উৎসর্গ…
আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি, এই পৃথিবীতে যে কয়টি সত্যিকারের ভালো মানুষ দেখেছি তাদের মাঝে তিনিও একজন । সৎ, নির্ভেজাল, পরপোকারী, সদা হাস্যোজ্জ্বল, পিতা-মাতার একান্ত অনুগত এই মানুষটির মাঝে অহংকারবোধের ছিটেফোঁটাও নেই। বরং বিনয়ী মানুষটির ব্যবহার আমাদের মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেয় প্রতিনিয়ত।পদ-দলিত মানবতার এই ক্রান্তিলগ্নে এ রকম মানুষগুলোর বড্ড বেশি প্রয়োজন।
প্রিয় অমিও ভাইয়া, ডাঃ অমিও, মিনহাজ রশীদ ভুঁইয়া (অমিও)
আমি প্রতিদিন প্রার্থনা করি, স্রষ্টা যেন আমায় আপনার মত একজন মানুষ হওয়ার সার্মথ্য দান করেন।
বিকেল হলেই তমা’র মাঝে অজানা এক উৎকন্ঠা কাজ করে। তখন সে কোথাও স্থির হয়ে থাকতে পারে না। সারা ঘরে কেবল হাঁটাহাঁটি করে।মাঝে মাঝে কোথাও দাঁড়িয়ে আনমনে ভাবতে শুরু করে দেয়। প্রয়োজনীয় নয়, হাবিজাবি সব ভাবনা।
এভাবে এলোমেলো ভাবে হাঁটতে হাঁটতে সে রকিবের রুমের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।
রকিবের রুমের বারান্দাটা বেশ বড়। এর এক-কোণায় দুটো চড়ূই পাখি সংসার বেঁধেছে। তমা বারান্দায় গেলেই তাদের সংসার দেখে, তাদের সাথে আলোছায়ার কথা বলে।
আরো আছে বেশ কিছু ফুলের গাছ। নীলকন্ঠ ফুলের গাছটি তমার বেশপ্রিয়। বারান্দায় আসলেই তমা বেশ খানিকটা সময় প্রগাঢ় মমতা দিয়ে নীলকন্ঠ গাছটিকে ছুঁয়ে দেয়। দূর থেকে দেখলে আপনার মনেই হবে, কোন মমতাময়ী যেন তার মমতার পরশ বিলিয়ে দিচ্ছে গাছটিকে। আরো আছে দোলনচাঁপা। এই ফুলটির প্রতি তমার আগ্রহ একটু বেশিই বটে।
তমার মা একদিন এই ফুলের গাছটিকে ফেলে দিতে চেয়েছিল। সেই কথা শুনে তো তমা একেবারে রাগে-ক্ষোভে অস্থির। কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিল। এমনকি একদিন না খেয়ে ছিল মায়ের উপর অভিমান করে !!!
প্রায় সন্ধ্যে হয়ে আসছে। অথচ রকিব এখনো বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। তমা গিয়ে রকিবের মাথার চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডাকে, রকিব -ভাইয়া। উঠ না…… সন্ধ্যে হয়ে এল রে….. নামায পড়বি না ????
আরেকটু ঘুমিয়ে নিই আপু…. এখন যা তো, জালাস না খালিখালি…..।
রকিবের ঘরের একেবারের সামনের ফ্ল্যাটের ওই ঘরটায় থাকে সৌম্য।
কিছুদিন ধরেই সৌম্য লক্ষ্য করছে, বিকেল হলেই তাদের সামনের ফ্ল্যাটের বারান্দায় একটি মেয়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। বারান্দার গ্রিল ধরে মুগ্ধ-দৃষ্টিতে নীল আকাশের জোড়া-জোড়া মেঘরাশির দিকে তাকিয়ে থাকে। কখনো-বা বারান্দার কোণায় বাসা বাঁধা চড়ূই পাখি দুটিকে গান শোনায় :
“দীবশ রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি। তাই চমকিত মন
চকিত শ্রবণ, তৃষিত আকুল আঁখি….”
এমন-কি খুব মমতা দিয়ে বারান্দার ফুলের গাছগুলোকে আদর করে দেয়। যেন তাদেরকে মায়ের মত আদর করছে।
সৌম্য বেশ আরো লক্ষ্য করে, মেয়েটি দেখতে খুব সাধারণ। ওড়না গায়ে জড়ানোর ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায়, সে ভদ্র ও নম্রও। কিন্তু মেয়েটি এই ভর-বিকেলে চোখে সানগ্লাস পড়েছে ……..!!!!!
মাথায় কোন একটা বিষয় একবার গেঁথে গেলেই হলো। তখন ওই বিষয়টিকে নিয়ে সৌম্য’র আর চিন্তার শেষ থাকে না। মেয়েটি কেন বিকেল বেলা সানগ্লাস পড়ে ছিল এই নিয়ে যতগুলো যুক্তি থাকতে পারে প্রায় তার সবগুলো নিয়েই সৌম্য ভেবেছে কিন্তু কোনটিই তার মনে ধরে নি।
অবশেষে সে সিন্ধান্ত নিয়েছে, মেয়েটিকে নিজেই জিঞ্জেস করবে…….।
আজ তমার মন ভাল নেই। তাই সে আজ অনেক আগেই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। যেদিন তমার মন খারাপ থাকে, সেদিন সে বারান্দায় দীর্ঘ সময় কাটায়। গ্রিল ধরে কেবলই আকাশের সারিসারি মেঘরাশির দিকে তাকিয়ে থাকে আর বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়ায়।
তমাদের ফ্ল্যাটে আগেও অনেক রকম ভাড়াটে এসেছে। নতুন অনেক মেয়েই এসে দাঁড়াত কিন্তু তাদের কেউই মন কাড়তে পারে নি। এই মেয়েটিকে একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে।
মাথার চুলগুলো তমার চোখের সামনে এসে পড়ায় তার মুখের একটা পাশ দেখা যাচ্ছে না, তবুও সে চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছে না।
সৌম্য’র খুব ইচ্ছে করছে তমার সাথে কথা বলতে। রহস্য উদঘাটন করতে তার মন ব্যাকুল হয়ে আছে।
অবশেষে লজ্জা,সংকোচ বিসর্জন দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সৌম্য।
তমা এখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আনমনে।
বেশ নরম সুরে সৌম্য জিঞ্জেস করে, আজ কি আপনার মন খারাপ ?
কেমন যেন চমকে ওঠে তমা ! পরে সৌম্য’র দিকে তাকালেই সৌম্য একা ম্লান হাসি দেয়। সাথে সাথেই মাথা নিচু করে ফেলে তমা।
প্রায় প্রতিদিন আপনি নির্দিষ্ট সময়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ান। তারপর অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে। মনে হয় আপনি কি যেন খোঁজেন ???
ঠিক বলেছেন আপনি। আমি তাকিয়ে থাকি তবে কিছু খুঁজি না।
আমি তাকিয়ে স্রষ্টার নিপুণ কারিগরের মত তৈরি করা নীল আকাশ দেখি আর ভাবি, আমার মনটাও যদি আকাশের মত বিশাল হত ! আমি বর্ণিল প্রজাপতির উড়ে বেড়ানো দেখি। যার সৌন্দর্য মানুষের মুখে অতি সহজেই আনন্দের হাসি এনে দেয়। ঠিক তখনই আমি ভাবি, ইস ! এভাবে যদি আমিও মানুষকে আনন্দ দিতে পারতাম !!! আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়া দেখি। এই বৃষ্টি হল স্রষ্টার রহমত। আমি হাত বাড়িয়ে সেই বৃষ্টির জ্বলে আমার হাত ভেজাই। আর ভাবি, স্রষ্টার রহমত যদি আমার জীবনটাকেও একটু পাল্টে দিত…………….
কথাগুলো শেষ করেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তমা।
সৌম্য এতক্ষণ পর্যন্ত কথাগুলো তন্ময় হয়ে শুনছিল। একটু একটু করে আরো মুগ্ধ হয়ে যায় সে।
পরের দিন সৌম্য তমার আসার আগেই বারান্দায় এসে দাড়ায়। দু’হাত দিয়ে গ্রিল ধরে তমার কথাগুলো ভাবতে থাকে।
আড়মোরা ভেঙ্গে হঠাৎ লক্ষ্য করে তমা বারান্দায় এসে নীলকন্ঠ ফুলের গাছটিকে আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর খুব ধীরে গ্রিলটা ধরে ডাকে, তমা ?
ঠিক তখনই গাছটিতে হাত বুলাতে বুলাতে তমা জিঞ্জেস করে, কি ভাবলেন এতক্ষণ ???
কথাটা শুনেই লজ্জা পেয়ে যায় সৌম্য।
মাথা নিচু করে ফেলে আর বলে, কই ! কিছু নাতো ।
মুচকি হেসে তমা বলে, নারীর মন সবই বোঝে, কিছু ঘটে যাওয়ার আগেই। টের পেয়ে যায় কে তার দিকে কোন দৃষ্টিতে তাঁকায় ? বুঝে যায় তাকিয়ে থাকা মানুষটির চোখের ভাষা । কারন, স্রষ্টা মেয়েদের পৃথিবীতে পাঠানোর সময় এই ক্ষমতাটা দিয়ে দেন।
কি বুঝেছেন ? ছোট্ট করে সৌম্য বলে, হ্যাঁ বুঝেছি।
এভাবে প্রায় প্রতিদিন সৌম্য আর তমা বারান্দায় দাড়িয়ে কথা বলে। নিজেদের স্বপ্ন, ভাললাগা-মন্দলাগা সবকিছু শেয়ার করে। বিশ্বাসের জায়গাটা একটু একটু করে পোক্ত হতে থাকে।
সৌম্য জিঞ্জেস করে, আচ্ছা আপনার কোন ইচ্ছেটা প্রতিনিয়তই করে ???
তমা ঠিক তখনই মুগ্ধ চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, আমার পাখি হতে খুব ইচ্ছে করে। পাখিদের বেড়ানোর কোন সীমানা নেই, বাঁধা নেই। যেদিকে ইচ্ছে যেতে পারে, যাকে ইচ্ছে সঙ্গী করে নিতে পারে। যেখানে ইচ্ছে সেখানে গিয়ে স্রষ্টার সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারে।
আচ্ছা, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপর কি বলেন তো ???
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আমাদের মন সবসময় কিছু না কিছুর জন্য অপেক্ষা করে যায়। এই অপেক্ষার কোন অন্ত হয় না।
আমাদের দেশে অনেক শিল্পপতি আছে, যারা একটু অসুস্থ হলেই কোটি কোটি টাকা খরচ করে। অথচ আমরা কিন্তু দিব্যি ভালো আছি।
ঠিক কতদিন বেঁচে থাকার ইচ্ছে আপনার ???
তমা বলে, ঠিক ততদিন যতদিন না পর্যন্ত আমি মঙ্গলগ্রহ আর চাঁদের দেশে ভ্রমণ করতে পরছি; যতদিন না পর্যন্ত প্রতিটি মানুষ অপর মানুষের হৃদয়ে পৌছতে পারছে; যতদিন না পর্যন্ত পৃথিবীর সকল সৌন্দর্যকে আমি আমার চোখের ক্যামেরায় বন্দী করবো, ঠিক ততদিন পর্যন্ত।
কথা বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে আসে তমার। গম্ভীর হয়ে বলে, কিন্তু এই পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য আমার কখনোই দেখা হবে না, আমি জানি।
সৌম্য জিঞ্জেস করে, এমন গম্ভীর স্বরে কেন বলছেন ???
মানুষ যে তার ব্যর্থতার কথাগুলো গম্ভীর হয়েই বলে !
এই পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা আ্যাকুইরিয়ামের মাছের মত, যাদের পৃথিবীটা খুব ছোট। আর এভাবেই তাদের স্বপ্নগুলো ঐ ছোট জায়গার মধ্যে একটু একটু করে ছোট হয়ে আসে। প্রাণ-রস বিহীন জীবে পরিণত হতে হতে একসময় তারাও নিঃশেষ হয়ে যায়। আমিও তাদেরই দলে……..।
পরিবেশটা কেমন যেন গুমোট বেঁধে আছে।নিস্তব্ধ নিরবতা কেবলই।
হাসি হাসি মুখে সৌম্য জিঞ্জেস করে, শরতের বিকেলে রূপবতী কোন নারীর সাথে কথা বলার আনন্দটা সীমাহীণ। অনেকে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলে। আমারও একটা আছে।
কিন্তু মানুষ চাইলেই কি তার সবকথা বলতে পারে বলুন ??? হারানোর কি একটা ভয় থাকে না ?
না, পারে না। তমা নরম সুরে বলে, মানুষ হয়ে জন্মানোর এই এক-সমস্যা। “ যা বলতে মন চায়, ঠোঁট তাতে সব সময় সায় দেয় না”।
আগামীকাল আমার একটা দিন। আমি আপনাকে একটা কথা বলবো।
কথাটা বলেই ঝট করে সৌম্য তার ঘরে চলে যায়।
হাত বাড়িয়ে তমা সৌম্যকে ডাকতে যায় কিন্তু পারে না।
মনে মনে বলে, আমারও আপনাকে কিছু বলার ছিল কিন্তু…….।
দীর্ঘম্বাস ছাড়ে তমা। আজকের বিকেলটা কেন যেন বড্ড বেশি অসহনীয় মনে হচ্ছে তার কাছে।
পরের দিন বেশ আগেভাগেই সৌম্য বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ তার বিশেষ দিন। আজ সে তার মনের কথা বলবে। প্রতিটি পুরুষই যেদিন তার প্রিয় মানুষটিকে মনের কথা বলে সেদিন তার বুক ধক্ ধক্ করতে থাকে। মনের মাঝে কেমন যেন একটা উৎকন্ঠা কাজ করে। অস্থির লাগে আবার একটু খুশি খুশিও অনুভব হয়। মিশ্র একটা অনুভূতি।
সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হয়ে যায় কিন্তু তমা বারান্দায় আসে না। এমনকি রকিবের ঘরের দরজাও বন্ধ থাকে।
এভাবে প্রতিদিন সৌম্য তমার জন্য অপেক্ষা করে।
সৌম্যর মা বারান্দায় এসে দাঁড়ান। আলতো করে ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন, সমুদ্রের যেমন একটা শেষ আছে; জীবনের যেমন একটা শেষ আছে; তেমনি কিন্তু অপেক্ষারও একটা শেষ আছে। এটা তোকে মেনে নিতেই হবে……।
মনে মনে সৌম্য বলে, শূন্য বারান্দা দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত প্রভু। এবার আমি একটু মানুষ দেখতে চাই। সেই মানুষটিকে যে কিনা অপার মমতা নিয়ে ফুলের গাছগুলোতে হাতবুলিয়ে দিত।
শূন্য বারান্দায় ফুলের গাছগুলোর অবহেলায় পড়ে থাকা।
কী নিদারুণ এই একাকীত্ব, প্রিয় মানুষটির জন্য অপেক্ষা, আর ?
