস্ত শরীরটা দুলে ওঠে। অনন্তকাল ধরে অপেক্ষায় থাকা পথিক, কাঙ্খিত জিনিসটি পেলে আনন্দের সাথে যেমন একটা উৎকণ্ঠা অনুভব করে ঠিক সে রকম অবস্থা।

খুব ধীরে তমা ডেকেছে, সিফাত ?

বেশ কিছুটা সময় নিয়ে পেছন ফিরে তাকাই। তমা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে রজনীগন্ধা ফুল। কপালের ঠিক মাঝখানটায় ঠোট্ট একটা টিপ। আমার সবচেয়ে পছন্দের গাঢ় নীল রঙের একটি সুন্দর সালোয়ার-কামিজ পড়েছে; হাতে কাঁচের চূড়ী যা টুংটাং করে বাজছে। অপূর্ব লাগছে তাকে ! আমি কেবলই নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

তমা আলতো পায়ে আমার কাছে আসতেই একরাশ সংকোচ এসে ভর করে আমার মাঝে। পড়া না পারা ছাত্রের মত আমি মাথা নিচু করে থাকি।

তমা আমার দিকে ফুলগুলো বাড়িয়ে দিতেই আমি ফুলগুলো নিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখি।
তমা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি জানি। তবুও চোখতুলে তার দিকে তাকাতে বেশ লজ্জা লাগছে।

খানিকক্ষণ পর বলে, “তুমি তোমার কিছু কাজের জন্য মনে মনে অনুশোচনায় ভুগছিলে। সে জন্যেই আমি আজ তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি”।

অবাক হয়ে জিঞ্জেস করি, “তুমি জানলে কিভাবে” ?

উত্তরে তমা বলে, “অপেক্ষার প্রহরগুলো যে এমনই হয়। আর মেয়েদের বুকের ভেতর একটা গোপন যন্ত্র আছে, যেটা সবকিছু আগে থেকেই বুঝতে পারে। সে অনুশোচনার কষ্টও বুঝে !”

মাথা নিচু করেই সিফাত বলে, আমি তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছি, কাঁদিয়েছি। আমায় ক্ষমা করে দিও প্লিজ। শেষের লাইনটা বলতে সিফাতের কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে।

অনুতপ্ত হলে ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন নেই সিফাত, ক্ষমা পেয়ে যায়। তবুও বলি, আমি তোমায় অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি।

ভাল থেকো। নিজের যত্ন নিও………

একটা কবিতার কয়েকটা লাইন শুনাই তোমাকে :

“Things get easier

But will never with you !

I’ll cry less

But pain will still be there

The love we shared and gave each other

Will always remain in heart.”

তমা আলতো পায়ে চলে যেতে শুরু করে। হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে সিফাত কি যেন বলতে চায় কিন্তু বলতে পারে না।

কেবলই বিড়বিড় করে বলে, “তোমার সাথে আমার জীবনের গল্পটার শেষ অংশ বুঝি এটাই! হয়ত জীবনে আর কখনো তোমার
সাথে দেখা হবে না; বর্ণিল বিকেলে তোমার সাথে গল্প করা হবে না; অনাবিল উৎকন্ঠা নিয়ে তোমার পাশাপাশি হাঁটা হবে না; পড়ন্ত বিকেলে গোধূলী সময়ে সুর্যের লালচে আলো তোমার মুখে এসে পড়লে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে তোমার মায়াভরা মুখখানির দিকে তাকিয়ে থাকা কবে না………… হয়ত কোন দিন হবে না”।

এক-একটি রাত নীরবে কেটে যাবে আমাদের জীবন থেকে। অসংখ্য নক্ষত্ররাজিকে সাথী করে চলে যাবে মহাকাল, জানব না আমি, তেমনি তুমিও জানবে না !

বেঁচে থাকব কেবল……………….ক্ষমা নিয়ে !

Tuesday, November 15, 2011

হৃদয়ের অন্তরালে

উৎসর্গ…
আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি, এই পৃথিবীতে যে কয়টি সত্যিকারের ভালো মানুষ দেখেছি তাদের মাঝে তিনিও একজন । সৎ, নির্ভেজাল, পরপোকারী, সদা হাস্যোজ্জ্বল, পিতা-মাতার একান্ত অনুগত এই মানুষটির মাঝে অহংকারবোধের ছিটেফোঁটাও নেই। বরং বিনয়ী মানুষটির ব্যবহার আমাদের মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেয় প্রতিনিয়ত।পদ-দলিত মানবতার এই ক্রান্তিলগ্নে এ রকম মানুষগুলোর বড্ড বেশি প্রয়োজন।
প্রিয় অমিও ভাইয়া, ডাঃ অমিও, মিনহাজ রশীদ ভুঁইয়া (অমিও)
আমি প্রতিদিন প্রার্থনা করি, স্রষ্টা যেন আমায় আপনার মত একজন মানুষ হওয়ার সার্মথ্য দান করেন।


বিকেল হলেই তমা’র মাঝে অজানা এক উৎকন্ঠা কাজ করে। তখন সে কোথাও স্থির হয়ে থাকতে পারে না। সারা ঘরে কেবল হাঁটাহাঁটি করে।মাঝে মাঝে কোথাও দাঁড়িয়ে আনমনে ভাবতে শুরু করে দেয়। প্রয়োজনীয় নয়, হাবিজাবি সব ভাবনা।
এভাবে এলোমেলো ভাবে হাঁটতে হাঁটতে সে রকিবের রুমের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।
রকিবের রুমের বারান্দাটা বেশ বড়। এর এক-কোণায় দুটো চড়ূই পাখি সংসার বেঁধেছে। তমা বারান্দায় গেলেই তাদের সংসার দেখে, তাদের সাথে আলোছায়ার কথা বলে।
আরো আছে বেশ কিছু ফুলের গাছ। নীলকন্ঠ ফুলের গাছটি তমার বেশপ্রিয়। বারান্দায় আসলেই তমা বেশ খানিকটা সময় প্রগাঢ় মমতা দিয়ে নীলকন্ঠ গাছটিকে ছুঁয়ে দেয়। দূর থেকে দেখলে আপনার মনেই হবে, কোন মমতাময়ী যেন তার মমতার পরশ বিলিয়ে দিচ্ছে গাছটিকে। আরো আছে দোলনচাঁপা। এই ফুলটির প্রতি তমার আগ্রহ একটু বেশিই বটে।
তমার মা একদিন এই ফুলের গাছটিকে ফেলে দিতে চেয়েছিল। সেই কথা শুনে তো তমা একেবারে রাগে-ক্ষোভে অস্থির। কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিল। এমনকি একদিন না খেয়ে ছিল মায়ের উপর অভিমান করে !!!
প্রায় সন্ধ্যে হয়ে আসছে। অথচ রকিব এখনো বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। তমা গিয়ে রকিবের মাথার চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডাকে, রকিব -ভাইয়া। উঠ না…… সন্ধ্যে হয়ে এল রে….. নামায পড়বি না ????
আরেকটু ঘুমিয়ে নিই আপু…. এখন যা তো, জালাস না খালিখালি…..।
রকিবের ঘরের একেবারের সামনের ফ্ল্যাটের ওই ঘরটায় থাকে সৌম্য।
কিছুদিন ধরেই সৌম্য লক্ষ্য করছে, বিকেল হলেই তাদের সামনের ফ্ল্যাটের বারান্দায় একটি মেয়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। বারান্দার গ্রিল ধরে মুগ্ধ-দৃষ্টিতে নীল আকাশের জোড়া-জোড়া মেঘরাশির দিকে তাকিয়ে থাকে। কখনো-বা বারান্দার কোণায় বাসা বাঁধা চড়ূই পাখি দুটিকে গান শোনায় :
“দীবশ রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি। তাই চমকিত মন
চকিত শ্রবণ, তৃষিত আকুল আঁখি….”
এমন-কি খুব মমতা দিয়ে বারান্দার ফুলের গাছগুলোকে আদর করে দেয়। যেন তাদেরকে মায়ের মত আদর করছে।
সৌম্য বেশ আরো লক্ষ্য করে, মেয়েটি দেখতে খুব সাধারণ। ওড়না গায়ে জড়ানোর ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায়, সে ভদ্র ও নম্রও। কিন্তু মেয়েটি এই ভর-বিকেলে চোখে সানগ্লাস পড়েছে ……..!!!!!

মাথায় কোন একটা বিষয় একবার গেঁথে গেলেই হলো। তখন ওই বিষয়টিকে নিয়ে সৌম্য’র আর চিন্তার শেষ থাকে না। মেয়েটি কেন বিকেল বেলা সানগ্লাস পড়ে ছিল এই নিয়ে যতগুলো যুক্তি থাকতে পারে প্রায় তার সবগুলো নিয়েই সৌম্য ভেবেছে কিন্তু কোনটিই তার মনে ধরে নি।
অবশেষে সে সিন্ধান্ত নিয়েছে, মেয়েটিকে নিজেই জিঞ্জেস করবে…….।
আজ তমার মন ভাল নেই। তাই সে আজ অনেক আগেই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। যেদিন তমার মন খারাপ থাকে, সেদিন সে বারান্দায় দীর্ঘ সময় কাটায়। গ্রিল ধরে কেবলই আকাশের সারিসারি মেঘরাশির দিকে তাকিয়ে থাকে আর বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়ায়।
তমাদের ফ্ল্যাটে আগেও অনেক রকম ভাড়াটে এসেছে। নতুন অনেক মেয়েই এসে দাঁড়াত কিন্তু তাদের কেউই মন কাড়তে পারে নি। এই মেয়েটিকে একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে।
মাথার চুলগুলো তমার চোখের সামনে এসে পড়ায় তার মুখের একটা পাশ দেখা যাচ্ছে না, তবুও সে চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছে না।
সৌম্য’র খুব ইচ্ছে করছে তমার সাথে কথা বলতে। রহস্য উদঘাটন করতে তার মন ব্যাকুল হয়ে আছে।
অবশেষে লজ্জা,সংকোচ বিসর্জন দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সৌম্য।
তমা এখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আনমনে।
বেশ নরম সুরে সৌম্য জিঞ্জেস করে, আজ কি আপনার মন খারাপ ?
কেমন যেন চমকে ওঠে তমা ! পরে সৌম্য’র দিকে তাকালেই সৌম্য একা ম্লান হাসি দেয়। সাথে সাথেই মাথা নিচু করে ফেলে তমা।
প্রায় প্রতিদিন আপনি নির্দিষ্ট সময়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ান। তারপর অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে। মনে হয় আপনি কি যেন খোঁজেন ???
ঠিক বলেছেন আপনি। আমি তাকিয়ে থাকি তবে কিছু খুঁজি না।
আমি তাকিয়ে স্রষ্টার নিপুণ কারিগরের মত তৈরি করা নীল আকাশ দেখি আর ভাবি, আমার মনটাও যদি আকাশের মত বিশাল হত ! আমি বর্ণিল প্রজাপতির উড়ে বেড়ানো দেখি। যার সৌন্দর্য মানুষের মুখে অতি সহজেই আনন্দের হাসি এনে দেয়। ঠিক তখনই আমি ভাবি, ইস ! এভাবে যদি আমিও মানুষকে আনন্দ দিতে পারতাম !!! আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়া দেখি। এই বৃষ্টি হল স্রষ্টার রহমত। আমি হাত বাড়িয়ে সেই বৃষ্টির জ্বলে আমার হাত ভেজাই। আর ভাবি, স্রষ্টার রহমত যদি আমার জীবনটাকেও একটু পাল্টে দিত…………….
কথাগুলো শেষ করেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তমা।
সৌম্য এতক্ষণ পর্যন্ত কথাগুলো তন্ময় হয়ে শুনছিল। একটু একটু করে আরো মুগ্ধ হয়ে যায় সে।
পরের দিন সৌম্য তমার আসার আগেই বারান্দায় এসে দাড়ায়। দু’হাত দিয়ে গ্রিল ধরে তমার কথাগুলো ভাবতে থাকে।
আড়মোরা ভেঙ্গে হঠাৎ লক্ষ্য করে তমা বারান্দায় এসে নীলকন্ঠ ফুলের গাছটিকে আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর খুব ধীরে গ্রিলটা ধরে ডাকে, তমা ?
ঠিক তখনই গাছটিতে হাত বুলাতে বুলাতে তমা জিঞ্জেস করে, কি ভাবলেন এতক্ষণ ???
কথাটা শুনেই লজ্জা পেয়ে যায় সৌম্য।
মাথা নিচু করে ফেলে আর বলে, কই ! কিছু নাতো ।
মুচকি হেসে তমা বলে, নারীর মন সবই বোঝে, কিছু ঘটে যাওয়ার আগেই। টের পেয়ে যায় কে তার দিকে কোন দৃষ্টিতে তাঁকায় ? বুঝে যায় তাকিয়ে থাকা মানুষটির চোখের ভাষা । কারন, স্রষ্টা মেয়েদের পৃথিবীতে পাঠানোর সময় এই ক্ষমতাটা দিয়ে দেন।
কি বুঝেছেন ? ছোট্ট করে সৌম্য বলে, হ্যাঁ বুঝেছি।