ঝাপসা চোখে কেবল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ।
একমাস পরে সৌম্যর নামে একটা চিঠি আসে। ঘুম থেকে ওঠেই সৌম্য দেখে তার বালিশের পাশে একটি খাম আছে।
বেশ অবাক হয় সে। ভাবে, এ পৃথিবীতে এমন কে আছে যে তাকে চিঠি লিখতে পারে !!!!
সাথে সাথেই একরাশ আগ্রহ নিয়ে সে খামটা খুলে চিঠি বের করে পড়তে শুরু করে…
একাকীত্বে থেমে যাওয়া জীবনকে সচল করার জন্য মানুষ কত কি-ই না করে, কিন্তু আমি ? আমি এই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতাম, সময় কাটাতাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে সৌন্দর্য অবলোকনের সাথে সাথে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করতাম।আপনি একদিন বলেছিলেন, আমাদের মন প্রতিনিয়তই কিছু না কিছুর জন্য অপেক্ষা করে যায়। তেমনি আমিও অপেক্ষা করেছি, কঠিন একটি বাস্তবের। কবে আসবে আমার জীবনে ! কারন, সেই বাস্তবতাটির কথা মাথায় রেখেই যে আমায় বেঁচে থাকতে হয়।
ক্রমেই ছোট হয়ে আসা আমার পৃথিবীতে, আনন্দের বার্তা নিয়ে এসেছিলেন আপনি।কত চমৎকার মুহূর্ত কাটিয়েছি আমি আপনার সাথে ! মনের কথা বলেছি, স্বপ্ন বুনেছি, এমনকি কখনো ছেলেমেয়ের অধিকার নিয়ে ঝগড়াও করেছি ! আপনার নির্ভেজাল এই বন্ধুত্বের বন্ধনের কথা আমি কখনো ভুলবো না, কখনো না ।
আপনি আমায় সেদিন কি বলতে চেয়েছিলেন, আমি জানি। বুঝতে পেরেছি অনেক আগেই।আপনার কথাও যেমন শুনা হয় নি তেমনি আমার কথাও বলা হয় নি !আমি জানি, আপনার মনে প্রায়ই একটা প্রশ্ন জাগত, আমি কেন সবসময় সানগ্লাস পড়ে থাকি? মূলত এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যেই প্রথম আপনি আমার সাথে কথা বলেন। আপনি অনেক দিন জিঞ্জেস করতে গিয়েও শেষে জিঞ্জেস করতে পারেন নি। অথচ আপনি জানেন না, আমার জীবনের চরম সত্যটা ওখানেই লুকিয়ে আছে। আমার গ্লুকোমা আছে।ক্রমে ক্রমে আমার দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে,সাথে আমার পৃথিবীও। যেদিন আপনার সাথে আমার শেষ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা হয়েছিল, ঠিক সেই দিন রাতে বাবা আমায় নিয়ে লন্ডন চলে যান শেষ বারের মত আমার চোখদুটি ভালো করার ব্যর্থ চেষ্টায়। কিন্তু সপ্তম আসমানের ওপাড়ে যা আগেই লিখিত হয়ে গিয়েছে তা কিভাবে বদলানো যায় বলুন ? যা হবার তাই হলো। এখন আমার সবকিছুই অন্ধকার। এমন এক মানুষ যার কাছে আলো-অন্ধকার, এমনকি পৃথিবীর সৌন্দর্য সব একই রকম- কালো…… একদম কালো।
আমরা মানুষেরা বড়ই অদ্ভুত। সারাজীবন স্বপ্ন দেখে যাই একরকম আর আমাদের জীবনে ঘটে যায় অন্যরকম। ছেঁড়া ছেঁড়া পুঁথির মালার মত কখন রাত গড়িয়ে সকাল হয়; আবার দিন গড়িয়ে রাত হয় আমি টেরই পাই না।
তবুও…….তবুও বেঁচে থাকা।
ইতি
আপনার অতি সাধারণ বন্ধু-তমা
চিঠিটা পড়া শেষ হলেই সৌম্যর সমস্ত অস্তিত্ব দুলে ওঠে। বুকের ভেতর থেকে সবকিছু ঝড়ের বেগে বেড়িয়ে আসতে চায়।
না,কেউ ছিল না আমার, কখনো না। কোনদিনও ছিল না।
চোখদুটি ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসে। সবকিছু, আশে পাশের সবকিছুই বিবর্ণ, স্থির।
এভাবেই হয়ত মানুষ মানুষকে আশ্রয়হীণ, অবলম্বনহীণ করে চলে যায়।
চোখ বন্ধ করে চিঠিটাকে দু-হাত দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে বলে,
“ একবার ভালবেসে দেখ, আমি হারাব না…
শুধু একবার হাতটা ধরে দেখ,কখনোই ছেড়ে যেতে দিব না…
বরং দেখবে তুমি জগতটাকে, আমার দৃষ্টিসীমার মাঝে
আমার সাথে…… আমার হাত ধরে…………”।
Tuesday, November 15, 2011
Wednesday, November 2, 2011
এলোমেলো মন…
উৎসর্গ…
অসাধারণ মানুষ তিনি ! যখনই দেখা হয়, খুব আন্তরিকতার সাথে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করেন। এত চমৎকার করে কথা বলেন যে কেবল তন্ময় হয়ে শুনতে ইচ্ছে করে !
প্রিয় সাকিব ভাই, সাকিব ফেরদৌস ভাই
সবাই মুগ্ধ করতে পারে না, কিন্তু আপনি আপনার কর্ম আর ব্যবহার দিয়ে আমাদের অনেককে মুগ্ধ করেছেন। অসাধারণ একজন মানুষ হয়েও আপনি থেকে যান আমাদের ধরা-ছোঁয়ার একেবারে কাছে; যেখাতে লাল-নীল প্রজাপতি ঘুরে বেড়ায, টুপটাপ বৃষ্টি নামে অবেলায়।
আমি মাঝেমাঝেই স্বপ্ন দেখি, কোন একদিন আপনি আমার এক অখ্যাত গল্প নিয়ে ছোট্ট একটা হলেও নাটক বানাবেন, আর আমি মুগ্ধতার চোখে তা দেখবো !
আকাশ পোড়ে না জানি, চাঁদ কিংবা তারার আগুনে
আমাদের ভাগ্য শুধু পোড়ে
যারা দেখি, আর পোড়ে
আমাদের সবুজ সাবেকী অভিমান সেই সাথে’।
দূর থেকে দেখলে সিফাতকে ঠিক সিফাত মনে হবে না। দুই পা মেলিয়ে এমন ভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে যেন সে এক পাথরের মূর্তি। চোখ দুটো স্থির, সমস্ত চেতনা দিয়ে শরীরটাও স্থির।
মাঝে মাঝেই এই জায়গায় বেড়াতে আসে সিফাত। মন খারাপ হলে আসে, একা একা লাগলেই চলে আসে।
আর এখানে আসেই সে আশেপাশের গাছগুলো, ঐ দূর নীল আকাশ আর মুক্ত মনে উড়ে যাওয়া পাখিগুলোর সাথে কথা বলে। তাদেরকে নিজের জীবনের বিষাদ ভরা অংশের গল্প শুনিয়ে মন হালকা করে।
মাটির উপর ফুঁটে থাকা ঘাসফুল গুলোকে একসময় হাত দিয়ে নেড়ে দেয়। আলতো করে ছুঁয়ে দেয়। কারন, এগুলো যে তার পরম বিশ্বস্ত বন্ধু।
আর এভাবে খানিকটা সময় কাটালেই তার মন ভালো হয়ে যায়।
ঘাসফুল গুলোর ওপর হাত বুলাতে বুলাতে সে বুঝতে পারে, কেউ একজন তার পেছনে এসে দাড়িয়েছে।
পেছনে তাকাতেই দেখে ইমন এসেছে। ও ইমন ! এসো ভাইয়া, বোস এখানে।
সিফাতের পাশে বসতে বসতে বলে, ভাইয়া আপনার কি মন খারাপ ?
যদিও আপনার বসে থাকার ভঙ্গি আর আলতো করে ঘাস পূলগুলো ছুঁয়ে দেওয়াই বলে দেয় আপনার মন খারাপ !
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখে হাসি এনে সিফাত বলে, তুমি বেশ ছোট ছোট জিনিস লক্ষ্য করেছ ! তোমার বিশ্লেষণটা একেবারে মিথ্যে নয়।
মুচকি হেসে ইমন বলে, ভাই আপনি কি জানেন মানুষ কখন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলে ?
সিফাত আকাশের দিকে তাকিয়ে জিঞ্জেস করে, কখন ???
যখন মানুষ নিজেকে লুকোতে চায়। সে সময় মানুষ জোর করে হাসার চেষ্টা করে, আপন মানুষকে বিভিন্ন উল্টোপাল্টা কথা শুনাবার চেষ্টা করে।
তাই জোর করে হাসতে নেই, এতে করে তার স্বকীয়তায় ভাটা পড়ে।
একটা প্রশ্ন করি ভাই ? অবশ্যই ভাইয়া।
আপনি কি কোন মানুষের দৃষ্টিসীমায় নিজেকে দেখতে পেয়েছেন ???
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর সিফাত বলে, হ্যাঁ এই পুথিবীতে দুইজন মানুষের মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। এর মাঝে একজন আমার বন্ধু আর অন্যজন নিজের মত করে চলে গিয়েছে।
একটু মিথ্যে বলা হল, যিনি চলে গিয়েছে তিনার মাঝে আমি আমাকে খুঁজে পেতে চেয়েছিলাম কিন্তু পাই নি। বড্ড দেরি করে ফেলেছিলাম তো…..।
আমিও একজনের মাঝে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলাম। খুব ভালবাসতাম তাকে। মনের মাধুরী মিশিয়ে, নিজের অস্তিত্বে অনুভব করতাম তাকে। ঠিক বন্ধনের তিন বছরের মাথায়, হঠাৎ একদিন আমায় ফোন করে বলে, আমি আর তোমার সাথে যোগাযোগ রাখবো না। তাকে কারন জিঞ্জেস করেছিলাম। কি বলেছে জানেন ?
আমি ধেকতে ভাল না, আমার সিজিপিএ ভাল না, ভাল ভার্সিটিতে পড়ি না তাই নাকি আর আমাকে পছন্দ হচ্ছে না। সে এখন আইবিএ তে পড়ে কোন ছেলের সাথে প্রেম করবে। প্রায় ৭ দিন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু লাভ হয় নি।
অবশেষে তাকে শৃঙ্খলার বেড়ী থেকে মুক্ত করে দিয়েছিলাম। অথচ আমি এখনও আমার দৃষ্টিসীমায় তাকে খুঁজে পাই। বুঝল না, সে কিছুতেই বুঝল না…….
ইমন তার কথা শেষ করতেই পরিবেশটা যেন আরো নিঃস্তব্ধ হয়ে যায়। কেমন গুমোট একটা আবহাওয়া।
আর আমি ? নরম সুরে সিফাত বলে।
আমায় একটা মানুষ পছন্দ করতো। পাগলের মত ভালবাসতো। অথচ কোন দিন আমি তার ভালবাসার মূল্য দিই নি। অবশেষে সে যখন আমার জীবন থেকে চলে গিয়ে অন্য একটি মানুষের হাত ধরে নতুন করে পথচলা শুরু করল, ঠিক তখন বুঝতে পারলাম আমি কি হারালাম !
জানো ! মাঝে মাঝেই স্বপ্ন দেখি , সে নীল রঙের শাড়ী, হাতে কাচের চূড়ী, কপালে ঠিক মাঝখাতে ঠোট্ট একটা কালো টিপ আর চুল গুলো কোলা রেখে আমার পাশে এসে বসেছে। আর আমি তার সামনে বসে তার একটা হাত ধরে তার দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছি !
সে আমায় জিঞ্জেস করে, আমি কেন নীল শাড়ী পড়েছি জানো ???
পড়া না পারা ছাত্রের মত আমি মাথা নিচু করে বলি, না জানি না।
কারন, নীল শাড়ী আমায় বেশ ভালো মানায়। যদিও বেদনার রং নীল, তবুও আমার কিন্তু কোন বেদনাবোধ নেই।
মুখটা আমার কাছে এনে সে কানেকানে ফিসফিস করে বলে, “তুমি যে তোমার ভালবাসার আলতো ছোঁয়ায় ঐ দূর নীলিমায় আমার সব বেদনাগুলো উড়িয়ে দিয়েছ”।
কথাটা বলে নিজেই লজ্জা পেয়ে যায় সে।
ঠিক তখনই আমি তার কাছে গিয়ে আলতো করে আমার ঠোঁট দিয়ে তার কপাল ছুঁয়ে দিই।
স্বপ্নটা বলা শেষ করেই সিফাত কেমন যেন আনমোনা হয়ে আবার ঘাসের দিকে তাকিয়ে থাকে।
হঠাৎ জেগে ওঠে বলে, সর্যি আমার আবোল-তাবোল স্বপ্নের কথা শুনার জন্যে।
হাসতে হাসতে ইমন বলে, আপনিতো জানেন না- আপনার স্বপ্নটা কতটা চমৎকার !
স্বপ্ন হয়ত চমৎকার কিন্তু প্রিয় মানুষ পাশে না থাকলে এই স্বপ্নটাকেই আবার পানশে মনে হয়।
ইমন বলে, ভাইয়া কথাটা ঠিক বললেন না ।
স্বপ্ন কখনোই অর্থহীণ হয় না। কারন, সবাই চমৎকার করে স্বপ্ন দেখতে পারে না। আর এই পৃথিবীতে বেশির ভাগ মানুষই এটাকে পুঁজি করে বেঁচে থাকে।
আচ্ছা ইমন, ভালবাসার মানুষ যদি ভালবাসার গভীরতা না বোঝে অবঞ্জা করে তাহলে কেমন লাগে বল তো ?
আমাদের প্রিয় মানুষগুলো আসলে বোঝে না তাদের আমরা কতটা ভালবাসি !
ভাই, আপনার কোন কাছের মানুষ কি এরকম করেছে আপনার সাথে ???
না, আমার সাথে হয় নি। কথাটা বলেই সে চুপ হয়ে যায়।
অনেকক্ষণ পর বলে, আমার এক খুব কাছের মানুষের সাথে এরকম হয়েছে।
সেই প্রিয় মানুষটি একজনকে ভালবাসত। সারাদিন যতই ব্যস্ত থাকুক না কেন, সময় করে বেশ আগ্রহ নিয়ে ভালবাসার মানুষটির খবর নিত। একদিন সেই মানুষটি মোটরসাইকেলে এক্সিডেন্ট করে !
সে যখন তার এক্সিডেন্ট এর খবর তার প্রিয় মানুষটিকে বলে তখন উত্তরে সে কি বলেছে জান ???
বলেছে, ‘তুমি ঔষধ খেয়ে নিও। তারপর একটা লম্বা ঘুম দাও, দেখবে ভাল লাগবে”।
আমরাও কিন্তু জানি, ঔষধ খেতে হবে এবং আমরা ডাক্তারও দেখাব। কিন্তু প্রিয় মানুষটি একটু উৎকন্ঠায় পড়ে যাবে, একটু মমতা নিয়ে কথা বলবে, একটু আগ্রহ নিয়ে খবর নিবে- এটা কি খুব বেশি কিছু ?
না ভাই বেশি কিছু নয়। ভালবাসার শক্তি অনেক প্রখর ভাই। এই শক্তি অনেক অসুখ নিমিষেই ভাল করে দেয়।
একবার আমার পেটে প্রচন্ড ব্যথা হয়েছিল। প্রায় ২ দিন আমি কাঁতরাচ্ছিলাম। কিন্তু যখনই আমরা মা খুব আলতো করে আমার পেটের উপর হাত রাখতেন, তখনই আমি আর ব্যথা অনুভব করতাম না। আমি তাকিয়ে দেখতাম, মা পরম যত্নে চৌম্বকীয় শক্তিতে আমার সমস্ত ব্যথা শুষে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। আর এই মমতা দেখেই আমি প্রায় অর্ধেক সৃস্থ হয়ে গিয়েছিলাম।
পৃথিবীটা কেমন যেন রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে। আত্মার বন্ধনের কথা বললে মানুষ এখন হাসে। প্রাণের বন্ধুর কথা বললে আমাদের সেকেলে স্বভাবের ভাবে। ভালবাসার মূল্যের কথা বললে “আঁতেল” ভাবে !!! পৃথিবীটা বুঝি অনেক এগিয়ে গেছে যেখানে বন্ধনের প্রগাঢ়তা, সম্পর্কের বির্নিমান, আত্মার টান শ্বদগুলো বড্ড বেশি অনুপস্থিত।
কিন্তু আমি এগুলোকে পুঁজি করেই বেঁচে থাকতে চাই। চাই কাছের মানুষগুলোকে ভালবেসে যেতে আজীবন।
কারন, তাদের মাঝেই যে আমি আমার সুখ খুঁজে পাই।
তোমায় বলেছিলাম না – একজন একজন আমায় খুব ভালবাসত। সে চলে যাওয়ার পর বুঝেছিলাম সে হৃদয়ের কতখানি জুড়ে আছে। ও চলে গেল কিন্তু কিছু জিনিস আমাকে শিখিয়ে গেছে। আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি ঘটনা থেকে কিছু না কিছু শিখি।
মানুষকে মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি সে আমায় শিখিয়ে গেছে। নইলে কাছের মানুষ কখন যে দূরের মানুষ এমনকি অপরিচিত হয়ে যাবে আমরা বলতেই পারবো না।
এগুলো বেশ সহজ কথা, আমরা প্রত্যেকেই জানি কিন্তু একটু মেনে চলতে হবে কেবর। আর এরকম অনেক টুকরো টুকরো ঘটনাই ঘটে যাচ্ছে আমাদের সাথে, আমাদের প্রিয় মানুষগুলোর সাথে……….
সাথে সাথে আমরা বেদনায় নীল হয়ে যাচ্ছি একটু একটু করে নীরবে…….
প্রিয় পাঠক, চলুন না আমাদের বন্ধনগুলোর প্রতি আমরা আকেটু যত্নশীল হই হোক সে বন্ধন কোন এক বন্ধুর সাথে, আমাদের প্রিয় মানুষটির সাথে, আমাদের কোন এক আত্মীয়ের সাথে………
আর চেষ্টা করি, কাছাকাছি থেকে বন্ধনের প্রগাঢ়তা অনুভব করতে……..।
অসাধারণ মানুষ তিনি ! যখনই দেখা হয়, খুব আন্তরিকতার সাথে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করেন। এত চমৎকার করে কথা বলেন যে কেবল তন্ময় হয়ে শুনতে ইচ্ছে করে !
প্রিয় সাকিব ভাই, সাকিব ফেরদৌস ভাই
সবাই মুগ্ধ করতে পারে না, কিন্তু আপনি আপনার কর্ম আর ব্যবহার দিয়ে আমাদের অনেককে মুগ্ধ করেছেন। অসাধারণ একজন মানুষ হয়েও আপনি থেকে যান আমাদের ধরা-ছোঁয়ার একেবারে কাছে; যেখাতে লাল-নীল প্রজাপতি ঘুরে বেড়ায, টুপটাপ বৃষ্টি নামে অবেলায়।
আমি মাঝেমাঝেই স্বপ্ন দেখি, কোন একদিন আপনি আমার এক অখ্যাত গল্প নিয়ে ছোট্ট একটা হলেও নাটক বানাবেন, আর আমি মুগ্ধতার চোখে তা দেখবো !
আকাশ পোড়ে না জানি, চাঁদ কিংবা তারার আগুনে
আমাদের ভাগ্য শুধু পোড়ে
যারা দেখি, আর পোড়ে
আমাদের সবুজ সাবেকী অভিমান সেই সাথে’।
দূর থেকে দেখলে সিফাতকে ঠিক সিফাত মনে হবে না। দুই পা মেলিয়ে এমন ভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে যেন সে এক পাথরের মূর্তি। চোখ দুটো স্থির, সমস্ত চেতনা দিয়ে শরীরটাও স্থির।
মাঝে মাঝেই এই জায়গায় বেড়াতে আসে সিফাত। মন খারাপ হলে আসে, একা একা লাগলেই চলে আসে।
আর এখানে আসেই সে আশেপাশের গাছগুলো, ঐ দূর নীল আকাশ আর মুক্ত মনে উড়ে যাওয়া পাখিগুলোর সাথে কথা বলে। তাদেরকে নিজের জীবনের বিষাদ ভরা অংশের গল্প শুনিয়ে মন হালকা করে।
মাটির উপর ফুঁটে থাকা ঘাসফুল গুলোকে একসময় হাত দিয়ে নেড়ে দেয়। আলতো করে ছুঁয়ে দেয়। কারন, এগুলো যে তার পরম বিশ্বস্ত বন্ধু।
আর এভাবে খানিকটা সময় কাটালেই তার মন ভালো হয়ে যায়।
ঘাসফুল গুলোর ওপর হাত বুলাতে বুলাতে সে বুঝতে পারে, কেউ একজন তার পেছনে এসে দাড়িয়েছে।
পেছনে তাকাতেই দেখে ইমন এসেছে। ও ইমন ! এসো ভাইয়া, বোস এখানে।
সিফাতের পাশে বসতে বসতে বলে, ভাইয়া আপনার কি মন খারাপ ?
যদিও আপনার বসে থাকার ভঙ্গি আর আলতো করে ঘাস পূলগুলো ছুঁয়ে দেওয়াই বলে দেয় আপনার মন খারাপ !
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখে হাসি এনে সিফাত বলে, তুমি বেশ ছোট ছোট জিনিস লক্ষ্য করেছ ! তোমার বিশ্লেষণটা একেবারে মিথ্যে নয়।
মুচকি হেসে ইমন বলে, ভাই আপনি কি জানেন মানুষ কখন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলে ?
সিফাত আকাশের দিকে তাকিয়ে জিঞ্জেস করে, কখন ???
যখন মানুষ নিজেকে লুকোতে চায়। সে সময় মানুষ জোর করে হাসার চেষ্টা করে, আপন মানুষকে বিভিন্ন উল্টোপাল্টা কথা শুনাবার চেষ্টা করে।
তাই জোর করে হাসতে নেই, এতে করে তার স্বকীয়তায় ভাটা পড়ে।
একটা প্রশ্ন করি ভাই ? অবশ্যই ভাইয়া।
আপনি কি কোন মানুষের দৃষ্টিসীমায় নিজেকে দেখতে পেয়েছেন ???
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর সিফাত বলে, হ্যাঁ এই পুথিবীতে দুইজন মানুষের মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। এর মাঝে একজন আমার বন্ধু আর অন্যজন নিজের মত করে চলে গিয়েছে।
একটু মিথ্যে বলা হল, যিনি চলে গিয়েছে তিনার মাঝে আমি আমাকে খুঁজে পেতে চেয়েছিলাম কিন্তু পাই নি। বড্ড দেরি করে ফেলেছিলাম তো…..।
আমিও একজনের মাঝে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলাম। খুব ভালবাসতাম তাকে। মনের মাধুরী মিশিয়ে, নিজের অস্তিত্বে অনুভব করতাম তাকে। ঠিক বন্ধনের তিন বছরের মাথায়, হঠাৎ একদিন আমায় ফোন করে বলে, আমি আর তোমার সাথে যোগাযোগ রাখবো না। তাকে কারন জিঞ্জেস করেছিলাম। কি বলেছে জানেন ?
আমি ধেকতে ভাল না, আমার সিজিপিএ ভাল না, ভাল ভার্সিটিতে পড়ি না তাই নাকি আর আমাকে পছন্দ হচ্ছে না। সে এখন আইবিএ তে পড়ে কোন ছেলের সাথে প্রেম করবে। প্রায় ৭ দিন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু লাভ হয় নি।
অবশেষে তাকে শৃঙ্খলার বেড়ী থেকে মুক্ত করে দিয়েছিলাম। অথচ আমি এখনও আমার দৃষ্টিসীমায় তাকে খুঁজে পাই। বুঝল না, সে কিছুতেই বুঝল না…….
ইমন তার কথা শেষ করতেই পরিবেশটা যেন আরো নিঃস্তব্ধ হয়ে যায়। কেমন গুমোট একটা আবহাওয়া।
আর আমি ? নরম সুরে সিফাত বলে।
আমায় একটা মানুষ পছন্দ করতো। পাগলের মত ভালবাসতো। অথচ কোন দিন আমি তার ভালবাসার মূল্য দিই নি। অবশেষে সে যখন আমার জীবন থেকে চলে গিয়ে অন্য একটি মানুষের হাত ধরে নতুন করে পথচলা শুরু করল, ঠিক তখন বুঝতে পারলাম আমি কি হারালাম !
জানো ! মাঝে মাঝেই স্বপ্ন দেখি , সে নীল রঙের শাড়ী, হাতে কাচের চূড়ী, কপালে ঠিক মাঝখাতে ঠোট্ট একটা কালো টিপ আর চুল গুলো কোলা রেখে আমার পাশে এসে বসেছে। আর আমি তার সামনে বসে তার একটা হাত ধরে তার দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছি !
সে আমায় জিঞ্জেস করে, আমি কেন নীল শাড়ী পড়েছি জানো ???
পড়া না পারা ছাত্রের মত আমি মাথা নিচু করে বলি, না জানি না।
কারন, নীল শাড়ী আমায় বেশ ভালো মানায়। যদিও বেদনার রং নীল, তবুও আমার কিন্তু কোন বেদনাবোধ নেই।
মুখটা আমার কাছে এনে সে কানেকানে ফিসফিস করে বলে, “তুমি যে তোমার ভালবাসার আলতো ছোঁয়ায় ঐ দূর নীলিমায় আমার সব বেদনাগুলো উড়িয়ে দিয়েছ”।
কথাটা বলে নিজেই লজ্জা পেয়ে যায় সে।
ঠিক তখনই আমি তার কাছে গিয়ে আলতো করে আমার ঠোঁট দিয়ে তার কপাল ছুঁয়ে দিই।
স্বপ্নটা বলা শেষ করেই সিফাত কেমন যেন আনমোনা হয়ে আবার ঘাসের দিকে তাকিয়ে থাকে।
হঠাৎ জেগে ওঠে বলে, সর্যি আমার আবোল-তাবোল স্বপ্নের কথা শুনার জন্যে।
হাসতে হাসতে ইমন বলে, আপনিতো জানেন না- আপনার স্বপ্নটা কতটা চমৎকার !
স্বপ্ন হয়ত চমৎকার কিন্তু প্রিয় মানুষ পাশে না থাকলে এই স্বপ্নটাকেই আবার পানশে মনে হয়।
ইমন বলে, ভাইয়া কথাটা ঠিক বললেন না ।
স্বপ্ন কখনোই অর্থহীণ হয় না। কারন, সবাই চমৎকার করে স্বপ্ন দেখতে পারে না। আর এই পৃথিবীতে বেশির ভাগ মানুষই এটাকে পুঁজি করে বেঁচে থাকে।
আচ্ছা ইমন, ভালবাসার মানুষ যদি ভালবাসার গভীরতা না বোঝে অবঞ্জা করে তাহলে কেমন লাগে বল তো ?
আমাদের প্রিয় মানুষগুলো আসলে বোঝে না তাদের আমরা কতটা ভালবাসি !
ভাই, আপনার কোন কাছের মানুষ কি এরকম করেছে আপনার সাথে ???
না, আমার সাথে হয় নি। কথাটা বলেই সে চুপ হয়ে যায়।
অনেকক্ষণ পর বলে, আমার এক খুব কাছের মানুষের সাথে এরকম হয়েছে।
সেই প্রিয় মানুষটি একজনকে ভালবাসত। সারাদিন যতই ব্যস্ত থাকুক না কেন, সময় করে বেশ আগ্রহ নিয়ে ভালবাসার মানুষটির খবর নিত। একদিন সেই মানুষটি মোটরসাইকেলে এক্সিডেন্ট করে !
সে যখন তার এক্সিডেন্ট এর খবর তার প্রিয় মানুষটিকে বলে তখন উত্তরে সে কি বলেছে জান ???
বলেছে, ‘তুমি ঔষধ খেয়ে নিও। তারপর একটা লম্বা ঘুম দাও, দেখবে ভাল লাগবে”।
আমরাও কিন্তু জানি, ঔষধ খেতে হবে এবং আমরা ডাক্তারও দেখাব। কিন্তু প্রিয় মানুষটি একটু উৎকন্ঠায় পড়ে যাবে, একটু মমতা নিয়ে কথা বলবে, একটু আগ্রহ নিয়ে খবর নিবে- এটা কি খুব বেশি কিছু ?