এভাবে প্রায় প্রতিদিন সৌম্য আর তমা বারান্দায় দাড়িয়ে কথা বলে। নিজেদের স্বপ্ন, ভাললাগা-মন্দলাগা সবকিছু শেয়ার করে। বিশ্বাসের জায়গাটা একটু একটু করে পোক্ত হতে থাকে।
সৌম্য জিঞ্জেস করে, আচ্ছা আপনার কোন ইচ্ছেটা প্রতিনিয়তই করে ???
তমা ঠিক তখনই মুগ্ধ চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, আমার পাখি হতে খুব ইচ্ছে করে। পাখিদের বেড়ানোর কোন সীমানা নেই, বাঁধা নেই। যেদিকে ইচ্ছে যেতে পারে, যাকে ইচ্ছে সঙ্গী করে নিতে পারে। যেখানে ইচ্ছে সেখানে গিয়ে স্রষ্টার সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারে।
আচ্ছা, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপর কি বলেন তো ???
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আমাদের মন সবসময় কিছু না কিছুর জন্য অপেক্ষা করে যায়। এই অপেক্ষার কোন অন্ত হয় না।
আমাদের দেশে অনেক শিল্পপতি আছে, যারা একটু অসুস্থ হলেই কোটি কোটি টাকা খরচ করে। অথচ আমরা কিন্তু দিব্যি ভালো আছি।
ঠিক কতদিন বেঁচে থাকার ইচ্ছে আপনার ???
তমা বলে, ঠিক ততদিন যতদিন না পর্যন্ত আমি মঙ্গলগ্রহ আর চাঁদের দেশে ভ্রমণ করতে পরছি; যতদিন না পর্যন্ত প্রতিটি মানুষ অপর মানুষের হৃদয়ে পৌছতে পারছে; যতদিন না পর্যন্ত পৃথিবীর সকল সৌন্দর্যকে আমি আমার চোখের ক্যামেরায় বন্দী করবো, ঠিক ততদিন পর্যন্ত।
কথা বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে আসে তমার। গম্ভীর হয়ে বলে, কিন্তু এই পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য আমার কখনোই দেখা হবে না, আমি জানি।
সৌম্য জিঞ্জেস করে, এমন গম্ভীর স্বরে কেন বলছেন ???
মানুষ যে তার ব্যর্থতার কথাগুলো গম্ভীর হয়েই বলে !
এই পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা আ্যাকুইরিয়ামের মাছের মত, যাদের পৃথিবীটা খুব ছোট। আর এভাবেই তাদের স্বপ্নগুলো ঐ ছোট জায়গার মধ্যে একটু একটু করে ছোট হয়ে আসে। প্রাণ-রস বিহীন জীবে পরিণত হতে হতে একসময় তারাও নিঃশেষ হয়ে যায়। আমিও তাদেরই দলে……..।
পরিবেশটা কেমন যেন গুমোট বেঁধে আছে।নিস্তব্ধ নিরবতা কেবলই।
হাসি হাসি মুখে সৌম্য জিঞ্জেস করে, শরতের বিকেলে রূপবতী কোন নারীর সাথে কথা বলার আনন্দটা সীমাহীণ। অনেকে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলে। আমারও একটা আছে।
কিন্তু মানুষ চাইলেই কি তার সবকথা বলতে পারে বলুন ??? হারানোর কি একটা ভয় থাকে না ?
না, পারে না। তমা নরম সুরে বলে, মানুষ হয়ে জন্মানোর এই এক-সমস্যা। “ যা বলতে মন চায়, ঠোঁট তাতে সব সময় সায় দেয় না”।
আগামীকাল আমার একটা দিন। আমি আপনাকে একটা কথা বলবো।
কথাটা বলেই ঝট করে সৌম্য তার ঘরে চলে যায়।
হাত বাড়িয়ে তমা সৌম্যকে ডাকতে যায় কিন্তু পারে না।
মনে মনে বলে, আমারও আপনাকে কিছু বলার ছিল কিন্তু…….।
দীর্ঘম্বাস ছাড়ে তমা। আজকের বিকেলটা কেন যেন বড্ড বেশি অসহনীয় মনে হচ্ছে তার কাছে।
পরের দিন বেশ আগেভাগেই সৌম্য বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ তার বিশেষ দিন। আজ সে তার মনের কথা বলবে। প্রতিটি পুরুষই যেদিন তার প্রিয় মানুষটিকে মনের কথা বলে সেদিন তার বুক ধক্ ধক্ করতে থাকে। মনের মাঝে কেমন যেন একটা উৎকন্ঠা কাজ করে। অস্থির লাগে আবার একটু খুশি খুশিও অনুভব হয়। মিশ্র একটা অনুভূতি।
সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হয়ে যায় কিন্তু তমা বারান্দায় আসে না। এমনকি রকিবের ঘরের দরজাও বন্ধ থাকে।
এভাবে প্রতিদিন সৌম্য তমার জন্য অপেক্ষা করে।
সৌম্যর মা বারান্দায় এসে দাঁড়ান। আলতো করে ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন, সমুদ্রের যেমন একটা শেষ আছে; জীবনের যেমন একটা শেষ আছে; তেমনি কিন্তু অপেক্ষারও একটা শেষ আছে। এটা তোকে মেনে নিতেই হবে……।
মনে মনে সৌম্য বলে, শূন্য বারান্দা দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত প্রভু। এবার আমি একটু মানুষ দেখতে চাই। সেই মানুষটিকে যে কিনা অপার মমতা নিয়ে ফুলের গাছগুলোতে হাতবুলিয়ে দিত।
শূন্য বারান্দায় ফুলের গাছগুলোর অবহেলায় পড়ে থাকা।
কী নিদারুণ এই একাকীত্ব, প্রিয় মানুষটির জন্য অপেক্ষা, আর ?
ঝাপসা চোখে কেবল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ।
একমাস পরে সৌম্যর নামে একটা চিঠি আসে। ঘুম থেকে ওঠেই সৌম্য দেখে তার বালিশের পাশে একটি খাম আছে।
বেশ অবাক হয় সে। ভাবে, এ পৃথিবীতে এমন কে আছে যে তাকে চিঠি লিখতে পারে !!!!
সাথে সাথেই একরাশ আগ্রহ নিয়ে সে খামটা খুলে চিঠি বের করে পড়তে শুরু করে…

একাকীত্বে থেমে যাওয়া জীবনকে সচল করার জন্য মানুষ কত কি-ই না করে, কিন্তু আমি ? আমি এই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতাম, সময় কাটাতাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে সৌন্দর্য অবলোকনের সাথে সাথে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করতাম।আপনি একদিন বলেছিলেন, আমাদের মন প্রতিনিয়তই কিছু না কিছুর জন্য অপেক্ষা করে যায়। তেমনি আমিও অপেক্ষা করেছি, কঠিন একটি বাস্তবের। কবে আসবে আমার জীবনে ! কারন, সেই বাস্তবতাটির কথা মাথায় রেখেই যে আমায় বেঁচে থাকতে হয়।
ক্রমেই ছোট হয়ে আসা আমার পৃথিবীতে, আনন্দের বার্তা নিয়ে এসেছিলেন আপনি।কত চমৎকার মুহূর্ত কাটিয়েছি আমি আপনার সাথে ! মনের কথা বলেছি, স্বপ্ন বুনেছি, এমনকি কখনো ছেলেমেয়ের অধিকার নিয়ে ঝগড়াও করেছি ! আপনার নির্ভেজাল এই বন্ধুত্বের বন্ধনের কথা আমি কখনো ভুলবো না, কখনো না ।
আপনি আমায় সেদিন কি বলতে চেয়েছিলেন, আমি জানি। বুঝতে পেরেছি অনেক আগেই।আপনার কথাও যেমন শুনা হয় নি তেমনি আমার কথাও বলা হয় নি !আমি জানি, আপনার মনে প্রায়ই একটা প্রশ্ন জাগত, আমি কেন সবসময় সানগ্লাস পড়ে থাকি? মূলত এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যেই প্রথম আপনি আমার সাথে কথা বলেন। আপনি অনেক দিন জিঞ্জেস করতে গিয়েও শেষে জিঞ্জেস করতে পারেন নি। অথচ আপনি জানেন না, আমার জীবনের চরম সত্যটা ওখানেই লুকিয়ে আছে। আমার গ্লুকোমা আছে।ক্রমে ক্রমে আমার দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে,সাথে আমার পৃথিবীও। যেদিন আপনার সাথে আমার শেষ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা হয়েছিল, ঠিক সেই দিন রাতে বাবা আমায় নিয়ে লন্ডন চলে যান শেষ বারের মত আমার চোখদুটি ভালো করার ব্যর্থ চেষ্টায়। কিন্তু সপ্তম আসমানের ওপাড়ে যা আগেই লিখিত হয়ে গিয়েছে তা কিভাবে বদলানো যায় বলুন ? যা হবার তাই হলো। এখন আমার সবকিছুই অন্ধকার। এমন এক মানুষ যার কাছে আলো-অন্ধকার, এমনকি পৃথিবীর সৌন্দর্য সব একই রকম- কালো…… একদম কালো।
আমরা মানুষেরা বড়ই অদ্ভুত। সারাজীবন স্বপ্ন দেখে যাই একরকম আর আমাদের জীবনে ঘটে যায় অন্যরকম। ছেঁড়া ছেঁড়া পুঁথির মালার মত কখন রাত গড়িয়ে সকাল হয়; আবার দিন গড়িয়ে রাত হয় আমি টেরই পাই না।
তবুও…….তবুও বেঁচে থাকা।
ইতি
আপনার অতি সাধারণ বন্ধু-তমা


চিঠিটা পড়া শেষ হলেই সৌম্যর সমস্ত অস্তিত্ব দুলে ওঠে। বুকের ভেতর থেকে সবকিছু ঝড়ের বেগে বেড়িয়ে আসতে চায়।
না,কেউ ছিল না আমার, কখনো না। কোনদিনও ছিল না।
চোখদুটি ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসে। সবকিছু, আশে পাশের সবকিছুই বিবর্ণ, স্থির।
এভাবেই হয়ত মানুষ মানুষকে আশ্রয়হীণ, অবলম্বনহীণ করে চলে যায়।
চোখ বন্ধ করে চিঠিটাকে দু-হাত দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে বলে,
“ একবার ভালবেসে দেখ, আমি হারাব না…
শুধু একবার হাতটা ধরে দেখ,কখনোই ছেড়ে যেতে দিব না…
বরং দেখবে তুমি জগতটাকে, আমার দৃষ্টিসীমার মাঝে
আমার সাথে…… আমার হাত ধরে…………”।

Wednesday, November 2, 2011

এলোমেলো মন…

উৎসর্গ…
অসাধারণ মানুষ তিনি ! যখনই দেখা হয়, খুব আন্তরিকতার সাথে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করেন। এত চমৎকার করে কথা বলেন যে কেবল তন্ময় হয়ে শুনতে ইচ্ছে করে !

প্রিয় সাকিব ভাই, সাকিব ফেরদৌস ভাই

সবাই মুগ্ধ করতে পারে না, কিন্তু আপনি আপনার কর্ম আর ব্যবহার দিয়ে আমাদের অনেককে মুগ্ধ করেছেন। অসাধারণ একজন মানুষ হয়েও আপনি থেকে যান আমাদের ধরা-ছোঁয়ার একেবারে কাছে; যেখাতে লাল-নীল প্রজাপতি ঘুরে বেড়ায, টুপটাপ বৃষ্টি নামে অবেলায়।
আমি মাঝেমাঝেই স্বপ্ন দেখি, কোন একদিন আপনি আমার এক অখ্যাত গল্প নিয়ে ছোট্ট একটা হলেও নাটক বানাবেন, আর আমি মুগ্ধতার চোখে তা দেখবো !