না ভাই বেশি কিছু নয়। ভালবাসার শক্তি অনেক প্রখর ভাই। এই শক্তি অনেক অসুখ নিমিষেই ভাল করে দেয়।
একবার আমার পেটে প্রচন্ড ব্যথা হয়েছিল। প্রায় ২ দিন আমি কাঁতরাচ্ছিলাম। কিন্তু যখনই আমরা মা খুব আলতো করে আমার পেটের উপর হাত রাখতেন, তখনই আমি আর ব্যথা অনুভব করতাম না। আমি তাকিয়ে দেখতাম, মা পরম যত্নে চৌম্বকীয় শক্তিতে আমার সমস্ত ব্যথা শুষে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। আর এই মমতা দেখেই আমি প্রায় অর্ধেক সৃস্থ হয়ে গিয়েছিলাম।
পৃথিবীটা কেমন যেন রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে। আত্মার বন্ধনের কথা বললে মানুষ এখন হাসে। প্রাণের বন্ধুর কথা বললে আমাদের সেকেলে স্বভাবের ভাবে। ভালবাসার মূল্যের কথা বললে “আঁতেল” ভাবে !!! পৃথিবীটা বুঝি অনেক এগিয়ে গেছে যেখানে বন্ধনের প্রগাঢ়তা, সম্পর্কের বির্নিমান, আত্মার টান শ্বদগুলো বড্ড বেশি অনুপস্থিত।
কিন্তু আমি এগুলোকে পুঁজি করেই বেঁচে থাকতে চাই। চাই কাছের মানুষগুলোকে ভালবেসে যেতে আজীবন।
কারন, তাদের মাঝেই যে আমি আমার সুখ খুঁজে পাই।
তোমায় বলেছিলাম না – একজন একজন আমায় খুব ভালবাসত। সে চলে যাওয়ার পর বুঝেছিলাম সে হৃদয়ের কতখানি জুড়ে আছে। ও চলে গেল কিন্তু কিছু জিনিস আমাকে শিখিয়ে গেছে। আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি ঘটনা থেকে কিছু না কিছু শিখি।
মানুষকে মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি সে আমায় শিখিয়ে গেছে। নইলে কাছের মানুষ কখন যে দূরের মানুষ এমনকি অপরিচিত হয়ে যাবে আমরা বলতেই পারবো না।
এগুলো বেশ সহজ কথা, আমরা প্রত্যেকেই জানি কিন্তু একটু মেনে চলতে হবে কেবর। আর এরকম অনেক টুকরো টুকরো ঘটনাই ঘটে যাচ্ছে আমাদের সাথে, আমাদের প্রিয় মানুষগুলোর সাথে……….
সাথে সাথে আমরা বেদনায় নীল হয়ে যাচ্ছি একটু একটু করে নীরবে…….
প্রিয় পাঠক, চলুন না আমাদের বন্ধনগুলোর প্রতি আমরা আকেটু যত্নশীল হই হোক সে বন্ধন কোন এক বন্ধুর সাথে, আমাদের প্রিয় মানুষটির সাথে, আমাদের কোন এক আত্মীয়ের সাথে………
আর চেষ্টা করি, কাছাকাছি থেকে বন্ধনের প্রগাঢ়তা অনুভব করতে……..।
Saturday, October 22, 2011
শেষ কথা…
উৎসর্গ…
যেখানে দাবি আছে, প্রত্যাশা আছে, সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি আছে, সাথে কলহ এবং পূর্ণমিলনও আছে” সেই বন্ধনটিই হলো ‘বন্ধুত্ব’। আমি এভাবে বন্ধুত্বের সঙ্গা বলতে ভালবাসি। তবে এই সঙ্গা টিকে প্রমাণ করেছে আমার এই বিশ্বস্ত বন্ধুটি। আমায় নিয়ে আগ্রহের সীমা নেই মানুষটির! আমার অতি প্রিয় কাছের মানুষ। সাধারণ হয়েও আমার কাছে একটু অসাধারণ একজন !
প্রিয় বেণী-মাধব, প্রিয় মৃদুল চৌধুরী কনক
বলতে পারিস, এক জীবনে কত পূণ্য করলে তোর মত একজন অসাধারণ, অকৃত্রিম বন্ধু পাওয়া যায় ????
আম্মু, সিফাত ভাইয়া কই ? বলতে পার ?
না মা, আমিতো জানি না। হয়ত ড্রইং রুমে বসে পেপার পড়ছে….
সনি ড্রইং রুমে গিয়ে দেখে, সিফাত বসে বসে আনমনে কি যেন ভাবছে।
সনি খুব সাবধানে ধীর পায়ে সিফাতের সামনের সোফায় গিয়ে বসে। অথচ সিফাত নিজের জগতেই মগ্ন আছে।
খানিকক্ষণ পর আলতো কন্ঠে সনি ডাকে, সিফাত ভাইয়া ???
আড়মোরা ভেঙ্গে সিফাত বলে, কি….কি……।সনির দিকে তাকিয়ে বলে, কখন এসেছিস ?
বেশ কিছুক্ষণ হলো এখানে এসেছি। দেখলাম, আপনি খুব মনযোগ দিয়ে কি যেন ভাবছেন ? তাই চুপচাপ বসে আছি।
কি ভাবছেন শুনি ??? বেশ মজার ভঙ্গিতে সনি জিঞ্জেস করে, কার কথা ভাবছেন বলেন তো ????
কথাটা বলে আর হাসতে থাকে সনি।
মলিন হেসে সিফাত বলে, কারো কথা না রে ভাইয়া।
মুচকি হেসে সনি বলে, আমি ছেলেটা একটু বোকা এটা আপনি জানেন। তবে এটুকু কিন্তু বুঝি যে, মানুষ যখন নিজেকে লুকাতে চায় তখন সে মিথ্যে বলে। যেমনটা আপনি বলছেন।
এমন সময় সিফাত এর মোবাইল বেজে ওঠে…… সজীব ফোন করেছে।
হ্যালো, সিফাত ভাই ? বাসায় আছেন ???
হ্যাঁ বাসায় আছি। চলে আয়…….
সজীব বলে, থাকেন, আমি আসছি…….
১৫ মিনিট পর সজীব এসে বসার ঘরে সিফাত এর পাশে বসে। সিফাত এর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে জিঞ্জেস করে,
কি ভাই, মন খারাপ???
জানিসতো কি কারনে মন খারাপ। Something missing in my heart…
হঠাৎ সিফাত গান ধরে, “ কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে তোমারে দেখিতে দেয় না, মন মেঘে তোমারে অন্ধ করে রাখে,
তোমারে দেখিতে দেয় না…….মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না….”।
গান শেষ হলেই সজীব বলে, ওনার নাম্বরতো আছেই- ফোন দেন কথা বলেন। দেখিয়েন, ভাল লাগবে।
আচ্ছা, সজীব এমনটা কেন কেন হলো বলতে পারিস ???
তুইতো জানিস, আমি তার সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছি। আর সে যদি আমায় ভালইবাসত তাহলে রাস্তায় আমায় এতগুলো মানুষের সামনে কেন অপমান করলো ? আমার মা-বাবার নামে বাজে বাজে কথা বলতো ? এমনকি আমি যখন মাস্টার্স করতে বাইরে যাব তখন সে তার মামাকে দিয়ে ফোন করিয়ে আমার ভিসা পর্যন্ত আটকে রেখেছিল ?
কেন, কেন এমন করেছে ???
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সজীব। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলে, আপনি একটু জেদী ছিলেন। আর তমা আপুও ছিল বেশ রাগী। আর রেগে গেলে মানুষ পশুর মত আচরণ করে। আর তমা আপুও রেগে গিয়ে বিভিন্ন উল্টোপাল্টা কাজ করেছে। তবে একটা কথাই বলব, তমা আপু আপনাকে সত্যিই অনেক ভালবাসে।
আমি এবার দেশে আসার পর একদম ভালো নেইরে সজীব। যে মানুষটির কথা কখনো ভাববো না বলে পণ করেছিলাম, তার কথাই বারবার মনে পড়েছে। আমি…… আমি বুঝি পাগল হয়ে যাব রে …… পাগল হয়ে যাব।
সজীব আলতো করে তার হাতটা সিফাতের ঘাড়ে রেখে বলে, একটা কথা মনে রাখবেন- মানুষ তার প্রথম ভালবাসাকে কখনোই ভুলতে পারে না। আর আপনি যখন প্রিয় মানুষদের থেকে দূরে থাকবেন তখনই আপনি তাদের প্রতি আপনার এই ভালবাসার গাঢ়ত্বটা ক্রমশ বাড়বেই।
হঠাৎ সোফা থেকে উঠে দাড়িয়ে সজীব হাঁটতে শুরু করে।
আপনি যতই অস্বীকার করেন না কেন আপনি কিন্তু তমা আপুকে এখনও ভালবাসেন। এটা যত তাড়াতাড়ি মেনে নেন ততই মঙ্গল।
কিন্তু, তমা কি এখন আর আমার কাছে ফিরে আসবে ???
আরে, আসবে না মানে ? আলবত আসবে। হয়ত প্রথমে একটু রাগ ঝাড়বে, এত দিনের জমানো ক্ষোভ তো ….. তারপর দেখবেন, সব ঠিক হয়ে গেছে। ……
১ বছর আগে সিফাত এর সাথে তমা’র বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। তবুও এউ এক বছরের জীবনে সিফাত মাঝে মাঝেই তমার কথা ভেবেছে। সিফাতের চিন্তা-চেতনা, ভাললাগা এসবের সাথে তমার মিল ছিল না বললেই চলে। তাই সারাক্ষণ তাদের মাঝে ঝগড়া লেগেই থাকত। অবশেষে সিফাত স্কলারশিপ পেয়ে লন্ডনে মাস্টার্স করতে চলে গেল। বিদেশে যাওয়ার পরেও সিফাতের জীবনে কোন পরিবর্তন ঘটে নি, কিন্তু অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটে গেছে তমার জীবনে। সিফাত চলে যাওয়ার পর তমার সাথে হাবীব নামের একটা ছেলের পরিচয় ঘটে। তারপর ভাললাগা। আর পরিচয়ের ২ মাসের মধ্যেই হাবীব কিছুটা জোর করে তমার সাথে এংগেষ্টমেন্ট করে ফেলে গোপনে। তারপর আসতে আসতে তমাকে তার বাড়ির সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। বিষয়টা একটু লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হলেও পরে তমার মা, খারারাও জানতে পারে। তমার প্রবল ইচ্ছার কারনেই তার মা-খালারা বিষয়টা মেনে নিয়েছিল।
একসময় বিষয়টা সিফাতও জানতে পারে। সেদিন বেশ কষ্ট পেয়েছিল সে। বুঝেছিল, কাছের মানুষদের হারিয়ে ফেলার কষ্ট কাকে বলে ! একজন মানুষ যে তার জন্যে পাগল ছিল, তাকে পাগলের মত ভালবাসত সে কি না আজ অন্য একটি মানুষের হয়ে গেল। যাকে চাইলেই আর দেখতে পাওয়া যাবে না, চাইলেই আলতো করে তার হাত ছুঁয়ে দেয়া হবে না !!! সারাটা রাত সিফাত বুকের ব্যথায় ঘুমোতে পারে নি। যেন নিজের শরীর থেকে কেউ তাজা এক টুকরো গোশত কেটে নিয়ে গিয়ে সেই ক্ষত স্থানে লবণ লাগিয়ে গেছে। ….
অনেক ভাবছে কিভাবে সিফাত তমার সাথে যোগাযোগ করবে ? যোগাযোগ করার কথা মাথায় আসলেই একরাজ সঙ্কা আর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তার সামনে এসে ভর করে।
অবশেষে সিফাত সাহস করে তমাকে একটা এসএমএস করে,
“ সালাম। কেমন আছেন আপনি ? আপনার বাসার সবাই ? হাবীব ভাই ? আমি মাত্র কয়েকদিন হল দেশে ফিরেছি …..”।
এসএমএসটা পাঠানোর ৩০ মিনিট পরে তমা সিফাতকে কল দেয়। ফোন ধরেই সিফাত বলে, কেমন আছেন আপনি ???
কানিক্ষণ চুপ করে থাকার পর তমা বলে, হ্যাঁ ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন ???
ফিকে হাসি হেসে সিফাত বলে, “জীবন যখন যেমন……তারই মাঝে অবগাহন”। তবে ……..ভাল আছি।
আপনার বাসার সবাই, হাবীব ভাই কেমন আছে ? সিফাত জিঞ্জেস করে।
হ্যাঁ সবাই ভালো আছে। রাব্বী বেশ বড় হয়ে গেছে, ক্লাস এইট এ পড়ছে।
এরপর কিছুক্ষণ দুজনই চুপ করে থাকে, মখে কোন কথা নেই।
দুজন দুজনের একটু কাছাকাছি আসতে চাইলেও বাস্তবতা যেখানে প্রতিকূলে সেখানে কি মনের আবেগ প্রকাশ করা সমীচিন ??? না, কখনোই না। বড়ং তাকে লুকিয়ে রাখাই ভাল।
ধীর কন্ঠে তমা এবার বলে, আমি আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, রাগের মাথায় অনেক খারাপ কথা বলেছি। আমায় ক্ষমা করবেন।
সাথে সাথেই সিফাত বলে, না না আপনি ক্ষমা চাচ্ছেন কেন !!! আপনারতো কোন দোষ নেই। সব দোষ আমার। তাই আমিই আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। এখন আর আপনাকে নিয়ে আমার মনে কোন ক্ষোভ, কোন প্রশ্নবোধক চিহ্ন নেই। বরং আমি আপনাকে বেশ শ্রদ্ধা করি।
সিফাতের কথা গুলো শুনে তমা বেশ অবাক হয়। সিফাত আজ হঠাৎ এরকম কথা বলছে কেন ???
কোন এক গল্পের বইতে পড়েছিলাম, প্রিয় মানুষ দূরে চলে গেলে বা তার সাথে বিচ্ছেদ ঘটলে তার নামে সবসময় ভাল ভাল কথা বলতে হয়। আর আমিও তাই করছি।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তমা বলে, গতবার আপনি লন্ডনে যাওয়ার সময় আমার সাথে একটি বারের জন্যে হলেও দেখা করেন নি। আমি এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এসেছিলাম। তারপরও আপনি দেখা করেন নি। দেখা করলে হয়ত আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হত না। আপনি যা করেছেন আমার সাথে, তা আমি কখনোই ভুলবো না। কখনো না।
নরম সুরে সিফাত বলে, আমিতো আগেই বলেছি- সব দোষ আমার। আমার জন্যেই এতকিছু। আমি বরাবারই নিজের ঘাড়ে দোষ নিয়েছি। এবারও তাই নিলাম।
আর এভাবে কথা বলতে বলতে কথন যে, ৪০ মিনিট পার হয়ে যায় সিফাত বা তমা কেউই টের পায় নি। অবশেষে সিফাত বলে, আজ অনেক কথা হলো। রাখি……. ভাল থাকবেন।
তমা বলে, আপনিও ভাল থাকবেন।
ফোনটা রাখার পর থেকেই সিফাতের বেশ ভালো লাগতে শুরু করে। বাসায় ইলেকট্রিসিটি নেই, বেশ গরম অনুভূত হচ্ছে তবুও পরিবেশটাকে তার অসহ্য মনে হচ্ছে না। অনাবিল আনন্দে মুখরিত সিফাতের চেতনার প্রতিটি মুহূর্ত।
বাড়ির উঠোনে সিফাত চেয়ার নিয়ে গিয়ে বসে আর মোবাইলে গান ছেড়ে দেয়….
“তুমি বরুণা হলে হবো আমি সুনীল…..”
গান শুনতে শুনতে একসময় সিফাত নিজের মুখেই গাইতে শুরু করে….