আকাশ পোড়ে না জানি, চাঁদ কিংবা তারার আগুনে
আমাদের ভাগ্য শুধু পোড়ে
যারা দেখি, আর পোড়ে
আমাদের সবুজ সাবেকী অভিমান সেই সাথে’।

দূর থেকে দেখলে সিফাতকে ঠিক সিফাত মনে হবে না। দুই পা মেলিয়ে এমন ভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে যেন সে এক পাথরের মূর্তি। চোখ দুটো স্থির, সমস্ত চেতনা দিয়ে শরীরটাও স্থির।
মাঝে মাঝেই এই জায়গায় বেড়াতে আসে সিফাত। মন খারাপ হলে আসে, একা একা লাগলেই চলে আসে।
আর এখানে আসেই সে আশেপাশের গাছগুলো, ঐ দূর নীল আকাশ আর মুক্ত মনে উড়ে যাওয়া পাখিগুলোর সাথে কথা বলে। তাদেরকে নিজের জীবনের বিষাদ ভরা অংশের গল্প শুনিয়ে মন হালকা করে।
মাটির উপর ফুঁটে থাকা ঘাসফুল গুলোকে একসময় হাত দিয়ে নেড়ে দেয়। আলতো করে ছুঁয়ে দেয়। কারন, এগুলো যে তার পরম বিশ্বস্ত বন্ধু।
আর এভাবে খানিকটা সময় কাটালেই তার মন ভালো হয়ে যায়।
ঘাসফুল গুলোর ওপর হাত বুলাতে বুলাতে সে বুঝতে পারে, কেউ একজন তার পেছনে এসে দাড়িয়েছে।
পেছনে তাকাতেই দেখে ইমন এসেছে। ও ইমন ! এসো ভাইয়া, বোস এখানে।
সিফাতের পাশে বসতে বসতে বলে, ভাইয়া আপনার কি মন খারাপ ?
যদিও আপনার বসে থাকার ভঙ্গি আর আলতো করে ঘাস পূলগুলো ছুঁয়ে দেওয়াই বলে দেয় আপনার মন খারাপ !
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখে হাসি এনে সিফাত বলে, তুমি বেশ ছোট ছোট জিনিস লক্ষ্য করেছ ! তোমার বিশ্লেষণটা একেবারে মিথ্যে নয়।
মুচকি হেসে ইমন বলে, ভাই আপনি কি জানেন মানুষ কখন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলে ?
সিফাত আকাশের দিকে তাকিয়ে জিঞ্জেস করে, কখন ???
যখন মানুষ নিজেকে লুকোতে চায়। সে সময় মানুষ জোর করে হাসার চেষ্টা করে, আপন মানুষকে বিভিন্ন উল্টোপাল্টা কথা শুনাবার চেষ্টা করে।
তাই জোর করে হাসতে নেই, এতে করে তার স্বকীয়তায় ভাটা পড়ে।
একটা প্রশ্ন করি ভাই ? অবশ্যই ভাইয়া।
আপনি কি কোন মানুষের দৃষ্টিসীমায় নিজেকে দেখতে পেয়েছেন ???
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর সিফাত বলে, হ্যাঁ এই পুথিবীতে দুইজন মানুষের মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। এর মাঝে একজন আমার বন্ধু আর অন্যজন নিজের মত করে চলে গিয়েছে।
একটু মিথ্যে বলা হল, যিনি চলে গিয়েছে তিনার মাঝে আমি আমাকে খুঁজে পেতে চেয়েছিলাম কিন্তু পাই নি। বড্ড দেরি করে ফেলেছিলাম তো…..।
আমিও একজনের মাঝে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলাম। খুব ভালবাসতাম তাকে। মনের মাধুরী মিশিয়ে, নিজের অস্তিত্বে অনুভব করতাম তাকে। ঠিক বন্ধনের তিন বছরের মাথায়, হঠাৎ একদিন আমায় ফোন করে বলে, আমি আর তোমার সাথে যোগাযোগ রাখবো না। তাকে কারন জিঞ্জেস করেছিলাম। কি বলেছে জানেন ?
আমি ধেকতে ভাল না, আমার সিজিপিএ ভাল না, ভাল ভার্সিটিতে পড়ি না তাই নাকি আর আমাকে পছন্দ হচ্ছে না। সে এখন আইবিএ তে পড়ে কোন ছেলের সাথে প্রেম করবে। প্রায় ৭ দিন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু লাভ হয় নি।
অবশেষে তাকে শৃঙ্খলার বেড়ী থেকে মুক্ত করে দিয়েছিলাম। অথচ আমি এখনও আমার দৃষ্টিসীমায় তাকে খুঁজে পাই। বুঝল না, সে কিছুতেই বুঝল না…….
ইমন তার কথা শেষ করতেই পরিবেশটা যেন আরো নিঃস্তব্ধ হয়ে যায়। কেমন গুমোট একটা আবহাওয়া।
আর আমি ? নরম সুরে সিফাত বলে।
আমায় একটা মানুষ পছন্দ করতো। পাগলের মত ভালবাসতো। অথচ কোন দিন আমি তার ভালবাসার মূল্য দিই নি। অবশেষে সে যখন আমার জীবন থেকে চলে গিয়ে অন্য একটি মানুষের হাত ধরে নতুন করে পথচলা শুরু করল, ঠিক তখন বুঝতে পারলাম আমি কি হারালাম !
জানো ! মাঝে মাঝেই স্বপ্ন দেখি , সে নীল রঙের শাড়ী, হাতে কাচের চূড়ী, কপালে ঠিক মাঝখাতে ঠোট্ট একটা কালো টিপ আর চুল গুলো কোলা রেখে আমার পাশে এসে বসেছে। আর আমি তার সামনে বসে তার একটা হাত ধরে তার দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছি !
সে আমায় জিঞ্জেস করে, আমি কেন নীল শাড়ী পড়েছি জানো ???
পড়া না পারা ছাত্রের মত আমি মাথা নিচু করে বলি, না জানি না।
কারন, নীল শাড়ী আমায় বেশ ভালো মানায়। যদিও বেদনার রং নীল, তবুও আমার কিন্তু কোন বেদনাবোধ নেই।
মুখটা আমার কাছে এনে সে কানেকানে ফিসফিস করে বলে, “তুমি যে তোমার ভালবাসার আলতো ছোঁয়ায় ঐ দূর নীলিমায় আমার সব বেদনাগুলো উড়িয়ে দিয়েছ”।
কথাটা বলে নিজেই লজ্জা পেয়ে যায় সে।
ঠিক তখনই আমি তার কাছে গিয়ে আলতো করে আমার ঠোঁট দিয়ে তার কপাল ছুঁয়ে দিই।
স্বপ্নটা বলা শেষ করেই সিফাত কেমন যেন আনমোনা হয়ে আবার ঘাসের দিকে তাকিয়ে থাকে।
হঠাৎ জেগে ওঠে বলে, সর‌্যি আমার আবোল-তাবোল স্বপ্নের কথা শুনার জন্যে।
হাসতে হাসতে ইমন বলে, আপনিতো জানেন না- আপনার স্বপ্নটা কতটা চমৎকার !
স্বপ্ন হয়ত চমৎকার কিন্তু প্রিয় মানুষ পাশে না থাকলে এই স্বপ্নটাকেই আবার পানশে মনে হয়।
ইমন বলে, ভাইয়া কথাটা ঠিক বললেন না ।
স্বপ্ন কখনোই অর্থহীণ হয় না। কারন, সবাই চমৎকার করে স্বপ্ন দেখতে পারে না। আর এই পৃথিবীতে বেশির ভাগ মানুষই এটাকে পুঁজি করে বেঁচে থাকে।
আচ্ছা ইমন, ভালবাসার মানুষ যদি ভালবাসার গভীরতা না বোঝে অবঞ্জা করে তাহলে কেমন লাগে বল তো ?
আমাদের প্রিয় মানুষগুলো আসলে বোঝে না তাদের আমরা কতটা ভালবাসি !
ভাই, আপনার কোন কাছের মানুষ কি এরকম করেছে আপনার সাথে ???
না, আমার সাথে হয় নি। কথাটা বলেই সে চুপ হয়ে যায়।
অনেকক্ষণ পর বলে, আমার এক খুব কাছের মানুষের সাথে এরকম হয়েছে।
সেই প্রিয় মানুষটি একজনকে ভালবাসত। সারাদিন যতই ব্যস্ত থাকুক না কেন, সময় করে বেশ আগ্রহ নিয়ে ভালবাসার মানুষটির খবর নিত। একদিন সেই মানুষটি মোটরসাইকেলে এক্সিডেন্ট করে !
সে যখন তার এক্সিডেন্ট এর খবর তার প্রিয় মানুষটিকে বলে তখন উত্তরে সে কি বলেছে জান ???
বলেছে, ‘তুমি ঔষধ খেয়ে নিও। তারপর একটা লম্বা ঘুম দাও, দেখবে ভাল লাগবে”।
আমরাও কিন্তু জানি, ঔষধ খেতে হবে এবং আমরা ডাক্তারও দেখাব। কিন্তু প্রিয় মানুষটি একটু উৎকন্ঠায় পড়ে যাবে, একটু মমতা নিয়ে কথা বলবে, একটু আগ্রহ নিয়ে খবর নিবে- এটা কি খুব বেশি কিছু ?
না ভাই বেশি কিছু নয়। ভালবাসার শক্তি অনেক প্রখর ভাই। এই শক্তি অনেক অসুখ নিমিষেই ভাল করে দেয়।
একবার আমার পেটে প্রচন্ড ব্যথা হয়েছিল। প্রায় ২ দিন আমি কাঁতরাচ্ছিলাম। কিন্তু যখনই আমরা মা খুব আলতো করে আমার পেটের উপর হাত রাখতেন, তখনই আমি আর ব্যথা অনুভব করতাম না। আমি তাকিয়ে দেখতাম, মা পরম যত্নে চৌম্বকীয় শক্তিতে আমার সমস্ত ব্যথা শুষে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। আর এই মমতা দেখেই আমি প্রায় অর্ধেক সৃস্থ হয়ে গিয়েছিলাম।
পৃথিবীটা কেমন যেন রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে। আত্মার বন্ধনের কথা বললে মানুষ এখন হাসে। প্রাণের বন্ধুর কথা বললে আমাদের সেকেলে স্বভাবের ভাবে। ভালবাসার মূল্যের কথা বললে “আঁতেল” ভাবে !!! পৃথিবীটা বুঝি অনেক এগিয়ে গেছে যেখানে বন্ধনের প্রগাঢ়তা, সম্পর্কের বির্নিমান, আত্মার টান শ্বদগুলো বড্ড বেশি অনুপস্থিত।
কিন্তু আমি এগুলোকে পুঁজি করেই বেঁচে থাকতে চাই। চাই কাছের মানুষগুলোকে ভালবেসে যেতে আজীবন।
কারন, তাদের মাঝেই যে আমি আমার সুখ খুঁজে পাই।
তোমায় বলেছিলাম না – একজন একজন আমায় খুব ভালবাসত। সে চলে যাওয়ার পর বুঝেছিলাম সে হৃদয়ের কতখানি জুড়ে আছে। ও চলে গেল কিন্তু কিছু জিনিস আমাকে শিখিয়ে গেছে। আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি ঘটনা থেকে কিছু না কিছু শিখি।
মানুষকে মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি সে আমায় শিখিয়ে গেছে। নইলে কাছের মানুষ কখন যে দূরের মানুষ এমনকি অপরিচিত হয়ে যাবে আমরা বলতেই পারবো না।
এগুলো বেশ সহজ কথা, আমরা প্রত্যেকেই জানি কিন্তু একটু মেনে চলতে হবে কেবর। আর এরকম অনেক টুকরো টুকরো ঘটনাই ঘটে যাচ্ছে আমাদের সাথে, আমাদের প্রিয় মানুষগুলোর সাথে……….
সাথে সাথে আমরা বেদনায় নীল হয়ে যাচ্ছি একটু একটু করে নীরবে…….
প্রিয় পাঠক, চলুন না আমাদের বন্ধনগুলোর প্রতি আমরা আকেটু যত্নশীল হই হোক সে বন্ধন কোন এক বন্ধুর সাথে, আমাদের প্রিয় মানুষটির সাথে, আমাদের কোন এক আত্মীয়ের সাথে………
আর চেষ্টা করি, কাছাকাছি থেকে বন্ধনের প্রগাঢ়তা অনুভব করতে……..।

Saturday, October 22, 2011

শেষ কথা…

উৎসর্গ…
যেখানে দাবি আছে, প্রত্যাশা আছে, সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি আছে, সাথে কলহ এবং পূর্ণমিলনও আছে” সেই বন্ধনটিই হলো ‘বন্ধুত্ব’। আমি এভাবে বন্ধুত্বের সঙ্গা বলতে ভালবাসি। তবে এই সঙ্গা টিকে প্রমাণ করেছে আমার এই বিশ্বস্ত বন্ধুটি। আমায় নিয়ে আগ্রহের সীমা নেই মানুষটির! আমার অতি প্রিয় কাছের মানুষ। সাধারণ হয়েও আমার কাছে একটু অসাধারণ একজন !
প্রিয় বেণী-মাধব, প্রিয় মৃদুল চৌধুরী কনক
বলতে পারিস, এক জীবনে কত পূণ্য করলে তোর মত একজন অসাধারণ, অকৃত্রিম বন্ধু পাওয়া যায় ????