“ তুমি পাহাড় হলে হবো আমি সবুজ
তুমি শাসন করলে হবো আমি অবুঝ
তুমি অরণ্য হও, হবো পাখি
তুমি অশ্রু হলে হয়ে যাব আঁখি……”
এরপর থেকেই ১ দিন পরপর সিফাত আর তমার ছোট ছোট কথা বলা শুরু হয়।
একদিন সিফাত আর সজীব, নাহিদদের বাসা থেকে ফিরছিল। হঠাৎ সিফাত এর মোবাইলে তমা ফোন দেয়। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আমি আজ দুপুরে হাবীবকে বলে দিয়েছি আমি আর তার সাথে সম্পর্ক রাখতে পারবো না। আমি কোনভাবেই আর পারছি না। এখন আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। কেন যে সেদিন এংগেষ্টমেন্টটা করতে গেলাম !!! আপনি চাইলে আমার সাথে সম্পর্ক আবার কন্টিনিউ করতে পারেন আর না চাইলে আমি একাই থাকবো ……”।
কথাগুলো শুনার পর খানিকক্ষণ সিফাত অসম্ভব আনন্দে ভাসতে থাকে। সাথে সাথেই সজীব আর নাহিদকে এসএমএস করে, “ তমা ফিরে আসছে….. আমি খুব খুশি। খু-উ-উ-ব-ই খুশি ……”।
আর সিফাতের খুশিতে সজীব আর নাহিদও নিজেদের বিলিয়ে দেয়। এরা তিনজন যদিও তিনটি স্বতন্ত্র মানুষ, তবুও বন্ধনের দিক দিয়ে এরা এক আত্মা।
রাতের দিকে সিফাত বেশ আনন্দ নিয়ে তার বড় ভাইকে ফোন দেয়।
কেমন আছো ভাইয়া ??? ভাবি কেমন আছে ???
ভাল আছি। । আর তোর ভাবিও ভাল আছে।
ভাইয়া তুমি কি জান, তুমি খুব ভাগ্যবান একজন মানুষ। সবাই ভালবাসার মানুষকে নিজের মত করে পায় না কিন্তু তুমি পেয়েছ।
আবার এমনও মানুষ আছে যারা সারা জীবনই ভালবাসার মানুষের খবর পায় না, আবার অনেকে পেয়েও হারিয়ে ফেলে…..।
এ সবকিছু বুঝি আমাদের সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য। আচ্ছা ভাইয়া, ভালবাসার মানুষ দূরে চলে গিয়ে আবার ফিরে আসলে কি করা উছিত ??? তাকে কি আপন করে নেওয়া উচিত নাকি বুঝিয়ে দেওয়া উচিত প্রত্যাখান এর ব্যথা কতটা তীব্র ???
দেখ সিফাত, তুই আমায় কি বলতে চাচ্ছিস তা আমি বুঝেছি। তুই চাইলে তমার সাথে আবার সম্পর্কে জড়াতে পারিস তবে….। তবে এটুকু নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, সে আর কোন ঝামেলা করবে না, মা-বাবাকে নিয়ে উল্টোপাল্টা মন্তব্য করবে না। আমরা তোমাকে নিয়ে অন্তত এ বিষয়ে আর টেনশনে থাকতে চাই না।
রাখি এবার। এখন তুই ডিসিশান নে কি করবি ???? ভাল থাকিস।
ফোনটা রাখার পর সিফাতের বেশ মন খারাপ হয়ে যায়। খানিকক্ষণ পর তমা তাকে ফোন করে।
জিঞ্জেস করে, “ কি ডিসিশান নিলেন” ???
ধীর কন্ঠে সিফাত বলে, আপনি আমার কাছে ফিরে আসা মানেই আপনাকে এংগেষ্টমেন্ট ভেঙ্গে ফেলতে হবে। আর এটা করলে আপনার পরিবার, হাবীব ভাইয়ের পরিবার সবাই কষ্ট পাবে। সাথে আপনাকেও শুনতে হবে পরিবারের মানুষের কাছে বিভিন্ন গালমন্দ। এর থেকে কি ভাল না, যা হচ্ছে তাতেই সায় দেওয়া ????
তমা বলে, আমি জানতাম- আমি জানতাম আপনি এখন এ কথা বলবেন। আপনি এত কনফিউস কেন সব বিষয়ে বলেন তো ??? একটা ডিসিশান নিতে পারেন না !!! আর কখনো কোন দিন আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না। আমি আপনাকে ঘৃণা করি। মনে থাকবে তো, আমি আপনাকে ঘৃণা করি।
একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। বেশ স্নিগ্ধ আবহাওয়া। অথচ সিফাতকেকেমন যেন অগোছালো মনে হচ্ছে। অবচেতন মনে মাটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। একচিলতে উদ্বেলিত করা আনন্দ পরক্ষণেই তাকে আবার মাটিতে এনে ফেলে দিল।
মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলে, “আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি তুমি কোনদিন জানবে না। তোমার পরিবারের মানুষগুলোর কথা, আমার পরিবারের মানুষগুলোর ইচ্ছে, এগুলোর কথা ভাবার কারনেই এই ডিসিশান নিতে হলো। হাবীব ভাই তো আছে যে তোমায় অনেক ভালবাসে। তুমি তার কাছেই সুখে থাকবে। আর আমি না হয় দূর থেকে নিজের স্বপ্নটাকেই বিসর্জন দিলাম। আমায় ভুল বুঝো না তুমি…….ভুল বুঝো না……”
সেদিন রাতে সিফাত এমদম ঘুমোতে পারে নি। বিছানায় মুয়ে শুয়ে চোখের জ্বলে নাহিদ আর সজীবকে এসএমএস এ লিখেছে, “ যেমনি করে একচিলতে বুষ্টির মত এসেছিল তেমনিই চলে গেল তমা। আমি আবারো একা হয়ে গেলাম। আবারো হেরে গেলাম। শুনেছি, হেরে গেলে নাকি পালাতে হয়। বলতে পারিস, আমি পালিয়ে কোথায় যাব ?????
সারারাত তমার কথা ভাবতে ভাবতে একসময় সিফাত অনুশোচনায় ভুগতে শুরু করে। তার কাছে সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়, মানুষের আশা-আকাঙ্খা, কে কি ভাবলো সব তার কাছে অর্থহীণ মনে হয়। সে কেমন যেন পাগলের মত আচরণ করতে শুরু করে। এমন অবস্থা যে তার তমাকে ছাড়া যেন চলবেই না। তার মাথায় কেবলই সজীবের কয়েকটি কথা ঘুরতে থাকে :
“ভালবাসা কোন সূত্র মানে না আর Negotiation should not go beyond our very soul”
তখনই সিফাত সিদ্ধান্ত নেয়, সে তমার কাছেই ফিরে যাবে। কিন্তু সে তো জানত না, বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
সাথে সাথে সে তার ভালবাসার কথা তমার মোবাইলে এসএমএস করে। বেশ কয়েকটা এসএমএস পাঠানোর পর সিফাত হঠাৎ তমার মোবাইলে ফোন দেয়। আর তমা ফোনটা কেটে দিয়ে মোবাইলটা বন্ধ করে দেয়।
এর পর ৭ দিন সিফাত পাগলের মত তমাকে খুঁজেছে। তার মোবাইলে চেষ্টা করেছে, এসএমএস পাঠিয়েছে, তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু পায় নি। খুঁজে পায় নি তার প্রথম ভালবাসাকে। ……
আগামীকাল রাতে অবশেষে সিফাত আবার তার নতুন সেমিষ্টার ধরতে বিদেশের পথে পাড়ি জমাবে। যদিও অনেক রাত হয়ে গিয়েছে তবুও সে বসার ঘরের জানালা দিয়ে তারাভরা আকাশের দিকে নিথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভাবছে, জীবনটা আসলে কি ???
প্রশ্নটা করেই আবার নিস্ফলক তাকিয়ে থাকে। খানিকক্ষণ পর আশেপাশের নিস্তব্ধ পরিবেশ যেন তাকে প্রশ্নের উত্তরটা দিয়ে দেয়।
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ভেসে আসে, জীবন মানে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের খেলা…….।
আর সিফাতের মন বলে ওঠে, তেমনি জীবন মানে অপেক্ষা….. অপেক্ষা…..
জানালার গ্রিল থেকে ফিরে সিফাত কাগজ-কলম নিয়ে তমাকে একটা চিঠি লিখা শুরু করে।
প্রিয় তমা,
বুকের ভিতর কেমন যেন করছে আমার। কোন কোন রাতে এমন হয় । কোন কিছুই করতে ভাল লাগে না; না গল্প করতে, আড্ডা দিতে, না ঘুমোতে, না গল্পের বই পড়তে। ফাঁকা ফাঁকা লাগে সবকিছু- মাথার ভিতর, বুকের ভিতর, আশেপাশের চারপাশ। তাই আপনাকে চিঠি লিখতে বসলাম। ভয় হয় চিঠির মূল্য না দিয়ে যদি অবঙ্গা করেন ? কারণ আমি শুধু আমার কাছের মানুষগুলোকেই চিঠি লিখি। খুব যত্ন করে লিখার চেষ্টা করি। তবে আজকে চিঠি লিখার প্রয়াসটা যতটা না শখের বসে তার চেয়ে বেশি প্রয়োজনের। যতদূর মনে পড়ছে, এটা আপনাকে লিখা আমার দ্বিতীয় চিঠি এবং এটাই শেষ। একটা কথা কি জানেন, আমি আমার কাছের মানুষগুলোকে খুব ভালবাসি। আমার কাছের মানুষগুলো আমায় যতটা ভালবাসে, আমায় যতটা ঘৃণা করে তার চেয়েও বেশি। হ্যাঁ, তার চেয়ের বেশি…………
একটা সময় ছিল যখন আকাশে পাখি উড়ে যেতে দেখলে বেশ আনন্দ হত। এখন তাদের দেখলে আমার চোখে জ্বল এসে যায়। মাঝে মাঝে আবার বাবুই পাখি হতে ইচ্ছে করে। সবকিছু শেষ হয়ে গেলেও, আবার নতুন করে সবকিছু গোছানোর স্পর্ধা দেখাতে ইচ্ছে জাগে। আবার যখন মন বিষন্নতায় ডুবে যায় তখন কেবলই ঐ দূর নীলিমায় নিষ্ফলক তাকিয়ে থাকি আর নিঝের ব্যর্থতা গুলোর কথা ভাবি। কোন এক গল্পের বইতে পড়েছিলাম,
“মেয়েরা নাকি সারাজীবন অপেক্ষাই করে যায়……”
কথাটা শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রেই সত্য তা নয়, পুরুষদের ক্ষেত্রেও সত্য। তবে একান্তভাবে আমরা যে জিনিসটার জন্য অপেক্ষা করি তা হল, প্রিয়জনকে পাশে নিয়ে তার সাথে সুন্দর একটি মুহূর্ত কাটানো……..। কিন্তু আজ আমার ভালবাসার মানুষকে নিয়ে স্বপ্নগুলো আলো-ছায়ায় হারিয়ে গেছে। রঙ্গিন স্বপ্নের মাঝে জলবিহীন বিষাদ-মরিচীকা প্রবেশ করেছে কবেই; যা আজ শুধুই গল্প।
আপনার সাথে আমার যতই ঝগড়া হোক না কেন, আপনি প্রতিশোধ হিসেবে যা কিছুই করেন না কেন, তবুও আমি এখন আপনাকে অনেক বেশি শ্রদ্ধা করি। তার থেকেও বড় কথা, আপনাকে আজও বড্ড ভালবাসি। কারন একটাই, মানুষ তার প্রথম ভালবাসা কখনোই ভুলতে পারে না। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমিও ভুলি নি, অতি যত্ন নিয়ে মনে রেখেছি। আপনার সাথে যখন ঝগড়া চলছিল অনেক দিন আগে তখন একদিন আমায় এসএমএস এ লিখেছিলেন,
“আমি জানি, আপনিও আমায় এখনো ভালোবাসেন……”
বিশ্বাস করুন, সেই দিন এই এসএমএসটা পড়ে বেশ হাসি পেয়েছিল। তবে আজ বুঝতে পারি, আপনার কথাটাই সত্য ছিল। এবার দেশে আসার পর আমি সবচেয়ে বেশি যেই জিনিসটা মিস করেছি সেটা হল আপনার সঙ্গ, এমনকি কারনে-অকারনেও আপনার কথা ভেবেছি। যে কোন একটা জিনিস ভাবতে শুরু করলেই তার সাথে আপনার একটা সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করতাম। যেমন, সেদিন দেখলাম বাইক এ চড়ে একজন ভাই তার মনের মানুষকে নিয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। আর তার মনের মানুষটি অসীম বিশ্বাস আর নির্ভরতায় তার হাতখানা নিয়ে প্রিয়মানুষটির ঘাড় শক্ত করে চেপে ধরেছে। দৃশ্যটা দেখে ভাবলাম, আমার উপরও যদি আপনার এরকম বিশ্বাস থাকতো….!!!!! মানুষ দূরে চলে গেলে বোঝা যায় সে হৃদয়ের কতটা জুড়ে ছিল যা কাছে থাকলে মাঝে মাঝে বোঝা যায় না।
কিন্তু পরিস্তিতি যেখানে প্রতিকূলে সেখানে মানুষের চাওয়া-পাওয়ার মূল্য কতটুকু বলুন ??? আজ আমার ইচ্ছে করছে, আপনার কাছে গিয়ে আপনার হাত ধরে পৃথিবীর সমস্ত অধিকার নিয়ে বলি, “ তুমি শুধুই আমার……..আমার। আমায় একা করে চলে যেয়ো না। তুমি তো জান না, আমার ভালবাসার পুরোটা জুড়ে শুধুই তুমি”।
কিন্তু আমি জানি, এ কথাটা আমার আপনাকে বলা হবে না। কোন দিন না। আর তাই তো, শত অনিশ্চয়তার মাঝে না হয় আমার স্বপ্ন, আমার ইচ্ছেটাকেই বিসর্জন দিলাম।
পরাজিত মানুষের জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই রকম। তারা সারাজীবন ভাবে এক-রকম, স্বপ্ন দেখে এক-রকম কিন্তু তাদের সাথে ঘটে আর এক-রকম। আর স্বপ্ন ভাঙতে ভাঙতে একসময় তাদের নীল হয়ে যাওয়া।
এবার দেশে ফেরার পর থেকেই আমি আপনার সাথে যোগাযোগ করার সাহস যোগাড় করছিলাম। কিন্তু পারি নি। অবশেষে আমাদের কথা হয়েছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনাকে এসএমএস দিয়েছি। শেষে আপনি একদিন বললেন, আপনি আপনার এংগেষ্টমেন্ট ছিন্ন করে আমার কাছে ফিরে আসবেন। আমিও আপনাকে প্রচন্ড ভালবাসি, তাই এ কথাটা শুনার পর নিশ্চই আমার থেকে বেশি খুশি হওয়ার কথা, তাই না ???? অথচ, আপনি এই কথাটা বলার পর আমি প্রতিটি বিষয় অতি সময় নিয়ে ভেবেছি। আপনি আমায় বলেছেন, আপনার এংগেষ্টমেন্ট এর খবর নাকি আপনার মা, খালা সহ আরো অনেকেই জানে। তাই এ সময় আপনার এংগেষ্টমেন্ট ভাংলে আপনার পরিবার কষ্ট পাবে। কথাটা বাইরে জানাজানি হলে খারাপ হবে। তাই আমি অনেক ভেবে নিজেই কষ্ট বরণ করে নিলাম। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, না আপনার কাছে আসার বা আপনাকে ফিরে পাওয়ার চিন্তা আমার মাথায় রাখবো না। আপনিতো বলেছেন, আপনার নতুন মনের মানুষটি আপনাকে অনেক ভালবাসে। আর তাই আপনারতো কোন ক্ষতি হচ্ছে না। অথচ যখন আপনাকে বললাম, যে আপনি আপনার বর্তমান মানুষটির কাছেই থাকেন, তারপর আমি মনের মাঝে একপ্রকার ব্যথা অনুভব করেছি। অনেকটা পাঁজড় ভাঙ্গার মত ব্যথা। যেন আপনাকে ছাড়া আমার চলবেই না। তাই আপনাকে আমি আবার এসএমএস পাঠিয়েছি, যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। বিশ্বাস করুন, আমি তখন কেমন যেন পাগল হয়ে গিয়েছিলাম ! অথচ আপনাকে আর খুঁজে পাই নি….. গভীর ভাবে দেখতে গেলে, সবদিক দিয়ে আমিই হেরে গেলাম। আপনার পরিবারের মানুষের কথা, আপনার কথা, বৃহত্তর মানুষের সুখের কথা ভাবতে গিয়ে আমাকেই সবকিছু হারাতে হল। আপনার পরিবারের আনন্দের কথা ভাবার কারনে আপনি আমাকেই খারাপ ভাবছেনতো, এ নিয়ে আমার আফসোস নেই। জানেন, মাঝে মাঝে ভাবি - পৃথিবীটা কত এগিয়ে গেছে, অথচ আমি এখনো বুঝি সেকেলেই রয়ে গেলাম ! আমার চিন্তাভাবনা গুলোও বুঝি সেই পুরোনো আমলের মানুষের মতোই রয়ে গেল !!! নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে অন্য সব মানুষের আনন্দের কথা ভাবা, প্রিয় মানুষের পরিবারকে নিজের পরিবার ভাবা ইত্যাদি এ যুগে বোকামি ছাড়া বুঝি আর কিছু না।
মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ কি বলতে পারেন ? মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ হল সরলতা। এই সরলতা এমন একটি গুণ যার মাঝে থাকে না কোন ভণিতা, কোন স্বার্থ, কোন উদ্দেশ্য……… স্পৃহাহীণ আমি এক অদৃশ্য পরিচালকের আঙ্গাবহ দাস। নিজেই নিজের জন্য যে গোলক ধাঁধা তৈরি করেছি তা থেকে কি চাইলেই আমি বের হয়ে আসতে পারি ??? না, পারি না। বাইরে থেকে কি বোঝা যায় একটি মানুষের ভিতরে কি চলছে ? না, যায় না। আমার মাঝে যে একটি নয় হাজারো পলিপ আছে তা আমি জানি। আর এক একটি পলিপ তৈরি হয়েছে এক-একটি ভুলের জন্য, এক একটি ব্যর্থতার জন্য, কাছের মানুষগুলোর কাছে থেকে অবহেলা পাবার জন্য, কাছের কিছু বন্ধুদের দ্বারা বারবার Betray এর স্বীকার হওয়ার জন্য…
কবিতা পড়তে আমার খুব ভাল লাগে। এটি আমার একটি অতি প্রিয় কবিতা। না, আমি লিখি নি, সংগৃহীত…
কি দেব তোমায় বল ?