আম্মু, সিফাত ভাইয়া কই ? বলতে পার ?
না মা, আমিতো জানি না। হয়ত ড্রইং রুমে বসে পেপার পড়ছে….

সনি ড্রইং রুমে গিয়ে দেখে, সিফাত বসে বসে আনমনে কি যেন ভাবছে।
সনি খুব সাবধানে ধীর পায়ে সিফাতের সামনের সোফায় গিয়ে বসে। অথচ সিফাত নিজের জগতেই মগ্ন আছে।

খানিকক্ষণ পর আলতো কন্ঠে সনি ডাকে, সিফাত ভাইয়া ???

আড়মোরা ভেঙ্গে সিফাত বলে, কি….কি……।সনির দিকে তাকিয়ে বলে, কখন এসেছিস ?
বেশ কিছুক্ষণ হলো এখানে এসেছি। দেখলাম, আপনি খুব মনযোগ দিয়ে কি যেন ভাবছেন ? তাই চুপচাপ বসে আছি।

কি ভাবছেন শুনি ??? বেশ মজার ভঙ্গিতে সনি জিঞ্জেস করে, কার কথা ভাবছেন বলেন তো ????
কথাটা বলে আর হাসতে থাকে সনি।

মলিন হেসে সিফাত বলে, কারো কথা না রে ভাইয়া।

মুচকি হেসে সনি বলে, আমি ছেলেটা একটু বোকা এটা আপনি জানেন। তবে এটুকু কিন্তু বুঝি যে, মানুষ যখন নিজেকে লুকাতে চায় তখন সে মিথ্যে বলে। যেমনটা আপনি বলছেন।

এমন সময় সিফাত এর মোবাইল বেজে ওঠে…… সজীব ফোন করেছে।
হ্যালো, সিফাত ভাই ? বাসায় আছেন ???
হ্যাঁ বাসায় আছি। চলে আয়…….
সজীব বলে, থাকেন, আমি আসছি…….

১৫ মিনিট পর সজীব এসে বসার ঘরে সিফাত এর পাশে বসে। সিফাত এর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে জিঞ্জেস করে,
কি ভাই, মন খারাপ???

জানিসতো কি কারনে মন খারাপ। Something missing in my heart…

হঠাৎ সিফাত গান ধরে, “ কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে তোমারে দেখিতে দেয় না, মন মেঘে তোমারে অন্ধ করে রাখে,
তোমারে দেখিতে দেয় না…….মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না….”।
গান শেষ হলেই সজীব বলে, ওনার নাম্বরতো আছেই- ফোন দেন কথা বলেন। দেখিয়েন, ভাল লাগবে।

আচ্ছা, সজীব এমনটা কেন কেন হলো বলতে পারিস ???

তুইতো জানিস, আমি তার সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছি। আর সে যদি আমায় ভালইবাসত তাহলে রাস্তায় আমায় এতগুলো মানুষের সামনে কেন অপমান করলো ? আমার মা-বাবার নামে বাজে বাজে কথা বলতো ? এমনকি আমি যখন মাস্টার্স করতে বাইরে যাব তখন সে তার মামাকে দিয়ে ফোন করিয়ে আমার ভিসা পর্যন্ত আটকে রেখেছিল ?
কেন, কেন এমন করেছে ???

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সজীব। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলে, আপনি একটু জেদী ছিলেন। আর তমা আপুও ছিল বেশ রাগী। আর রেগে গেলে মানুষ পশুর মত আচরণ করে। আর তমা আপুও রেগে গিয়ে বিভিন্ন উল্টোপাল্টা কাজ করেছে। তবে একটা কথাই বলব, তমা আপু আপনাকে সত্যিই অনেক ভালবাসে।

আমি এবার দেশে আসার পর একদম ভালো নেইরে সজীব। যে মানুষটির কথা কখনো ভাববো না বলে পণ করেছিলাম, তার কথাই বারবার মনে পড়েছে। আমি…… আমি বুঝি পাগল হয়ে যাব রে …… পাগল হয়ে যাব।

সজীব আলতো করে তার হাতটা সিফাতের ঘাড়ে রেখে বলে, একটা কথা মনে রাখবেন- মানুষ তার প্রথম ভালবাসাকে কখনোই ভুলতে পারে না। আর আপনি যখন প্রিয় মানুষদের থেকে দূরে থাকবেন তখনই আপনি তাদের প্রতি আপনার এই ভালবাসার গাঢ়ত্বটা ক্রমশ বাড়বেই।

হঠাৎ সোফা থেকে উঠে দাড়িয়ে সজীব হাঁটতে শুরু করে।

আপনি যতই অস্বীকার করেন না কেন আপনি কিন্তু তমা আপুকে এখনও ভালবাসেন। এটা যত তাড়াতাড়ি মেনে নেন ততই মঙ্গল।
কিন্তু, তমা কি এখন আর আমার কাছে ফিরে আসবে ???
আরে, আসবে না মানে ? আলবত আসবে। হয়ত প্রথমে একটু রাগ ঝাড়বে, এত দিনের জমানো ক্ষোভ তো ….. তারপর দেখবেন, সব ঠিক হয়ে গেছে। ……

১ বছর আগে সিফাত এর সাথে তমা’র বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। তবুও এউ এক বছরের জীবনে সিফাত মাঝে মাঝেই তমার কথা ভেবেছে। সিফাতের চিন্তা-চেতনা, ভাললাগা এসবের সাথে তমার মিল ছিল না বললেই চলে। তাই সারাক্ষণ তাদের মাঝে ঝগড়া লেগেই থাকত। অবশেষে সিফাত স্কলারশিপ পেয়ে লন্ডনে মাস্টার্স করতে চলে গেল। বিদেশে যাওয়ার পরেও সিফাতের জীবনে কোন পরিবর্তন ঘটে নি, কিন্তু অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটে গেছে তমার জীবনে। সিফাত চলে যাওয়ার পর তমার সাথে হাবীব নামের একটা ছেলের পরিচয় ঘটে। তারপর ভাললাগা। আর পরিচয়ের ২ মাসের মধ্যেই হাবীব কিছুটা জোর করে তমার সাথে এংগেষ্টমেন্ট করে ফেলে গোপনে। তারপর আসতে আসতে তমাকে তার বাড়ির সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। বিষয়টা একটু লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হলেও পরে তমার মা, খারারাও জানতে পারে। তমার প্রবল ইচ্ছার কারনেই তার মা-খালারা বিষয়টা মেনে নিয়েছিল।

একসময় বিষয়টা সিফাতও জানতে পারে। সেদিন বেশ কষ্ট পেয়েছিল সে। বুঝেছিল, কাছের মানুষদের হারিয়ে ফেলার কষ্ট কাকে বলে ! একজন মানুষ যে তার জন্যে পাগল ছিল, তাকে পাগলের মত ভালবাসত সে কি না আজ অন্য একটি মানুষের হয়ে গেল। যাকে চাইলেই আর দেখতে পাওয়া যাবে না, চাইলেই আলতো করে তার হাত ছুঁয়ে দেয়া হবে না !!! সারাটা রাত সিফাত বুকের ব্যথায় ঘুমোতে পারে নি। যেন নিজের শরীর থেকে কেউ তাজা এক টুকরো গোশত কেটে নিয়ে গিয়ে সেই ক্ষত স্থানে লবণ লাগিয়ে গেছে। ….

অনেক ভাবছে কিভাবে সিফাত তমার সাথে যোগাযোগ করবে ? যোগাযোগ করার কথা মাথায় আসলেই একরাজ সঙ্কা আর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তার সামনে এসে ভর করে।

অবশেষে সিফাত সাহস করে তমাকে একটা এসএমএস করে,

“ সালাম। কেমন আছেন আপনি ? আপনার বাসার সবাই ? হাবীব ভাই ? আমি মাত্র কয়েকদিন হল দেশে ফিরেছি …..”।
এসএমএসটা পাঠানোর ৩০ মিনিট পরে তমা সিফাতকে কল দেয়। ফোন ধরেই সিফাত বলে, কেমন আছেন আপনি ???
কানিক্ষণ চুপ করে থাকার পর তমা বলে, হ্যাঁ ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন ???

ফিকে হাসি হেসে সিফাত বলে, “জীবন যখন যেমন……তারই মাঝে অবগাহন”। তবে ……..ভাল আছি।
আপনার বাসার সবাই, হাবীব ভাই কেমন আছে ? সিফাত জিঞ্জেস করে।
হ্যাঁ সবাই ভালো আছে। রাব্বী বেশ বড় হয়ে গেছে, ক্লাস এইট এ পড়ছে।

এরপর কিছুক্ষণ দুজনই চুপ করে থাকে, মখে কোন কথা নেই।

দুজন দুজনের একটু কাছাকাছি আসতে চাইলেও বাস্তবতা যেখানে প্রতিকূলে সেখানে কি মনের আবেগ প্রকাশ করা সমীচিন ??? না, কখনোই না। বড়ং তাকে লুকিয়ে রাখাই ভাল।

ধীর কন্ঠে তমা এবার বলে, আমি আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, রাগের মাথায় অনেক খারাপ কথা বলেছি। আমায় ক্ষমা করবেন।

সাথে সাথেই সিফাত বলে, না না আপনি ক্ষমা চাচ্ছেন কেন !!! আপনারতো কোন দোষ নেই। সব দোষ আমার। তাই আমিই আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। এখন আর আপনাকে নিয়ে আমার মনে কোন ক্ষোভ, কোন প্রশ্নবোধক চিহ্ন নেই। বরং আমি আপনাকে বেশ শ্রদ্ধা করি।

সিফাতের কথা গুলো শুনে তমা বেশ অবাক হয়। সিফাত আজ হঠাৎ এরকম কথা বলছে কেন ???
কোন এক গল্পের বইতে পড়েছিলাম, প্রিয় মানুষ দূরে চলে গেলে বা তার সাথে বিচ্ছেদ ঘটলে তার নামে সবসময় ভাল ভাল কথা বলতে হয়। আর আমিও তাই করছি।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তমা বলে, গতবার আপনি লন্ডনে যাওয়ার সময় আমার সাথে একটি বারের জন্যে হলেও দেখা করেন নি। আমি এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এসেছিলাম। তারপরও আপনি দেখা করেন নি। দেখা করলে হয়ত আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হত না। আপনি যা করেছেন আমার সাথে, তা আমি কখনোই ভুলবো না। কখনো না।

নরম সুরে সিফাত বলে, আমিতো আগেই বলেছি- সব দোষ আমার। আমার জন্যেই এতকিছু। আমি বরাবারই নিজের ঘাড়ে দোষ নিয়েছি। এবারও তাই নিলাম।

আর এভাবে কথা বলতে বলতে কথন যে, ৪০ মিনিট পার হয়ে যায় সিফাত বা তমা কেউই টের পায় নি। অবশেষে সিফাত বলে, আজ অনেক কথা হলো। রাখি……. ভাল থাকবেন।
তমা বলে, আপনিও ভাল থাকবেন।

ফোনটা রাখার পর থেকেই সিফাতের বেশ ভালো লাগতে শুরু করে। বাসায় ইলেকট্রিসিটি নেই, বেশ গরম অনুভূত হচ্ছে তবুও পরিবেশটাকে তার অসহ্য মনে হচ্ছে না। অনাবিল আনন্দে মুখরিত সিফাতের চেতনার প্রতিটি মুহূর্ত।
বাড়ির উঠোনে সিফাত চেয়ার নিয়ে গিয়ে বসে আর মোবাইলে গান ছেড়ে দেয়….
“তুমি বরুণা হলে হবো আমি সুনীল…..”

গান শুনতে শুনতে একসময় সিফাত নিজের মুখেই গাইতে শুরু করে….
“ তুমি পাহাড় হলে হবো আমি সবুজ
তুমি শাসন করলে হবো আমি অবুঝ
তুমি অরণ্য হও, হবো পাখি
তুমি অশ্রু হলে হয়ে যাব আঁখি……”

এরপর থেকেই ১ দিন পরপর সিফাত আর তমার ছোট ছোট কথা বলা শুরু হয়।
একদিন সিফাত আর সজীব, নাহিদদের বাসা থেকে ফিরছিল। হঠাৎ সিফাত এর মোবাইলে তমা ফোন দেয়। কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“আমি আজ দুপুরে হাবীবকে বলে দিয়েছি আমি আর তার সাথে সম্পর্ক রাখতে পারবো না। আমি কোনভাবেই আর পারছি না। এখন আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। কেন যে সেদিন এংগেষ্টমেন্টটা করতে গেলাম !!! আপনি চাইলে আমার সাথে সম্পর্ক আবার কন্টিনিউ করতে পারেন আর না চাইলে আমি একাই থাকবো ……”।

কথাগুলো শুনার পর খানিকক্ষণ সিফাত অসম্ভব আনন্দে ভাসতে থাকে। সাথে সাথেই সজীব আর নাহিদকে এসএমএস করে, “ তমা ফিরে আসছে….. আমি খুব খুশি। খু-উ-উ-ব-ই খুশি ……”।

আর সিফাতের খুশিতে সজীব আর নাহিদও নিজেদের বিলিয়ে দেয়। এরা তিনজন যদিও তিনটি স্বতন্ত্র মানুষ, তবুও বন্ধনের দিক দিয়ে এরা এক আত্মা।

রাতের দিকে সিফাত বেশ আনন্দ নিয়ে তার বড় ভাইকে ফোন দেয়।
কেমন আছো ভাইয়া ??? ভাবি কেমন আছে ???
ভাল আছি। । আর তোর ভাবিও ভাল আছে।

ভাইয়া তুমি কি জান, তুমি খুব ভাগ্যবান একজন মানুষ। সবাই ভালবাসার মানুষকে নিজের মত করে পায় না কিন্তু তুমি পেয়েছ।
আবার এমনও মানুষ আছে যারা সারা জীবনই ভালবাসার মানুষের খবর পায় না, আবার অনেকে পেয়েও হারিয়ে ফেলে…..।
এ সবকিছু বুঝি আমাদের সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য। আচ্ছা ভাইয়া, ভালবাসার মানুষ দূরে চলে গিয়ে আবার ফিরে আসলে কি করা উছিত ??? তাকে কি আপন করে নেওয়া উচিত নাকি বুঝিয়ে দেওয়া উচিত প্রত্যাখান এর ব্যথা কতটা তীব্র ???

দেখ সিফাত, তুই আমায় কি বলতে চাচ্ছিস তা আমি বুঝেছি। তুই চাইলে তমার সাথে আবার সম্পর্কে জড়াতে পারিস তবে….। তবে এটুকু নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, সে আর কোন ঝামেলা করবে না, মা-বাবাকে নিয়ে উল্টোপাল্টা মন্তব্য করবে না। আমরা তোমাকে নিয়ে অন্তত এ বিষয়ে আর টেনশনে থাকতে চাই না।

রাখি এবার। এখন তুই ডিসিশান নে কি করবি ???? ভাল থাকিস।
ফোনটা রাখার পর সিফাতের বেশ মন খারাপ হয়ে যায়। খানিকক্ষণ পর তমা তাকে ফোন করে।
জিঞ্জেস করে, “ কি ডিসিশান নিলেন” ???

ধীর কন্ঠে সিফাত বলে, আপনি আমার কাছে ফিরে আসা মানেই আপনাকে এংগেষ্টমেন্ট ভেঙ্গে ফেলতে হবে। আর এটা করলে আপনার পরিবার, হাবীব ভাইয়ের পরিবার সবাই কষ্ট পাবে। সাথে আপনাকেও শুনতে হবে পরিবারের মানুষের কাছে বিভিন্ন গালমন্দ। এর থেকে কি ভাল না, যা হচ্ছে তাতেই সায় দেওয়া ????

তমা বলে, আমি জানতাম- আমি জানতাম আপনি এখন এ কথা বলবেন। আপনি এত কনফিউস কেন সব বিষয়ে বলেন তো ??? একটা ডিসিশান নিতে পারেন না !!! আর কখনো কোন দিন আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না। আমি আপনাকে ঘৃণা করি। মনে থাকবে তো, আমি আপনাকে ঘৃণা করি।

একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। বেশ স্নিগ্ধ আবহাওয়া। অথচ সিফাতকেকেমন যেন অগোছালো মনে হচ্ছে। অবচেতন মনে মাটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। একচিলতে উদ্বেলিত করা আনন্দ পরক্ষণেই তাকে আবার মাটিতে এনে ফেলে দিল।

মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলে, “আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি তুমি কোনদিন জানবে না। তোমার পরিবারের মানুষগুলোর কথা, আমার পরিবারের মানুষগুলোর ইচ্ছে, এগুলোর কথা ভাবার কারনেই এই ডিসিশান নিতে হলো। হাবীব ভাই তো আছে যে তোমায় অনেক ভালবাসে। তুমি তার কাছেই সুখে থাকবে। আর আমি না হয় দূর থেকে নিজের স্বপ্নটাকেই বিসর্জন দিলাম। আমায় ভুল বুঝো না তুমি…….ভুল বুঝো না……”

সেদিন রাতে সিফাত এমদম ঘুমোতে পারে নি। বিছানায় মুয়ে শুয়ে চোখের জ্বলে নাহিদ আর সজীবকে এসএমএস এ লিখেছে, “ যেমনি করে একচিলতে বুষ্টির মত এসেছিল তেমনিই চলে গেল তমা। আমি আবারো একা হয়ে গেলাম। আবারো হেরে গেলাম। শুনেছি, হেরে গেলে নাকি পালাতে হয়। বলতে পারিস, আমি পালিয়ে কোথায় যাব ?????

সারারাত তমার কথা ভাবতে ভাবতে একসময় সিফাত অনুশোচনায় ভুগতে শুরু করে। তার কাছে সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়, মানুষের আশা-আকাঙ্খা, কে কি ভাবলো সব তার কাছে অর্থহীণ মনে হয়। সে কেমন যেন পাগলের মত আচরণ করতে শুরু করে। এমন অবস্থা যে তার তমাকে ছাড়া যেন চলবেই না। তার মাথায় কেবলই সজীবের কয়েকটি কথা ঘুরতে থাকে :
“ভালবাসা কোন সূত্র মানে না আর Negotiation should not go beyond our very soul”

তখনই সিফাত সিদ্ধান্ত নেয়, সে তমার কাছেই ফিরে যাবে। কিন্তু সে তো জানত না, বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
সাথে সাথে সে তার ভালবাসার কথা তমার মোবাইলে এসএমএস করে। বেশ কয়েকটা এসএমএস পাঠানোর পর সিফাত হঠাৎ তমার মোবাইলে ফোন দেয়। আর তমা ফোনটা কেটে দিয়ে মোবাইলটা বন্ধ করে দেয়।

এর পর ৭ দিন সিফাত পাগলের মত তমাকে খুঁজেছে। তার মোবাইলে চেষ্টা করেছে, এসএমএস পাঠিয়েছে, তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু পায় নি। খুঁজে পায় নি তার প্রথম ভালবাসাকে। ……

আগামীকাল রাতে অবশেষে সিফাত আবার তার নতুন সেমিষ্টার ধরতে বিদেশের পথে পাড়ি জমাবে। যদিও অনেক রাত হয়ে গিয়েছে তবুও সে বসার ঘরের জানালা দিয়ে তারাভরা আকাশের দিকে নিথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভাবছে, জীবনটা আসলে কি ???

প্রশ্নটা করেই আবার নিস্ফলক তাকিয়ে থাকে। খানিকক্ষণ পর আশেপাশের নিস্তব্ধ পরিবেশ যেন তাকে প্রশ্নের উত্তরটা দিয়ে দেয়।
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ভেসে আসে, জীবন মানে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের খেলা…….।

আর সিফাতের মন বলে ওঠে, তেমনি জীবন মানে অপেক্ষা….. অপেক্ষা…..

জানালার গ্রিল থেকে ফিরে সিফাত কাগজ-কলম নিয়ে তমাকে একটা চিঠি লিখা শুরু করে।

প্রিয় তমা,

বুকের ভিতর কেমন যেন করছে আমার। কোন কোন রাতে এমন হয় । কোন কিছুই করতে ভাল লাগে না; না গল্প করতে, আড্ডা দিতে, না ঘুমোতে, না গল্পের বই পড়তে। ফাঁকা ফাঁকা লাগে সবকিছু- মাথার ভিতর, বুকের ভিতর, আশেপাশের চারপাশ। তাই আপনাকে চিঠি লিখতে বসলাম। ভয় হয় চিঠির মূল্য না দিয়ে যদি অবঙ্গা করেন ? কারণ আমি শুধু আমার কাছের মানুষগুলোকেই চিঠি লিখি। খুব যত্ন করে লিখার চেষ্টা করি। তবে আজকে চিঠি লিখার প্রয়াসটা যতটা না শখের বসে তার চেয়ে বেশি প্রয়োজনের। যতদূর মনে পড়ছে, এটা আপনাকে লিখা আমার দ্বিতীয় চিঠি এবং এটাই শেষ। একটা কথা কি জানেন, আমি আমার কাছের মানুষগুলোকে খুব ভালবাসি। আমার কাছের মানুষগুলো আমায় যতটা ভালবাসে, আমায় যতটা ঘৃণা করে তার চেয়েও বেশি। হ্যাঁ, তার চেয়ের বেশি…………

একটা সময় ছিল যখন আকাশে পাখি উড়ে যেতে দেখলে বেশ আনন্দ হত। এখন তাদের দেখলে আমার চোখে জ্বল এসে যায়। মাঝে মাঝে আবার বাবুই পাখি হতে ইচ্ছে করে। সবকিছু শেষ হয়ে গেলেও, আবার নতুন করে সবকিছু গোছানোর স্পর্ধা দেখাতে ইচ্ছে জাগে। আবার যখন মন বিষন্নতায় ডুবে যায় তখন কেবলই ঐ দূর নীলিমায় নিষ্ফলক তাকিয়ে থাকি আর নিঝের ব্যর্থতা গুলোর কথা ভাবি। কোন এক গল্পের বইতে পড়েছিলাম,
“মেয়েরা নাকি সারাজীবন অপেক্ষাই করে যায়……”

কথাটা শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রেই সত্য তা নয়, পুরুষদের ক্ষেত্রেও সত্য। তবে একান্তভাবে আমরা যে জিনিসটার জন্য অপেক্ষা করি তা হল, প্রিয়জনকে পাশে নিয়ে তার সাথে সুন্দর একটি মুহূর্ত কাটানো……..। কিন্তু আজ আমার ভালবাসার মানুষকে নিয়ে স্বপ্নগুলো আলো-ছায়ায় হারিয়ে গেছে। রঙ্গিন স্বপ্নের মাঝে জলবিহীন বিষাদ-মরিচীকা প্রবেশ করেছে কবেই; যা আজ শুধুই গল্প।
আপনার সাথে আমার যতই ঝগড়া হোক না কেন, আপনি প্রতিশোধ হিসেবে যা কিছুই করেন না কেন, তবুও আমি এখন আপনাকে অনেক বেশি শ্রদ্ধা করি। তার থেকেও বড় কথা, আপনাকে আজও বড্ড ভালবাসি। কারন একটাই, মানুষ তার প্রথম ভালবাসা কখনোই ভুলতে পারে না। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমিও ভুলি নি, অতি যত্ন নিয়ে মনে রেখেছি। আপনার সাথে যখন ঝগড়া চলছিল অনেক দিন আগে তখন একদিন আমায় এসএমএস এ লিখেছিলেন,
“আমি জানি, আপনিও আমায় এখনো ভালোবাসেন……”

বিশ্বাস করুন, সেই দিন এই এসএমএসটা পড়ে বেশ হাসি পেয়েছিল। তবে আজ বুঝতে পারি, আপনার কথাটাই সত্য ছিল। এবার দেশে আসার পর আমি সবচেয়ে বেশি যেই জিনিসটা মিস করেছি সেটা হল আপনার সঙ্গ, এমনকি কারনে-অকারনেও আপনার কথা ভেবেছি। যে কোন একটা জিনিস ভাবতে শুরু করলেই তার সাথে আপনার একটা সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করতাম। যেমন, সেদিন দেখলাম বাইক এ চড়ে একজন ভাই তার মনের মানুষকে নিয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। আর তার মনের মানুষটি অসীম বিশ্বাস আর নির্ভরতায় তার হাতখানা নিয়ে প্রিয়মানুষটির ঘাড় শক্ত করে চেপে ধরেছে। দৃশ্যটা দেখে ভাবলাম, আমার উপরও যদি আপনার এরকম বিশ্বাস থাকতো….!!!!! মানুষ দূরে চলে গেলে বোঝা যায় সে হৃদয়ের কতটা জুড়ে ছিল যা কাছে থাকলে মাঝে মাঝে বোঝা যায় না।