আমি যে মেঘ নই যে তোমায় বৃষ্টি দেব
আমি অসীম নীলিমাও নই যে তোমায় স্নিগ্ধতা দেবো
আমি এক ব্যথিত মানুষ, এমন হৃদয় ভরা ভালবাসি কই ?
আমার ঘরে ফুল ফোটাব, কখনো হাসির রাশি দেব উপহার
তার মত কিছুই তো নেই !!!!!
আমার হাতদুটি এত আলোকিত নয় যে,
অসুখী শরীরে ছোঁয়া দেব আর সেরে যাবে তোমার সব অসুখ।
আমিতো শিশির নই যে তোমার রুক্ষপত্র সিক্ত করবো
আমি কোন কুলুকুলু নদী নই যে,
তোমার হৃদয়ের শস্যক্ষেত ভিজিয়ে দেবো।
এমনকি কোন অরণ্য উদ্ভিদ নই যে,
তোমার দুঃখের পাশে ফুটেঁ থাকবো চাঁপা কি বকুল হয়ে।
আমি কোন শিউলি নই তোমার, ভোরের শুভ্র শয্যা বিছাব।
আমি কোন তৃণ নই যে, বুক পেতে দেব মাথা রেখে অবসাদে শোবে।
এমনকি ঝড়া পাতাও নই যে, বন হবো
ভালবেসে টিপটাপ সারারাত ঝড়বো তোমার সিথানে।
আমি শুধু দিতে পারি ………………… একগুচ্ছ কষ্ট ।।
মাঝে মাঝে যখন খুব একা লাগে তখন চোখ বন্ধ করে প্রাণপনে ভাবতে চেষ্টা করি, “আমার ভালবাসার মানুষটি নীল রঙের শাড়ী, হাতে কাঁচের চুড়ী, কপালে ছোট্ট ঠিপ, ঠোঁটে হালকা লিপষ্টিক, খোঁপায় বেলী ফুলের মালা পড়ে আমার পাশে এসে বসেছেন। হাসিমুখে আমার হাতখানা আলতো করে নিজের দুই হাতের মাঝখানে নিয়ে গল্প করছে আর আমি পূর্ণ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছি !” এভাবে ভাবতে ভাবতে আমায় কখনও কখনও এই ভাবনাটাকে বাস্তব বলে মনে হয়। যেন আমি তার গন্ধ পাই, তার স্পর্শ অনুভব করতে পারি।
উচ্ছলতায় ভারা দিন গুলোতে যেমন ছিলাম, এখনও সেই দিন গুলোর মুখোমুখি হলে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করি। তবুও মনের এককোণায় একটা বিষন্নতা সর্বদাই থাকে। অন্যসব পরাজিত আর ব্যর্থ মানুষের মত আমিও তাকিয়ে আছি অনাগত ভবিষ্যতের দিকে, অপেক্ষায় আছি একটি সুন্দর মুহুর্তের, একটুকরো সুখের……।
হয়ত একদিন আমার জীবনেও স্থায়ী ভাবে আসবে কোন এক নারী – ভালবাসার আলোকবর্তিকা নিয়ে। আর সেদিন পর্যন্ত পৃথিবীর
সমস্ত ভালবাসা বুকে নিয়ে আমার তাঁরই জন্যে অমলিন অপেক্ষা- যে হবে সেই মুহুর্তে আমার অতি আপনজন……..।
কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাওয়া ঠিক না। এতে কেবলই কষ্ট বাড়ে….. জীবনে আমি অনেক ভুল করেছি। মাঝে মাঝে মনে হয় ভুল কোন জীনিসই জীবনে রাখতে নেই। আমরা প্রতিটি স্বতন্ত্র মানুষের কাছে জীবনের অর্থও ভিন্ন ভিন্ন। চারদিকে অসংখ্য ভুলের ছড়াছড়ি। প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা, প্রবঞ্চিতকে দেয় দাহ আর অনুতপ্তকে কি দেয় জানেন ?
প্রেম, অনুতপ্তকে দেয় হাহাকার। তীব্র হাহাকার, পাঁজর ভাঙার মত হাহাকার……………… এই হাহাকার সঙ্গী করেই আমি হাঁটছি……. বহু পথ যেতে হবে আমায়……
আজ চমৎকার জ্যোৎনা উঠেছে। আকাশের ঠিক মাঝখানে যেমন মায়াবতী নারীরা কপালের ঠিক মাঝখানে টিপ পড়ে, তেমনি ফুঁটে আছে চাঁদ মামা। আর সূর্য থেকে আলো নিয়ে তাকে জ্যোৎস্নায় রূপান্তরিত করে আমারদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে। চারদিক জ্যোৎনার বন্যায় ভেসে যাচ্ছে।আমার মত ঘূণেধরা,আট-পৌরে মানুষগুলো - যারা হাজারো পলিপ নিয়ে চলে, তারাও আজ জ্যোৎনার রূপালী আলোয় নিজের ছায়া দেখতে পায় যেমন করে আমি পাচ্ছি। সব মানুষ, দালানকোঠা, জীবজন্তু, পশুপাখি ইচ্ছেমত জ্যোৎস্না গায়ে মেখে আনন্দে অবগাহন করছে। ব্যর্থ আর ঘূণে-ধরা মানুষগুলো আকাশের দিকে তাকিয়ে জ্যোৎস্না গায়ে মাখতে মাখতে ভবিষ্যতের স্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়। নিজের গোলাপ পূর্ণ হৃদয় সম্পূর্ণ সমর্পণ করতে চায় ভালবাসার মানুষটিকে আর ভালবাসার মানুষটিকে আলিঙ্গন করে অন্তহীণ সুখ অনুভব করতে চায়। আমার কাছে যদিও সুখটির চেয়ে স্বপ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। কারন সুখের স্বপ্ন, সুখের চেয়ে প্রলম্বিত। সুখ মুহুর্তের আর স্বপ্ন ……………???
স্বপ্নতো চিরদিনের…………… চিরকালের……………
ভাল থাকবেন। শুভ হোক আপনার জীবনের প্রতিটি দিন- আপনার কাছের মানুষদের সাথে নিয়ে আর ভালবাসার মানুষটির অকৃত্রিম ভালবাসায়….. আমিন, আমিন, আমিন।
ফেলে আসা গোধুলীতে হল না আর ফানুস উড়ানো
ভুলের স্রোতে ভুলে গিয়ে তোমারো দেয়া হয় না আর হাতছানি
আমারি স্বপ্নের আকাশ আজ কৃষ্ণসাজে সাজলো
আর হবে না পিছু ফিরে দেখা জীবনের গ্লানি।
ইতি
সিফাত
সিফাতের ফ্লাইট এর সময় হয়ে যাচ্ছে। তার সাথে দেখা করতে এসেছে সোনিয়া নামের একটি মেয়ে। মেয়েটা সিফাতকে অনেক ভালবাসে। সিফাতের পছন্দ-অপছন্দ, ভাললাগা সবকিছুই সে জানে।
চলে যাওয়ার আগে মেয়েটি সিফাতকে বলে,
“ ভাইয়া ! আমার অসীম ভালবাসার বিনিময়ে হলেও কি আপনি আমায় একবিন্দু ভালবাসা দিতে পারবেন না ???”
মাথা নিচু করে ফেলে সিফাত। পড়া না পারা ছাত্রের মত বলে, “একজনের ভালবাসায় আমার হৃদয়টা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে আছে। আর একজনের ভালবাসা আমি কোথায় রাখবো ? আর আমি যে আমার ভালবাসাটুকু একজনকে দিয়ে দিয়েছি কবেই। আজ তোমাকে দেওয়ার মত আমার কাছে কিছুই নেই। আমার ক্ষমা করো’।
কথাটা বলেই সিফাত গাড়িতে উঠতে এগিয়ে যায়। পেছনে মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। কান্নার জ্বলে মেয়েটির চোখের কাজল লেপটে গিয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে।
গাড়ি এয়ারপোর্ট এর দিকে চলছে। সিফাত এর পাশে বসে ওর একটা হাত ধরে রেখেছে সজীব। যেন কিছুতেই কাছের মানুষটিকে চলে যেতে দিবে না। কী মনে করে যেন সজীব একটু পর পরই কেঁপে উঠছে।
সিফাত বুঝতে পারে কিন্তু কিছু বলে না…… যেন নীরবতা পালনের এক খেলায় নেমেছে সবাই।
বোর্ডিং হয়ে গেচে। সিফাত এবার ইমিগ্রেশনে দাড়াবে। যাওয়ার আগে সে শেষ বারের মত সমস্ত আবেগ নিয়ে সজীবকে জড়িয়ে ধরে আর চিবুক বেয়ে দুজনের চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা গরম জ্বল বেড়িয়ে পড়ে। এরপর ব্লেজারের পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে সজীবের হাতে দিয়ে বলে, পারলে এটা তমাকে পাঠিয়ে দিস। ….
প্লেনের সিটে বসে সিফাত তমাকে এসএমএস লিখে….
আমি তোমায় কতটা ভালবাসি তা তুমি কোন দিন জানবে না, কোন দিন না। ‘যে থাকে আঁখি পল্লবে তার সাথে কেন দেখা হবে; নয়নের জ্বলে যার বাস- সে তো রবে নয়নে নয়নে’। তুমি আমার দৃষ্টিসীমার মাঝে বেঁচে থাকবে অনেক অনেক দিন।
প্লেনের ক্যাপ্টেন ঘোষণা দিল, এখনই তারা যাত্রা মুরু করবে। সিফাত শেষবারের মত এসএমএসটা তমা’র নাম্বারে পাঠিয়ে মোবাইলটা বন্ধ করে দিল।
ধীরে ধীরে প্লেন রানওয়ে পার হয়ে আকাশে উড়তে শুরু করল।
সিফাত মনে মনে তমার কথা ভাবছে। তার মন তাকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা তমা কি চিঠি বা এসএমএসটা পাবে ???
মুচকি হাসে সিফাত। মনে মনেই উত্তর দেয়, পাক বা না পাক তবুও…… অপেক্ষা।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, কষ্টকে যে পুষে রাখতে চায়, ব্যথার শাস্তি তার চিরদিনের।
আজন্ম স্বপ্নের বিসর্জন দিয়ে, কিভাবে শূন্যতা নিয়ে বেঁচে থাকা যায় তাই এবার শেখার পালা……….
যেখানে দাবি আছে, প্রত্যাশা আছে, সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি আছে, সাথে কলহ এবং পূর্ণমিলনও আছে” সেই বন্ধনটিই হলো ‘বন্ধুত্ব’। আমি এভাবে বন্ধুত্বের সঙ্গা বলতে ভালবাসি। তবে এই সঙ্গা টিকে প্রমাণ করেছে আমার এই বিশ্বস্ত বন্ধুটি। আমায় নিয়ে আগ্রহের সীমা নেই মানুষটির! আমার অতি প্রিয় কাছের মানুষ। সাধারণ হয়েও আমার কাছে একটু অসাধারণ একজন !
প্রিয় বেণী-মাধব, প্রিয় মৃদুল চৌধুরী কনক
বলতে পারিস, এক জীবনে কত পূণ্য করলে তোর মত একজন অসাধারণ, অকৃত্রিম বন্ধু পাওয়া যায় ????
আম্মু, সিফাত ভাইয়া কই ? বলতে পার ?
না মা, আমিতো জানি না। হয়ত ড্রইং রুমে বসে পেপার পড়ছে….
সনি ড্রইং রুমে গিয়ে দেখে, সিফাত বসে বসে আনমনে কি যেন ভাবছে।
সনি খুব সাবধানে ধীর পায়ে সিফাতের সামনের সোফায় গিয়ে বসে। অথচ সিফাত নিজের জগতেই মগ্ন আছে।
খানিকক্ষণ পর আলতো কন্ঠে সনি ডাকে, সিফাত ভাইয়া ???
আড়মোরা ভেঙ্গে সিফাত বলে, কি….কি……।সনির দিকে তাকিয়ে বলে, কখন এসেছিস ?
বেশ কিছুক্ষণ হলো এখানে এসেছি। দেখলাম, আপনি খুব মনযোগ দিয়ে কি যেন ভাবছেন ? তাই চুপচাপ বসে আছি।
কি ভাবছেন শুনি ??? বেশ মজার ভঙ্গিতে সনি জিঞ্জেস করে, কার কথা ভাবছেন বলেন তো ????
কথাটা বলে আর হাসতে থাকে সনি।
মলিন হেসে সিফাত বলে, কারো কথা না রে ভাইয়া।
মুচকি হেসে সনি বলে, আমি ছেলেটা একটু বোকা এটা আপনি জানেন। তবে এটুকু কিন্তু বুঝি যে, মানুষ যখন নিজেকে লুকাতে চায় তখন সে মিথ্যে বলে। যেমনটা আপনি বলছেন।
এমন সময় সিফাত এর মোবাইল বেজে ওঠে…… সজীব ফোন করেছে।
হ্যালো, সিফাত ভাই ? বাসায় আছেন ???
হ্যাঁ বাসায় আছি। চলে আয়…….
সজীব বলে, থাকেন, আমি আসছি…….
১৫ মিনিট পর সজীব এসে বসার ঘরে সিফাত এর পাশে বসে। সিফাত এর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে জিঞ্জেস করে,
কি ভাই, মন খারাপ???
জানিসতো কি কারনে মন খারাপ। Something missing in my heart…
হঠাৎ সিফাত গান ধরে, “ কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে তোমারে দেখিতে দেয় না, মন মেঘে তোমারে অন্ধ করে রাখে,
তোমারে দেখিতে দেয় না…….মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না….”।
গান শেষ হলেই সজীব বলে, ওনার নাম্বরতো আছেই- ফোন দেন কথা বলেন। দেখিয়েন, ভাল লাগবে।
আচ্ছা, সজীব এমনটা কেন কেন হলো বলতে পারিস ???
তুইতো জানিস, আমি তার সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছি। আর সে যদি আমায় ভালইবাসত তাহলে রাস্তায় আমায় এতগুলো মানুষের সামনে কেন অপমান করলো ? আমার মা-বাবার নামে বাজে বাজে কথা বলতো ? এমনকি আমি যখন মাস্টার্স করতে বাইরে যাব তখন সে তার মামাকে দিয়ে ফোন করিয়ে আমার ভিসা পর্যন্ত আটকে রেখেছিল ?
কেন, কেন এমন করেছে ???
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সজীব। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলে, আপনি একটু জেদী ছিলেন। আর তমা আপুও ছিল বেশ রাগী। আর রেগে গেলে মানুষ পশুর মত আচরণ করে। আর তমা আপুও রেগে গিয়ে বিভিন্ন উল্টোপাল্টা কাজ করেছে। তবে একটা কথাই বলব, তমা আপু আপনাকে সত্যিই অনেক ভালবাসে।
আমি এবার দেশে আসার পর একদম ভালো নেইরে সজীব। যে মানুষটির কথা কখনো ভাববো না বলে পণ করেছিলাম, তার কথাই বারবার মনে পড়েছে। আমি…… আমি বুঝি পাগল হয়ে যাব রে …… পাগল হয়ে যাব।
সজীব আলতো করে তার হাতটা সিফাতের ঘাড়ে রেখে বলে, একটা কথা মনে রাখবেন- মানুষ তার প্রথম ভালবাসাকে কখনোই ভুলতে পারে না। আর আপনি যখন প্রিয় মানুষদের থেকে দূরে থাকবেন তখনই আপনি তাদের প্রতি আপনার এই ভালবাসার গাঢ়ত্বটা ক্রমশ বাড়বেই।
হঠাৎ সোফা থেকে উঠে দাড়িয়ে সজীব হাঁটতে শুরু করে।
আপনি যতই অস্বীকার করেন না কেন আপনি কিন্তু তমা আপুকে এখনও ভালবাসেন। এটা যত তাড়াতাড়ি মেনে নেন ততই মঙ্গল।
কিন্তু, তমা কি এখন আর আমার কাছে ফিরে আসবে ???
আরে, আসবে না মানে ? আলবত আসবে। হয়ত প্রথমে একটু রাগ ঝাড়বে, এত দিনের জমানো ক্ষোভ তো ….. তারপর দেখবেন, সব ঠিক হয়ে গেছে। ……
১ বছর আগে সিফাত এর সাথে তমা’র বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। তবুও এউ এক বছরের জীবনে সিফাত মাঝে মাঝেই তমার কথা ভেবেছে। সিফাতের চিন্তা-চেতনা, ভাললাগা এসবের সাথে তমার মিল ছিল না বললেই চলে। তাই সারাক্ষণ তাদের মাঝে ঝগড়া লেগেই থাকত। অবশেষে সিফাত স্কলারশিপ পেয়ে লন্ডনে মাস্টার্স করতে চলে গেল। বিদেশে যাওয়ার পরেও সিফাতের জীবনে কোন পরিবর্তন ঘটে নি, কিন্তু অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটে গেছে তমার জীবনে। সিফাত চলে যাওয়ার পর তমার সাথে হাবীব নামের একটা ছেলের পরিচয় ঘটে। তারপর ভাললাগা। আর পরিচয়ের ২ মাসের মধ্যেই হাবীব কিছুটা জোর করে তমার সাথে এংগেষ্টমেন্ট করে ফেলে গোপনে। তারপর আসতে আসতে তমাকে তার বাড়ির সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। বিষয়টা একটু লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হলেও পরে তমার মা, খারারাও জানতে পারে। তমার প্রবল ইচ্ছার কারনেই তার মা-খালারা বিষয়টা মেনে নিয়েছিল।
একসময় বিষয়টা সিফাতও জানতে পারে। সেদিন বেশ কষ্ট পেয়েছিল সে। বুঝেছিল, কাছের মানুষদের হারিয়ে ফেলার কষ্ট কাকে বলে ! একজন মানুষ যে তার জন্যে পাগল ছিল, তাকে পাগলের মত ভালবাসত সে কি না আজ অন্য একটি মানুষের হয়ে গেল। যাকে চাইলেই আর দেখতে পাওয়া যাবে না, চাইলেই আলতো করে তার হাত ছুঁয়ে দেয়া হবে না !!! সারাটা রাত সিফাত বুকের ব্যথায় ঘুমোতে পারে নি। যেন নিজের শরীর থেকে কেউ তাজা এক টুকরো গোশত কেটে নিয়ে গিয়ে সেই ক্ষত স্থানে লবণ লাগিয়ে গেছে। ….
অনেক ভাবছে কিভাবে সিফাত তমার সাথে যোগাযোগ করবে ? যোগাযোগ করার কথা মাথায় আসলেই একরাজ সঙ্কা আর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তার সামনে এসে ভর করে।
অবশেষে সিফাত সাহস করে তমাকে একটা এসএমএস করে,
“ সালাম। কেমন আছেন আপনি ? আপনার বাসার সবাই ? হাবীব ভাই ? আমি মাত্র কয়েকদিন হল দেশে ফিরেছি …..”।
এসএমএসটা পাঠানোর ৩০ মিনিট পরে তমা সিফাতকে কল দেয়। ফোন ধরেই সিফাত বলে, কেমন আছেন আপনি ???
কানিক্ষণ চুপ করে থাকার পর তমা বলে, হ্যাঁ ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন ???
ফিকে হাসি হেসে সিফাত বলে, “জীবন যখন যেমন……তারই মাঝে অবগাহন”। তবে ……..ভাল আছি।
আপনার বাসার সবাই, হাবীব ভাই কেমন আছে ? সিফাত জিঞ্জেস করে।
হ্যাঁ সবাই ভালো আছে। রাব্বী বেশ বড় হয়ে গেছে, ক্লাস এইট এ পড়ছে।
এরপর কিছুক্ষণ দুজনই চুপ করে থাকে, মখে কোন কথা নেই।
দুজন দুজনের একটু কাছাকাছি আসতে চাইলেও বাস্তবতা যেখানে প্রতিকূলে সেখানে কি মনের আবেগ প্রকাশ করা সমীচিন ??? না, কখনোই না। বড়ং তাকে লুকিয়ে রাখাই ভাল।
ধীর কন্ঠে তমা এবার বলে, আমি আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, রাগের মাথায় অনেক খারাপ কথা বলেছি। আমায় ক্ষমা করবেন।
সাথে সাথেই সিফাত বলে, না না আপনি ক্ষমা চাচ্ছেন কেন !!! আপনারতো কোন দোষ নেই। সব দোষ আমার। তাই আমিই আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। এখন আর আপনাকে নিয়ে আমার মনে কোন ক্ষোভ, কোন প্রশ্নবোধক চিহ্ন নেই। বরং আমি আপনাকে বেশ শ্রদ্ধা করি।
সিফাতের কথা গুলো শুনে তমা বেশ অবাক হয়। সিফাত আজ হঠাৎ এরকম কথা বলছে কেন ???
কোন এক গল্পের বইতে পড়েছিলাম, প্রিয় মানুষ দূরে চলে গেলে বা তার সাথে বিচ্ছেদ ঘটলে তার নামে সবসময় ভাল ভাল কথা বলতে হয়। আর আমিও তাই করছি।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তমা বলে, গতবার আপনি লন্ডনে যাওয়ার সময় আমার সাথে একটি বারের জন্যে হলেও দেখা করেন নি। আমি এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এসেছিলাম। তারপরও আপনি দেখা করেন নি। দেখা করলে হয়ত আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হত না। আপনি যা করেছেন আমার সাথে, তা আমি কখনোই ভুলবো না। কখনো না।
নরম সুরে সিফাত বলে, আমিতো আগেই বলেছি- সব দোষ আমার। আমার জন্যেই এতকিছু। আমি বরাবারই নিজের ঘাড়ে দোষ নিয়েছি। এবারও তাই নিলাম।
আর এভাবে কথা বলতে বলতে কথন যে, ৪০ মিনিট পার হয়ে যায় সিফাত বা তমা কেউই টের পায় নি। অবশেষে সিফাত বলে, আজ অনেক কথা হলো। রাখি……. ভাল থাকবেন।
তমা বলে, আপনিও ভাল থাকবেন।
ফোনটা রাখার পর থেকেই সিফাতের বেশ ভালো লাগতে শুরু করে। বাসায় ইলেকট্রিসিটি নেই, বেশ গরম অনুভূত হচ্ছে তবুও পরিবেশটাকে তার অসহ্য মনে হচ্ছে না। অনাবিল আনন্দে মুখরিত সিফাতের চেতনার প্রতিটি মুহূর্ত।
বাড়ির উঠোনে সিফাত চেয়ার নিয়ে গিয়ে বসে আর মোবাইলে গান ছেড়ে দেয়….
“তুমি বরুণা হলে হবো আমি সুনীল…..”
গান শুনতে শুনতে একসময় সিফাত নিজের মুখেই গাইতে শুরু করে….
“ তুমি পাহাড় হলে হবো আমি সবুজ
তুমি শাসন করলে হবো আমি অবুঝ
তুমি অরণ্য হও, হবো পাখি
তুমি অশ্রু হলে হয়ে যাব আঁখি……”
এরপর থেকেই ১ দিন পরপর সিফাত আর তমার ছোট ছোট কথা বলা শুরু হয়।
একদিন সিফাত আর সজীব, নাহিদদের বাসা থেকে ফিরছিল। হঠাৎ সিফাত এর মোবাইলে তমা ফোন দেয়। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আমি আজ দুপুরে হাবীবকে বলে দিয়েছি আমি আর তার সাথে সম্পর্ক রাখতে পারবো না। আমি কোনভাবেই আর পারছি না। এখন আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। কেন যে সেদিন এংগেষ্টমেন্টটা করতে গেলাম !!! আপনি চাইলে আমার সাথে সম্পর্ক আবার কন্টিনিউ করতে পারেন আর না চাইলে আমি একাই থাকবো ……”।
কথাগুলো শুনার পর খানিকক্ষণ সিফাত অসম্ভব আনন্দে ভাসতে থাকে। সাথে সাথেই সজীব আর নাহিদকে এসএমএস করে, “ তমা ফিরে আসছে….. আমি খুব খুশি। খু-উ-উ-ব-ই খুশি ……”।
আর সিফাতের খুশিতে সজীব আর নাহিদও নিজেদের বিলিয়ে দেয়। এরা তিনজন যদিও তিনটি স্বতন্ত্র মানুষ, তবুও বন্ধনের দিক দিয়ে এরা এক আত্মা।
রাতের দিকে সিফাত বেশ আনন্দ নিয়ে তার বড় ভাইকে ফোন দেয়।
কেমন আছো ভাইয়া ??? ভাবি কেমন আছে ???
ভাল আছি। । আর তোর ভাবিও ভাল আছে।
ভাইয়া তুমি কি জান, তুমি খুব ভাগ্যবান একজন মানুষ। সবাই ভালবাসার মানুষকে নিজের মত করে পায় না কিন্তু তুমি পেয়েছ।
আবার এমনও মানুষ আছে যারা সারা জীবনই ভালবাসার মানুষের খবর পায় না, আবার অনেকে পেয়েও হারিয়ে ফেলে…..।
এ সবকিছু বুঝি আমাদের সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য। আচ্ছা ভাইয়া, ভালবাসার মানুষ দূরে চলে গিয়ে আবার ফিরে আসলে কি করা উছিত ??? তাকে কি আপন করে নেওয়া উচিত নাকি বুঝিয়ে দেওয়া উচিত প্রত্যাখান এর ব্যথা কতটা তীব্র ???
দেখ সিফাত, তুই আমায় কি বলতে চাচ্ছিস তা আমি বুঝেছি। তুই চাইলে তমার সাথে আবার সম্পর্কে জড়াতে পারিস তবে….। তবে এটুকু নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, সে আর কোন ঝামেলা করবে না, মা-বাবাকে নিয়ে উল্টোপাল্টা মন্তব্য করবে না। আমরা তোমাকে নিয়ে অন্তত এ বিষয়ে আর টেনশনে থাকতে চাই না।
রাখি এবার। এখন তুই ডিসিশান নে কি করবি ???? ভাল থাকিস।
ফোনটা রাখার পর সিফাতের বেশ মন খারাপ হয়ে যায়। খানিকক্ষণ পর তমা তাকে ফোন করে।
জিঞ্জেস করে, “ কি ডিসিশান নিলেন” ???