কিন্তু পরিস্তিতি যেখানে প্রতিকূলে সেখানে মানুষের চাওয়া-পাওয়ার মূল্য কতটুকু বলুন ??? আজ আমার ইচ্ছে করছে, আপনার কাছে গিয়ে আপনার হাত ধরে পৃথিবীর সমস্ত অধিকার নিয়ে বলি, “ তুমি শুধুই আমার……..আমার। আমায় একা করে চলে যেয়ো না। তুমি তো জান না, আমার ভালবাসার পুরোটা জুড়ে শুধুই তুমি”।
কিন্তু আমি জানি, এ কথাটা আমার আপনাকে বলা হবে না। কোন দিন না। আর তাই তো, শত অনিশ্চয়তার মাঝে না হয় আমার স্বপ্ন, আমার ইচ্ছেটাকেই বিসর্জন দিলাম।

পরাজিত মানুষের জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই রকম। তারা সারাজীবন ভাবে এক-রকম, স্বপ্ন দেখে এক-রকম কিন্তু তাদের সাথে ঘটে আর এক-রকম। আর স্বপ্ন ভাঙতে ভাঙতে একসময় তাদের নীল হয়ে যাওয়া।

এবার দেশে ফেরার পর থেকেই আমি আপনার সাথে যোগাযোগ করার সাহস যোগাড় করছিলাম। কিন্তু পারি নি। অবশেষে আমাদের কথা হয়েছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনাকে এসএমএস দিয়েছি। শেষে আপনি একদিন বললেন, আপনি আপনার এংগেষ্টমেন্ট ছিন্ন করে আমার কাছে ফিরে আসবেন। আমিও আপনাকে প্রচন্ড ভালবাসি, তাই এ কথাটা শুনার পর নিশ্চই আমার থেকে বেশি খুশি হওয়ার কথা, তাই না ???? অথচ, আপনি এই কথাটা বলার পর আমি প্রতিটি বিষয় অতি সময় নিয়ে ভেবেছি। আপনি আমায় বলেছেন, আপনার এংগেষ্টমেন্ট এর খবর নাকি আপনার মা, খালা সহ আরো অনেকেই জানে। তাই এ সময় আপনার এংগেষ্টমেন্ট ভাংলে আপনার পরিবার কষ্ট পাবে। কথাটা বাইরে জানাজানি হলে খারাপ হবে। তাই আমি অনেক ভেবে নিজেই কষ্ট বরণ করে নিলাম। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, না আপনার কাছে আসার বা আপনাকে ফিরে পাওয়ার চিন্তা আমার মাথায় রাখবো না। আপনিতো বলেছেন, আপনার নতুন মনের মানুষটি আপনাকে অনেক ভালবাসে। আর তাই আপনারতো কোন ক্ষতি হচ্ছে না। অথচ যখন আপনাকে বললাম, যে আপনি আপনার বর্তমান মানুষটির কাছেই থাকেন, তারপর আমি মনের মাঝে একপ্রকার ব্যথা অনুভব করেছি। অনেকটা পাঁজড় ভাঙ্গার মত ব্যথা। যেন আপনাকে ছাড়া আমার চলবেই না। তাই আপনাকে আমি আবার এসএমএস পাঠিয়েছি, যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। বিশ্বাস করুন, আমি তখন কেমন যেন পাগল হয়ে গিয়েছিলাম ! অথচ আপনাকে আর খুঁজে পাই নি….. গভীর ভাবে দেখতে গেলে, সবদিক দিয়ে আমিই হেরে গেলাম। আপনার পরিবারের মানুষের কথা, আপনার কথা, বৃহত্তর মানুষের সুখের কথা ভাবতে গিয়ে আমাকেই সবকিছু হারাতে হল। আপনার পরিবারের আনন্দের কথা ভাবার কারনে আপনি আমাকেই খারাপ ভাবছেনতো, এ নিয়ে আমার আফসোস নেই। জানেন, মাঝে মাঝে ভাবি - পৃথিবীটা কত এগিয়ে গেছে, অথচ আমি এখনো বুঝি সেকেলেই রয়ে গেলাম ! আমার চিন্তাভাবনা গুলোও বুঝি সেই পুরোনো আমলের মানুষের মতোই রয়ে গেল !!! নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে অন্য সব মানুষের আনন্দের কথা ভাবা, প্রিয় মানুষের পরিবারকে নিজের পরিবার ভাবা ইত্যাদি এ যুগে বোকামি ছাড়া বুঝি আর কিছু না।

মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ কি বলতে পারেন ? মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ হল সরলতা। এই সরলতা এমন একটি গুণ যার মাঝে থাকে না কোন ভণিতা, কোন স্বার্থ, কোন উদ্দেশ্য……… স্পৃহাহীণ আমি এক অদৃশ্য পরিচালকের আঙ্গাবহ দাস। নিজেই নিজের জন্য যে গোলক ধাঁধা তৈরি করেছি তা থেকে কি চাইলেই আমি বের হয়ে আসতে পারি ??? না, পারি না। বাইরে থেকে কি বোঝা যায় একটি মানুষের ভিতরে কি চলছে ? না, যায় না। আমার মাঝে যে একটি নয় হাজারো পলিপ আছে তা আমি জানি। আর এক একটি পলিপ তৈরি হয়েছে এক-একটি ভুলের জন্য, এক একটি ব্যর্থতার জন্য, কাছের মানুষগুলোর কাছে থেকে অবহেলা পাবার জন্য, কাছের কিছু বন্ধুদের দ্বারা বারবার Betray এর স্বীকার হওয়ার জন্য…

কবিতা পড়তে আমার খুব ভাল লাগে। এটি আমার একটি অতি প্রিয় কবিতা। না, আমি লিখি নি, সংগৃহীত…

কি দেব তোমায় বল ?
আমি যে মেঘ নই যে তোমায় বৃষ্টি দেব
আমি অসীম নীলিমাও নই যে তোমায় স্নিগ্ধতা দেবো
আমি এক ব্যথিত মানুষ, এমন হৃদয় ভরা ভালবাসি কই ?
আমার ঘরে ফুল ফোটাব, কখনো হাসির রাশি দেব উপহার
তার মত কিছুই তো নেই !!!!!
আমার হাতদুটি এত আলোকিত নয় যে,
অসুখী শরীরে ছোঁয়া দেব আর সেরে যাবে তোমার সব অসুখ।
আমিতো শিশির নই যে তোমার রুক্ষপত্র সিক্ত করবো
আমি কোন কুলুকুলু নদী নই যে,
তোমার হৃদয়ের শস্যক্ষেত ভিজিয়ে দেবো।
এমনকি কোন অরণ্য উদ্ভিদ নই যে,
তোমার দুঃখের পাশে ফুটেঁ থাকবো চাঁপা কি বকুল হয়ে।
আমি কোন শিউলি নই তোমার, ভোরের শুভ্র শয্যা বিছাব।
আমি কোন তৃণ নই যে, বুক পেতে দেব মাথা রেখে অবসাদে শোবে।
এমনকি ঝড়া পাতাও নই যে, বন হবো
ভালবেসে টিপটাপ সারারাত ঝড়বো তোমার সিথানে।
আমি শুধু দিতে পারি ………………… একগুচ্ছ কষ্ট ।।


মাঝে মাঝে যখন খুব একা লাগে তখন চোখ বন্ধ করে প্রাণপনে ভাবতে চেষ্টা করি, “আমার ভালবাসার মানুষটি নীল রঙের শাড়ী, হাতে কাঁচের চুড়ী, কপালে ছোট্ট ঠিপ, ঠোঁটে হালকা লিপষ্টিক, খোঁপায় বেলী ফুলের মালা পড়ে আমার পাশে এসে বসেছেন। হাসিমুখে আমার হাতখানা আলতো করে নিজের দুই হাতের মাঝখানে নিয়ে গল্প করছে আর আমি পূর্ণ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছি !” এভাবে ভাবতে ভাবতে আমায় কখনও কখনও এই ভাবনাটাকে বাস্তব বলে মনে হয়। যেন আমি তার গন্ধ পাই, তার স্পর্শ অনুভব করতে পারি।

উচ্ছলতায় ভারা দিন গুলোতে যেমন ছিলাম, এখনও সেই দিন গুলোর মুখোমুখি হলে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করি। তবুও মনের এককোণায় একটা বিষন্নতা সর্বদাই থাকে। অন্যসব পরাজিত আর ব্যর্থ মানুষের মত আমিও তাকিয়ে আছি অনাগত ভবিষ্যতের দিকে, অপেক্ষায় আছি একটি সুন্দর মুহুর্তের, একটুকরো সুখের……।

হয়ত একদিন আমার জীবনেও স্থায়ী ভাবে আসবে কোন এক নারী – ভালবাসার আলোকবর্তিকা নিয়ে। আর সেদিন পর্যন্ত পৃথিবীর

সমস্ত ভালবাসা বুকে নিয়ে আমার তাঁরই জন্যে অমলিন অপেক্ষা- যে হবে সেই মুহুর্তে আমার অতি আপনজন……..।
কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাওয়া ঠিক না। এতে কেবলই কষ্ট বাড়ে….. জীবনে আমি অনেক ভুল করেছি। মাঝে মাঝে মনে হয় ভুল কোন জীনিসই জীবনে রাখতে নেই। আমরা প্রতিটি স্বতন্ত্র মানুষের কাছে জীবনের অর্থও ভিন্ন ভিন্ন। চারদিকে অসংখ্য ভুলের ছড়াছড়ি। প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা, প্রবঞ্চিতকে দেয় দাহ আর অনুতপ্তকে কি দেয় জানেন ?

প্রেম, অনুতপ্তকে দেয় হাহাকার। তীব্র হাহাকার, পাঁজর ভাঙার মত হাহাকার……………… এই হাহাকার সঙ্গী করেই আমি হাঁটছি……. বহু পথ যেতে হবে আমায়……

আজ চমৎকার জ্যোৎনা উঠেছে। আকাশের ঠিক মাঝখানে যেমন মায়াবতী নারীরা কপালের ঠিক মাঝখানে টিপ পড়ে, তেমনি ফুঁটে আছে চাঁদ মামা। আর সূর্য থেকে আলো নিয়ে তাকে জ্যোৎস্নায় রূপান্তরিত করে আমারদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে। চারদিক জ্যোৎনার বন্যায় ভেসে যাচ্ছে।আমার মত ঘূণেধরা,আট-পৌরে মানুষগুলো - যারা হাজারো পলিপ নিয়ে চলে, তারাও আজ জ্যোৎনার রূপালী আলোয় নিজের ছায়া দেখতে পায় যেমন করে আমি পাচ্ছি। সব মানুষ, দালানকোঠা, জীবজন্তু, পশুপাখি ইচ্ছেমত জ্যোৎস্না গায়ে মেখে আনন্দে অবগাহন করছে। ব্যর্থ আর ঘূণে-ধরা মানুষগুলো আকাশের দিকে তাকিয়ে জ্যোৎস্না গায়ে মাখতে মাখতে ভবিষ্যতের স্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়। নিজের গোলাপ পূর্ণ হৃদয় সম্পূর্ণ সমর্পণ করতে চায় ভালবাসার মানুষটিকে আর ভালবাসার মানুষটিকে আলিঙ্গন করে অন্তহীণ সুখ অনুভব করতে চায়। আমার কাছে যদিও সুখটির চেয়ে স্বপ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। কারন সুখের স্বপ্ন, সুখের চেয়ে প্রলম্বিত। সুখ মুহুর্তের আর স্বপ্ন ……………???

স্বপ্নতো চিরদিনের…………… চিরকালের……………

ভাল থাকবেন। শুভ হোক আপনার জীবনের প্রতিটি দিন- আপনার কাছের মানুষদের সাথে নিয়ে আর ভালবাসার মানুষটির অকৃত্রিম ভালবাসায়….. আমিন, আমিন, আমিন।

ফেলে আসা গোধুলীতে হল না আর ফানুস উড়ানো
ভুলের স্রোতে ভুলে গিয়ে তোমারো দেয়া হয় না আর হাতছানি
আমারি স্বপ্নের আকাশ আজ কৃষ্ণসাজে সাজলো
আর হবে না পিছু ফিরে দেখা জীবনের গ্লানি।


ইতি
সিফাত

সিফাতের ফ্লাইট এর সময় হয়ে যাচ্ছে। তার সাথে দেখা করতে এসেছে সোনিয়া নামের একটি মেয়ে। মেয়েটা সিফাতকে অনেক ভালবাসে। সিফাতের পছন্দ-অপছন্দ, ভাললাগা সবকিছুই সে জানে।

চলে যাওয়ার আগে মেয়েটি সিফাতকে বলে,
“ ভাইয়া ! আমার অসীম ভালবাসার বিনিময়ে হলেও কি আপনি আমায় একবিন্দু ভালবাসা দিতে পারবেন না ???”

মাথা নিচু করে ফেলে সিফাত। পড়া না পারা ছাত্রের মত বলে, “একজনের ভালবাসায় আমার হৃদয়টা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে আছে। আর একজনের ভালবাসা আমি কোথায় রাখবো ? আর আমি যে আমার ভালবাসাটুকু একজনকে দিয়ে দিয়েছি কবেই। আজ তোমাকে দেওয়ার মত আমার কাছে কিছুই নেই। আমার ক্ষমা করো’।

কথাটা বলেই সিফাত গাড়িতে উঠতে এগিয়ে যায়। পেছনে মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। কান্নার জ্বলে মেয়েটির চোখের কাজল লেপটে গিয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে।

গাড়ি এয়ারপোর্ট এর দিকে চলছে। সিফাত এর পাশে বসে ওর একটা হাত ধরে রেখেছে সজীব। যেন কিছুতেই কাছের মানুষটিকে চলে যেতে দিবে না। কী মনে করে যেন সজীব একটু পর পরই কেঁপে উঠছে।

সিফাত বুঝতে পারে কিন্তু কিছু বলে না…… যেন নীরবতা পালনের এক খেলায় নেমেছে সবাই।

বোর্ডিং হয়ে গেচে। সিফাত এবার ইমিগ্রেশনে দাড়াবে। যাওয়ার আগে সে শেষ বারের মত সমস্ত আবেগ নিয়ে সজীবকে জড়িয়ে ধরে আর চিবুক বেয়ে দুজনের চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা গরম জ্বল বেড়িয়ে পড়ে। এরপর ব্লেজারের পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে সজীবের হাতে দিয়ে বলে, পারলে এটা তমাকে পাঠিয়ে দিস। ….

প্লেনের সিটে বসে সিফাত তমাকে এসএমএস লিখে….

আমি তোমায় কতটা ভালবাসি তা তুমি কোন দিন জানবে না, কোন দিন না। ‘যে থাকে আঁখি পল্লবে তার সাথে কেন দেখা হবে; নয়নের জ্বলে যার বাস- সে তো রবে নয়নে নয়নে’। তুমি আমার দৃষ্টিসীমার মাঝে বেঁচে থাকবে অনেক অনেক দিন।

প্লেনের ক্যাপ্টেন ঘোষণা দিল, এখনই তারা যাত্রা মুরু করবে। সিফাত শেষবারের মত এসএমএসটা তমা’র নাম্বারে পাঠিয়ে মোবাইলটা বন্ধ করে দিল।

ধীরে ধীরে প্লেন রানওয়ে পার হয়ে আকাশে উড়তে শুরু করল।

সিফাত মনে মনে তমার কথা ভাবছে। তার মন তাকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা তমা কি চিঠি বা এসএমএসটা পাবে ???

মুচকি হাসে সিফাত। মনে মনেই উত্তর দেয়, পাক বা না পাক তবুও…… অপেক্ষা।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, কষ্টকে যে পুষে রাখতে চায়, ব্যথার শাস্তি তার চিরদিনের।

আজন্ম স্বপ্নের বিসর্জন দিয়ে, কিভাবে শূন্যতা নিয়ে বেঁচে থাকা যায় তাই এবার শেখার পালা……….

Friday, October 21, 2011

আকুতি

উৎসর্গ…
মোঃ তৌফিক আরমান
আমার এই ভাইটা বেশ সরল।
বাইরের স্বার্থে ভরা পৃথিবীর অনেকটাই তার অজানা।
কোনদিন বলতে পারি নি, কত ভালবাসি তোকে…….
জানবি না……কোনদিন জানবি না……


আচ্ছা রাহুল ভাইয়া, চাচ্চু কতদূর ??? সেই গতকাল রাতে ঢাকা রওনা দিয়েছে, কিন্তু এখনো পৌছায় নি। একটু কল দিয়ে খবর নেন না প্লিজ…

তুইতো ঠিক-ই বলছিল। বাবা তো এখনো পৌছালো না !!!
সাথে সাথে মোবাইলটা হাতে নিয়ে রাহুল তার বাবাকে কল দেয়।
হ্যালো বাবা, আসসালামু আলাইকুম। কতদূর তুমি ? এখনো পৌছালা না !!!
এখন আমি সাভার পার হচ্ছি বাবা। আর হয়ত এক-দেড় ঘন্টার মধ্যে পৌছে যাব।
ফোন রাখার পর রাহুল কেমন যেন আনমোনা হয়ে যায়। বাসার ড্রইং রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। তার দুষ্টি যেন একজায়গায় স্থির হয়ে গেছে।

নীরব কখন যে তার পেছনে এসে দাড়িয়েছে সে টের-ই পায় নি। আলতো করে নীরব তার হাতখানা রাহুলের কাধেঁর উপর রাখে।
কী ভাবছেন ভাইয়া ??? বেশ ক্ষীণ কন্ঠে নীরব জিঞ্জেস করে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাহুল বলে, কিছু না রে…! বাবার কথা ভাবছি….
বয়স হয়েছে মানুষটার। তবুও সারারাত জার্নি করে ঢাকায় এসে, সারাদিন কাজ করে আবার রাতের কোচে বাড়ি ফেরে। কত কষ্ট হয়, তাই না রে …
ঠিক-ই বলেছেন ভাইয়া। চাচ্চুর বেশ কষ্ট হয়। তবে চাচ্চুকে থাকতে বললেও থাকে না। তিনি আবার রাতের কোচে চলে যায়।
বেশ করুণ স্বরে নীরব ডাকে, ভাইয়া …..!!!
বেশ ধীরে মাথা ঘুড়িয়ে রাহুল বলে, বল ।

চাচ্চুর শরীর বেশ খারাপ। কাউকে কিছু বলেন না। ডাক্তারও দেখাতে চায় না। তবে কিছুদিন আগে জোর করে ডাক্তার দেখানো হয়েছিল। আপনি কি জানেন, চাচ্চু অনেক গুলো ঔষধ খায় ? যতদূর শুনেছি তিনজন ডাক্তারের ঔষধ খেতে হয় তাকে।
রাহুল মাথা নিচু করে কথা গুলো শুনচ্ছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতার ঘরে প্রবেশ করছে। তবুও এই বাতাসকে রাহুলের বড্ড বেশি অসহ্য মনে হচ্ছে।

হঠাৎ একটুকরো বিষন্নতা এসে ঠাঁই নিল রাহুলের মনে। আর ধীরে ধীরে সেটা ছেয়ে গেল তার সমস্ত চেতনায়, সমস্ত অস্তিত্বে……
কিছু ভাল লাগছে না। সবকিছুর মধ্যেই যেন কিছুটা অসম ভাব আছে। কেবলই অন্তরের অন্তঃক্ষরণ এর মাঝে বাস করা।
এমন সময় রাহুলের মোবাইল বেজে ওঠে। তার বাবা ফোন করেছে।
দরজা খুলতেই রাহুল তার বাবার হাতের ব্যাগটা আর অন্যান্য জিনিসপত্র নিজের হাতে নেয়।

হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে এসে তিনি নাস্তা খাওয়া শুরু করেন।
বলেন, দুপুর হয়ে গেছে অথচ কিছুই খাই নি। খুব ক্ষিদে পেয়েছে।
রাহুল ক্ষীণ কন্ঠে তার বাবার জন্য হাফ কাপ চা বানাতে বলে। নাস্তা খাওয়া শেষ হলে রাহুলের বাবা সোফায় বসে চা খাওয়া শুরু করেন আর সিগারেট ধরান। আর আস্তে আস্তে গল্প জুড়ে দেন অনেকদিন পর দেশে ফেরা তার ছোট সন্তান রাহুলের সাথে। আর তার পাশে আছে তারই চাচাত ভাই নীরব।

অনেকক্ষণ গল্প করার পর রাহুলের বাবা, নীরব আর রাহুলের সাথে দুপুরের খাবার খেয়ে বাইরে বেড়িয়ে পড়েন কাজে। রাহুল আনমনে তাকিয়ে থাকে তার বাবার দিকে।

একজন মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে যান্ত্রিক শহরে তার পরিবারের জন্যে হালাল রিযিক উপার্জনের উদ্দেশ্যে। বয়সের ভার আর দায়িত্ববোধের চাপে তিনার ঘাড় একটু নুয়ে পড়লেও তিনি চলছেন তার মতই……সারাদিন রৌদ্রে বেড়ানোর জন্যে শ্যাম বর্ণের মানুষটির মুখ আরো একটু ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বয়সের কারনে চোখের চশমাটার পাওয়ার আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবুও নিজের সাধ্যমত তিনি পরিশ্রম করে যাচ্ছেন……….
একেই হয়ত বলে পিতা….. পিতার পিতৃত্ব…… কিংবা দায়িত্ববোধ ….

রাত প্রায় ১০.৪৫ বেজে গেছে ঘড়িতে, কিন্তু এখনও রাহুলের বাবা বাড়িতে ফেরেন নি। অবশেষে রাত ১১.১৫ এর দিকে তিনি বাসায় ফেরেন। বাসায় ফিরলেই, রাহুল বেশ যত্ন নিয়ে তার বাবাকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এগিয়ে দেন।
রাতের খাওয়া শেষ হলে রাহুলের বাবা সোফায় বসে সিগারেট ধরান।
রাহুল ধীর কন্ঠে বলেন, বাবা ! বয়স হচ্ছে। এখন একটু সিগারেট খাওয়াটা কমানো দরকার।
রাহুলের বাবা সাথে সাথেই বলেন, হ্যাঁ কমানো দরকার, জানি। তুমিতো বাসা আসছোই। তখন একটু একটু করে কমাবো ইনসাল্লাহ।
আমিতো বাবা মাত্র কয়েকদিন থাকবো। এর মাঝে কি কমাতে পারবে ???
হ্যাঁ পারব। তুমি বললে ঠিকই পারবো।

চল বাবা, তোমার ঔষধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তুমি ঘরে যাও আমি পানি নিয়ে আসছি।
রাহুলের বাবা ঘরে গিয়ে ব্যাগ থেকে ঔষধ বের করেন। রাহুল একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে বলে, এগুলো কিসের ঔষধ ???
এগুলো টাইফয়েড এর ঔষধ বাবা।
পরের প্যাকেটটা খুলতেই রাহুলের বাবা বলে, এগুলো দাতেঁর ব্যথার ঔষধ। এই প্যাকেটের ঔষধ খাওয়ার পর তিনি বলেন আরো ঔষধ আছে।

আরেকটা প্যাকেটের ঔষধ ফুড়ে তিনি হাতে নেন। রাহুল পানির গ্লাস টা তিনার দিকে এগিয়ে দেন। নিজের বাবা কতটা অসুস্থ হলে এতগুলো ঔষধ খেতে হয় তাই ভাবছে রাহুর। অজানা কারনে তার চোখের কোণায় পানি জমতে শুরু করেছে।
ঔষধ খাওয়া শেষ করে তার বাবা বিছানায় শুলে, রাহুল বলে, বাবা তোমার পা’গুলো কি আমি একটু চিপে দেব তাহলে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে পারবেন ???
না, না লাগবে না বাবা। আমি এমনিতেই ঘুমোতে পারব। তুমি কখন ঘুমাবা ???
আমি এখন গোসল করে এশার নামায পড়ব, তারপর ঘুমাব।

তারপর রাহুল গোসল সেরে এশার নামায আদায় করে। ড্রইং রুমে চারপাশে বেশ অন্ধকার। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। চারদিক কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগছে রাহুলের।

জানালা দিয়ে ক্ষীণ আলো ঘরে প্রবেশ করছে। রাহুল এই ক্ষীণ আলোর মাঝেই নিজের ছায়া দেখার চেষ্টা করছে। আজ রাহুলের নিজেকেই বড্ড বেশি অচেনা মনে হচ্ছে। চারদিকের অন্ধকার আর রাতের নিস্তবদ্ধতায় রাহুল কেঁপে ওঠে।

আকুল হৃদয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে আর তার চোখের কোণা দিয়ে গরম, দগ্ধ জ্বল গড়িয়ে পড়ে নীরবে। আকুল হৃদয়ে প্রার্থনা করে, আল্লাহ তুমিতো সবার মনের খবর জানো, সবার কষ্টের কথা গুলো জানো। তবে কি তুমি পারো না আমাদের সবার কষ্টগুলো একচিলতে দূর করে দিতে। তোমার কত ক্ষমতা !!! তুমিতো বলেছ, বান্দা আমাকে যেমন মনে করে আমি তার কাছে তেমনই।

আমি রিক্ত, নিঃস হাত তুলে তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, আমার বাবাকে তুমি সুস্থ করে দাও। আমার বাবাকে তুমি সুস্থ করে দাও প্রভু। আমাদের ভুল কৃতকর্মের জন্যে তুমি আমাদের এতবড় শাস্তি দিও না খোদা, দিও না……….
রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। কিন্তু রাহুল এখনো নামাযে দাড়িয়ে মুনাজাত করছে।
আর চোখের গরম জ্বল রাহুলের চিবুক বেয়ে একটু একটু করে গড়িয়ে পড়ছে রাতের নিস্তবদ্ধতায়…….

Tuesday, September 13, 2011

পার্থক্য...

উৎসর্গ…
এঞ্জেল অঙ্গনা…
আমায় বড় ভাইয়ের মত মানে। অতি চমৎকার করে অধিকার
নিয়ে কথা বলে সে! আমি তন্ময় হয়ে শুনি। বেশ ভাল লাগে।
সাধারণের মাঝেও একটু অন্যরকম। পার্থক্য করা যায় সহজেই !


কী চমৎকার জ্যোৎস্না উঠেছে দেখ ?
অন্ধকারে জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোয় বৃক্ষগুলোকে মনে হচ্ছে তারা যেন সাক্ষীর মত দাড়িয়ে আছে। পাতাগুলো স্থির, আবার কোনটা মাঝে মাঝে দুলছেও।
হয়ত আমাদের বলে দিচ্ছে, হে মানব সমাজ, তোমাদের শত অবহেলা সহ্য করেও আমি বিশ্বাসী বন্ধুর মতই তোমাদের পাশে আছি……..বেঁচে আছি।
অল্প অল্প কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে চারপাশের পরিবেশ। স্রস্টার অসীম করুণা বয়ে যাচ্ছে অবিরত।
পুথিবীর সব কিছুকেই কেমন যেন নির্ভার মনে হচ্ছে। কোন দায় নেই, কোন দায়িত্ব নেই…… কেবলই ভাবলেশহীণ ভাবে বেঁচে থাকা……..
আচ্ছা রোকন, বলতো আমার মনের ভেতরটায় এমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেন ???
যেন বুকের ভেতরটায় কেউ একজন ছিল, যে আজ ভেতরটা শূন্য করে চলে গেছে।
আজ, সেই মানুষটাকে বড্ড বেশি মনে পড়ছে। যদিও মনে রাখার মত সে অনেক কিছুই করেছে !!!
কোথায় যেন পড়েছিলাম,
“দুই উপায়ে মানুষের মনে জায়গা করা যায় সহজে- এক, বিখ্যাত হয়ে, দ্বিতীয় কুখ্যাত হয়ে’’
অথচ কী আশ্বর্য !!! আজ আমার নাদিরাকেই বেশি মনে পড়ছে। মনে পড়ছে তার মানবীয় কাজ গুলোর কথা।
রোকন জিঞ্জেস করে, আচ্ছা তোদের মাঝে বিচ্ছেদ কেন হলো ???
আমি কিছু বলি না। কেবল তাকিয়ে থাকি শূন্যতা নিয়ে ওই দূর নীলিমায়…….
আমি খুব সুন্দর করে নাদিরাকে ভালবাসার চেষ্টা করেছিলাম। আমার দিক থেকে যথেষ্ট responsible, careful থাকার চেষ্টা করেছিলাম।
সব-ই ছিল, কেবল ছিল না আমার প্রতি ওর বিশ্বাস।
সে মানুষের কথায় বিশ্বাস করত, অথচ আমার কথা বিশ্বাস করত না। বাইরে কার কাছে কি শুনে আমায় এসে বলত, আমার বাবা নাকি পরকীয়া করে, আমি নাকি জারজ সন্তান। সহ আরো অনেক খারাপ কথা। এমনকি আমাকে নিয়েও বাজে বাজে কথা বলতে সে দ্বিধাবোধ করত না।
আমি চেষ্টা করতাম সেগুলো ঠান্ডা মাথায় শুনতে । কারন, মানুষ রেগে গেলে উল্টোপাল্টা বলে, এটাই স্বাভাবিক।
আর আমাদের মাঝে ঝগড়া লেগেই থাকত। একটা জিনিস কি জানিস, জোর করে ভালবাসা হয় না।
পরে অবশ্য সে স্যরি বলত. কিন্তু এতটুকু তো বোঝা যায়, কে স্যরি অনুতপ্ত হয়ে বলে আর কে মন রক্ষার্থে বলে…….
অনেক ঝগড়া আর ঝামেলার পর আমাদের ব্রেক আপ হয়ে যায়। এর পরও সে সুযোগ পেলেই আমার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করত।
আমি একদিন বড় ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলাম এ বিষয়ে। আমি তাকে বলেছি, ভাইয়া আমি নাদিরাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। কারন সবাই ক্ষমা করতে পারে না। যারা পারে তারা সত্যিই ভাগ্যবান। তবে ভুলে যাই নি তার দেওয়া কষ্টগুলো। ভুলে গেলেতো আর শিক্ষা নেওয়া হবে না, তাই না ?
রোকন তন্ময় হয়ে কথাগুলো শুনছে। আচ্ছা, এখন তার খবর কি জানিস ???
জানি। এখন সে অন্য একটি ছেলের সাথে প্রেম করে। সেই ছেলেটা একদিন ফেইসবুকে আমায় রিকুয়েষ্ট পাঠায়। আমি বুঝতে পারি সে কে। পরে একদিন তার সাথে চেট করি।
সে আমায় অনেক প্রশ্ন জিঞ্জেস করে, কেন আমাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে গেল, আমার কি দোষ ছিল, নাদিরা কেমন মেয়ে ইত্যাদি।
আড়মোরা ভেঙ্গে চোখ বড় বড় করে রোকন তাকিয়ে থাকে আমার দিকে ! !
তুই কি বললি তখন ???
আমি ওকে বলেছি, নাদিরা খুব ভাল মেয়ে। আসলে আমার কারনেই আমাদের সম্পর্ক ভেঙ্গেছিল। আমি খুব রাগী একটা মানুষ আর আমাদের মাঝে মতের মিল ছিল না। নাদিরা অনেক চেষ্টা করেছে সমঝোতা করার, ভাল লাগানোর কিন্তু আমিই পারি নি !!!!!
রোকন বলে, তুই এই মিথ্যে কথা গুলো বললি কেন ????
আমি মিথ্যে বলিনি বন্ধু। আসলে কোথায় যেন পড়েছিলাম, “কারো সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে তার সম্পর্কে ভাল ভাল কথা বলতে হয়”।
আমি যা শিখেছি তাই বলেছি আর কি। আর নাদিরা সত্যিই একটা ভাল মেয়ে ।
কথাটা শুনে রোকন কিছুটা রেগে যায়। আমি তোকে সত্যিই বুঝি না। তুই একটা পাগল……বদ্ধ পাগল……..
আমি সব শুনে কেবলই হাসি আর তাকিয়ে থাকি……… আর জ্যোৎস্না গলে গলে পড়ছে……..
স্টুয়ার্ট ফক্স নামের একজন ব্যক্তি তার এক বন্ধু সহ অস্ট্রেলিয়ার একটি বুফে-তে খেতে গিয়েছিল। খাওয়া দাওয়া শেষ করার পর স্টুয়ার্ট আর তার বন্ধু বিল পে করে চলে আসছিল। নিজের সেল ফোনটা ভুলে রেখে আসায় স্টুয়ার্ট আবার বুফেতে সেই টেবিলে যায়। সেলটা নিয়ে ফেরার সময় ঘটে যায় দূর্ঘটনা। মেঝেতে একটু পানি পড়েছিল তা কেউ লক্ষ্য করে নি। আর স্টুয়ার্ট সেখানে পা পিছলে পড়ে যায়। এরপর সে ক্ষতিপূরন এর জন্য আদালতে মামলা করে। আদালত তার মামলায় বুফে কর্তৃপক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করে। এরপর ওই বুফে কর্তৃপক্ষ স্টুযার্টকে ১০০০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার ক্ষতি পূরণ দেয়।
আরেকটা ঘটনা বলি……..
আমি সেদিন কলেজগেট থেকে হেঁটে আসছিলাম। রাত প্রায় ৯ টা বাজে। একজন আপু মেডিকেলে পড়ে, মনে হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ইন্টার্নী করছে। তিনি হেঁটে আসছিলেন। সে সময় আশা ইউনিভার্সিটির সামনে প্রচন্ড জ্যাম লেগেছিল। ইলেকট্রিসিটি না থাকায় রাস্তার আশেপাশে বা নিচে গর্ত আছে কি না তা বোঝা যাচ্ছিল না। আশা ইউনিভার্সিটির একটু আগে রাস্তার পাশেই একটা বড় গর্ত ছিল। হঠাৎ সে আপু হাঁটতে হাঁটতে সেই গর্তের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চারপাশে গাড়ি গিজগিজ করছে। অবশেষে তিনি পা বাড়ালে তার বাম পা পড়ে যায় গর্তে। সাথে সাথেই তিনি হাউমাউ করে চিৎকার করে কেঁদে উঠেন। তিনার পা-টা যে ভেঙ্গে গিয়েছিল তা আর বোঝার বাকি ছিল না। অবশেষে পথচারিরা তাকে গর্ত থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল।
উপরোক্ত দুটি ঘটনাকে বিচার করলে আমরা দেখতে পাই, সামান্য পা পিছলে পড়ে যাওয়ার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় ক্যাফে কর্তৃপক্ষকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। অথচ আমাদের দেশের সেবা দানকারী প্রতিষ্টান যাদের দায়িত্বে অবহেলার কারনেই সেই মানুষটি গর্তে পড়ে গিয়ে পা ভাঙল তাদের কিছুই হয় না। তাদের কোন চিন্তাভাবনাও নেই এ নিয়ে। নেই সেবাদানকারী প্রতিষ্টানের মানুষের জীবন রক্ষার্থে কোন প্রচেষ্টা। থাকলে নিশ্চই তারা ওই গর্তের পাশে, সতর্ক বাণী সংবলিত কোন সাইনবোর্ড অবশ্যই লাগাতেন।
হায় !সেবাদানকারী বাইরের দেশের প্রতিষ্টান আর আমাদের দেশের সেবাদানকারী প্রতিষ্টানের মধ্যে কত পার্থক্য !!!!!!!
মার্কিন সিনেটর জন মেকেইন তার বিবাহের পরও অন্য একজন মহিলা’র সাথে সম্পর্ক রেখেছিলেন। পরে বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেলে, তিনি মিডিয়াতে ওই মহিলার চরিত্র সম্পর্কে বিভিন্ন মিথ্যকথা বলেন। অথচ যতদূর জানা যায়, ওই মহিলা সেরকম খারাপ চরিত্রের ছিলেন না।
কেন জানি আমরা মানুষেরা ইদানিং কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি। মানুষের ক্ষতি করেও এমনকি বিশ্বাসঘাতকতা করেও আমাদের কোন অনুশোচনা হয় না। আমরা যদিও সৃষ্টির সেরা জীব তবুও আমরা ভুল করবো এটাই স্বাভাবিক। আর ভুল করেই আমরা প্রমাণ করি, আমরা পরম করুণাময়ের অতি সাধারণ একটি সৃষ্টি মাত্র।
প্রিয় পাঠক, আমরা ভুল করি, সবাই ভুল করে। তবুও আমরা যেন বন্ধনের বিশুদ্ধতা আর বন্ধনের প্রতি বিশ্বাস বজায় রাখার চেষ্টা করি। ছোট-খাট ভুল যেন বন্ধনের প্রতি কোন আঁচর না ফেলে সেদিকে খেয়াল রাখি।
আমরা সবাই জানি, ক্ষমা মহত্বের লক্ষণ। আমরা মহৎ হতে না পারি, তবুও যেন মানুষকে ক্ষমা করে স্রস্টার এই গুণ-টা অর্জনের চেষ্টা করি। তবে এই ক্ষমা হওয়া উচিত তাদের জন্য যারা ভুল করে অনুতপ্ত হয়।
তাদের জন্য নয় যারা বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাদের সাথে। তবুও অদ্ভুত হলেও সত্য যে, আমরা আমাদের ক্ষমতাবানদেরও ক্ষমা করে দিচ্ছি এত কষ্ট, লাঞ্চনা, অপমান আর বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করার পরও……..
একজন সত্যিকারের মানুষ আর আমাদের মাছে পার্থক্য কতটুকু বলুন তো?????