ধীর কন্ঠে সিফাত বলে, আপনি আমার কাছে ফিরে আসা মানেই আপনাকে এংগেষ্টমেন্ট ভেঙ্গে ফেলতে হবে। আর এটা করলে আপনার পরিবার, হাবীব ভাইয়ের পরিবার সবাই কষ্ট পাবে। সাথে আপনাকেও শুনতে হবে পরিবারের মানুষের কাছে বিভিন্ন গালমন্দ। এর থেকে কি ভাল না, যা হচ্ছে তাতেই সায় দেওয়া ????
তমা বলে, আমি জানতাম- আমি জানতাম আপনি এখন এ কথা বলবেন। আপনি এত কনফিউস কেন সব বিষয়ে বলেন তো ??? একটা ডিসিশান নিতে পারেন না !!! আর কখনো কোন দিন আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন না। আমি আপনাকে ঘৃণা করি। মনে থাকবে তো, আমি আপনাকে ঘৃণা করি।
একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। বেশ স্নিগ্ধ আবহাওয়া। অথচ সিফাতকেকেমন যেন অগোছালো মনে হচ্ছে। অবচেতন মনে মাটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। একচিলতে উদ্বেলিত করা আনন্দ পরক্ষণেই তাকে আবার মাটিতে এনে ফেলে দিল।
মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলে, “আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি তুমি কোনদিন জানবে না। তোমার পরিবারের মানুষগুলোর কথা, আমার পরিবারের মানুষগুলোর ইচ্ছে, এগুলোর কথা ভাবার কারনেই এই ডিসিশান নিতে হলো। হাবীব ভাই তো আছে যে তোমায় অনেক ভালবাসে। তুমি তার কাছেই সুখে থাকবে। আর আমি না হয় দূর থেকে নিজের স্বপ্নটাকেই বিসর্জন দিলাম। আমায় ভুল বুঝো না তুমি…….ভুল বুঝো না……”
সেদিন রাতে সিফাত এমদম ঘুমোতে পারে নি। বিছানায় মুয়ে শুয়ে চোখের জ্বলে নাহিদ আর সজীবকে এসএমএস এ লিখেছে, “ যেমনি করে একচিলতে বুষ্টির মত এসেছিল তেমনিই চলে গেল তমা। আমি আবারো একা হয়ে গেলাম। আবারো হেরে গেলাম। শুনেছি, হেরে গেলে নাকি পালাতে হয়। বলতে পারিস, আমি পালিয়ে কোথায় যাব ?????
সারারাত তমার কথা ভাবতে ভাবতে একসময় সিফাত অনুশোচনায় ভুগতে শুরু করে। তার কাছে সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়, মানুষের আশা-আকাঙ্খা, কে কি ভাবলো সব তার কাছে অর্থহীণ মনে হয়। সে কেমন যেন পাগলের মত আচরণ করতে শুরু করে। এমন অবস্থা যে তার তমাকে ছাড়া যেন চলবেই না। তার মাথায় কেবলই সজীবের কয়েকটি কথা ঘুরতে থাকে :
“ভালবাসা কোন সূত্র মানে না আর Negotiation should not go beyond our very soul”
তখনই সিফাত সিদ্ধান্ত নেয়, সে তমার কাছেই ফিরে যাবে। কিন্তু সে তো জানত না, বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
সাথে সাথে সে তার ভালবাসার কথা তমার মোবাইলে এসএমএস করে। বেশ কয়েকটা এসএমএস পাঠানোর পর সিফাত হঠাৎ তমার মোবাইলে ফোন দেয়। আর তমা ফোনটা কেটে দিয়ে মোবাইলটা বন্ধ করে দেয়।
এর পর ৭ দিন সিফাত পাগলের মত তমাকে খুঁজেছে। তার মোবাইলে চেষ্টা করেছে, এসএমএস পাঠিয়েছে, তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু পায় নি। খুঁজে পায় নি তার প্রথম ভালবাসাকে। ……
আগামীকাল রাতে অবশেষে সিফাত আবার তার নতুন সেমিষ্টার ধরতে বিদেশের পথে পাড়ি জমাবে। যদিও অনেক রাত হয়ে গিয়েছে তবুও সে বসার ঘরের জানালা দিয়ে তারাভরা আকাশের দিকে নিথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভাবছে, জীবনটা আসলে কি ???
প্রশ্নটা করেই আবার নিস্ফলক তাকিয়ে থাকে। খানিকক্ষণ পর আশেপাশের নিস্তব্ধ পরিবেশ যেন তাকে প্রশ্নের উত্তরটা দিয়ে দেয়।
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ভেসে আসে, জীবন মানে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের খেলা…….।
আর সিফাতের মন বলে ওঠে, তেমনি জীবন মানে অপেক্ষা….. অপেক্ষা…..
জানালার গ্রিল থেকে ফিরে সিফাত কাগজ-কলম নিয়ে তমাকে একটা চিঠি লিখা শুরু করে।
প্রিয় তমা,
বুকের ভিতর কেমন যেন করছে আমার। কোন কোন রাতে এমন হয় । কোন কিছুই করতে ভাল লাগে না; না গল্প করতে, আড্ডা দিতে, না ঘুমোতে, না গল্পের বই পড়তে। ফাঁকা ফাঁকা লাগে সবকিছু- মাথার ভিতর, বুকের ভিতর, আশেপাশের চারপাশ। তাই আপনাকে চিঠি লিখতে বসলাম। ভয় হয় চিঠির মূল্য না দিয়ে যদি অবঙ্গা করেন ? কারণ আমি শুধু আমার কাছের মানুষগুলোকেই চিঠি লিখি। খুব যত্ন করে লিখার চেষ্টা করি। তবে আজকে চিঠি লিখার প্রয়াসটা যতটা না শখের বসে তার চেয়ে বেশি প্রয়োজনের। যতদূর মনে পড়ছে, এটা আপনাকে লিখা আমার দ্বিতীয় চিঠি এবং এটাই শেষ। একটা কথা কি জানেন, আমি আমার কাছের মানুষগুলোকে খুব ভালবাসি। আমার কাছের মানুষগুলো আমায় যতটা ভালবাসে, আমায় যতটা ঘৃণা করে তার চেয়েও বেশি। হ্যাঁ, তার চেয়ের বেশি…………
একটা সময় ছিল যখন আকাশে পাখি উড়ে যেতে দেখলে বেশ আনন্দ হত। এখন তাদের দেখলে আমার চোখে জ্বল এসে যায়। মাঝে মাঝে আবার বাবুই পাখি হতে ইচ্ছে করে। সবকিছু শেষ হয়ে গেলেও, আবার নতুন করে সবকিছু গোছানোর স্পর্ধা দেখাতে ইচ্ছে জাগে। আবার যখন মন বিষন্নতায় ডুবে যায় তখন কেবলই ঐ দূর নীলিমায় নিষ্ফলক তাকিয়ে থাকি আর নিঝের ব্যর্থতা গুলোর কথা ভাবি। কোন এক গল্পের বইতে পড়েছিলাম,
“মেয়েরা নাকি সারাজীবন অপেক্ষাই করে যায়……”
কথাটা শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রেই সত্য তা নয়, পুরুষদের ক্ষেত্রেও সত্য। তবে একান্তভাবে আমরা যে জিনিসটার জন্য অপেক্ষা করি তা হল, প্রিয়জনকে পাশে নিয়ে তার সাথে সুন্দর একটি মুহূর্ত কাটানো……..। কিন্তু আজ আমার ভালবাসার মানুষকে নিয়ে স্বপ্নগুলো আলো-ছায়ায় হারিয়ে গেছে। রঙ্গিন স্বপ্নের মাঝে জলবিহীন বিষাদ-মরিচীকা প্রবেশ করেছে কবেই; যা আজ শুধুই গল্প।
আপনার সাথে আমার যতই ঝগড়া হোক না কেন, আপনি প্রতিশোধ হিসেবে যা কিছুই করেন না কেন, তবুও আমি এখন আপনাকে অনেক বেশি শ্রদ্ধা করি। তার থেকেও বড় কথা, আপনাকে আজও বড্ড ভালবাসি। কারন একটাই, মানুষ তার প্রথম ভালবাসা কখনোই ভুলতে পারে না। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমিও ভুলি নি, অতি যত্ন নিয়ে মনে রেখেছি। আপনার সাথে যখন ঝগড়া চলছিল অনেক দিন আগে তখন একদিন আমায় এসএমএস এ লিখেছিলেন,
“আমি জানি, আপনিও আমায় এখনো ভালোবাসেন……”
বিশ্বাস করুন, সেই দিন এই এসএমএসটা পড়ে বেশ হাসি পেয়েছিল। তবে আজ বুঝতে পারি, আপনার কথাটাই সত্য ছিল। এবার দেশে আসার পর আমি সবচেয়ে বেশি যেই জিনিসটা মিস করেছি সেটা হল আপনার সঙ্গ, এমনকি কারনে-অকারনেও আপনার কথা ভেবেছি। যে কোন একটা জিনিস ভাবতে শুরু করলেই তার সাথে আপনার একটা সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করতাম। যেমন, সেদিন দেখলাম বাইক এ চড়ে একজন ভাই তার মনের মানুষকে নিয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। আর তার মনের মানুষটি অসীম বিশ্বাস আর নির্ভরতায় তার হাতখানা নিয়ে প্রিয়মানুষটির ঘাড় শক্ত করে চেপে ধরেছে। দৃশ্যটা দেখে ভাবলাম, আমার উপরও যদি আপনার এরকম বিশ্বাস থাকতো….!!!!! মানুষ দূরে চলে গেলে বোঝা যায় সে হৃদয়ের কতটা জুড়ে ছিল যা কাছে থাকলে মাঝে মাঝে বোঝা যায় না।
কিন্তু পরিস্তিতি যেখানে প্রতিকূলে সেখানে মানুষের চাওয়া-পাওয়ার মূল্য কতটুকু বলুন ??? আজ আমার ইচ্ছে করছে, আপনার কাছে গিয়ে আপনার হাত ধরে পৃথিবীর সমস্ত অধিকার নিয়ে বলি, “ তুমি শুধুই আমার……..আমার। আমায় একা করে চলে যেয়ো না। তুমি তো জান না, আমার ভালবাসার পুরোটা জুড়ে শুধুই তুমি”।
কিন্তু আমি জানি, এ কথাটা আমার আপনাকে বলা হবে না। কোন দিন না। আর তাই তো, শত অনিশ্চয়তার মাঝে না হয় আমার স্বপ্ন, আমার ইচ্ছেটাকেই বিসর্জন দিলাম।
পরাজিত মানুষের জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই রকম। তারা সারাজীবন ভাবে এক-রকম, স্বপ্ন দেখে এক-রকম কিন্তু তাদের সাথে ঘটে আর এক-রকম। আর স্বপ্ন ভাঙতে ভাঙতে একসময় তাদের নীল হয়ে যাওয়া।
এবার দেশে ফেরার পর থেকেই আমি আপনার সাথে যোগাযোগ করার সাহস যোগাড় করছিলাম। কিন্তু পারি নি। অবশেষে আমাদের কথা হয়েছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনাকে এসএমএস দিয়েছি। শেষে আপনি একদিন বললেন, আপনি আপনার এংগেষ্টমেন্ট ছিন্ন করে আমার কাছে ফিরে আসবেন। আমিও আপনাকে প্রচন্ড ভালবাসি, তাই এ কথাটা শুনার পর নিশ্চই আমার থেকে বেশি খুশি হওয়ার কথা, তাই না ???? অথচ, আপনি এই কথাটা বলার পর আমি প্রতিটি বিষয় অতি সময় নিয়ে ভেবেছি। আপনি আমায় বলেছেন, আপনার এংগেষ্টমেন্ট এর খবর নাকি আপনার মা, খালা সহ আরো অনেকেই জানে। তাই এ সময় আপনার এংগেষ্টমেন্ট ভাংলে আপনার পরিবার কষ্ট পাবে। কথাটা বাইরে জানাজানি হলে খারাপ হবে। তাই আমি অনেক ভেবে নিজেই কষ্ট বরণ করে নিলাম। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, না আপনার কাছে আসার বা আপনাকে ফিরে পাওয়ার চিন্তা আমার মাথায় রাখবো না। আপনিতো বলেছেন, আপনার নতুন মনের মানুষটি আপনাকে অনেক ভালবাসে। আর তাই আপনারতো কোন ক্ষতি হচ্ছে না। অথচ যখন আপনাকে বললাম, যে আপনি আপনার বর্তমান মানুষটির কাছেই থাকেন, তারপর আমি মনের মাঝে একপ্রকার ব্যথা অনুভব করেছি। অনেকটা পাঁজড় ভাঙ্গার মত ব্যথা। যেন আপনাকে ছাড়া আমার চলবেই না। তাই আপনাকে আমি আবার এসএমএস পাঠিয়েছি, যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। বিশ্বাস করুন, আমি তখন কেমন যেন পাগল হয়ে গিয়েছিলাম ! অথচ আপনাকে আর খুঁজে পাই নি….. গভীর ভাবে দেখতে গেলে, সবদিক দিয়ে আমিই হেরে গেলাম। আপনার পরিবারের মানুষের কথা, আপনার কথা, বৃহত্তর মানুষের সুখের কথা ভাবতে গিয়ে আমাকেই সবকিছু হারাতে হল। আপনার পরিবারের আনন্দের কথা ভাবার কারনে আপনি আমাকেই খারাপ ভাবছেনতো, এ নিয়ে আমার আফসোস নেই। জানেন, মাঝে মাঝে ভাবি - পৃথিবীটা কত এগিয়ে গেছে, অথচ আমি এখনো বুঝি সেকেলেই রয়ে গেলাম ! আমার চিন্তাভাবনা গুলোও বুঝি সেই পুরোনো আমলের মানুষের মতোই রয়ে গেল !!! নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে অন্য সব মানুষের আনন্দের কথা ভাবা, প্রিয় মানুষের পরিবারকে নিজের পরিবার ভাবা ইত্যাদি এ যুগে বোকামি ছাড়া বুঝি আর কিছু না।
মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ কি বলতে পারেন ? মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ হল সরলতা। এই সরলতা এমন একটি গুণ যার মাঝে থাকে না কোন ভণিতা, কোন স্বার্থ, কোন উদ্দেশ্য……… স্পৃহাহীণ আমি এক অদৃশ্য পরিচালকের আঙ্গাবহ দাস। নিজেই নিজের জন্য যে গোলক ধাঁধা তৈরি করেছি তা থেকে কি চাইলেই আমি বের হয়ে আসতে পারি ??? না, পারি না। বাইরে থেকে কি বোঝা যায় একটি মানুষের ভিতরে কি চলছে ? না, যায় না। আমার মাঝে যে একটি নয় হাজারো পলিপ আছে তা আমি জানি। আর এক একটি পলিপ তৈরি হয়েছে এক-একটি ভুলের জন্য, এক একটি ব্যর্থতার জন্য, কাছের মানুষগুলোর কাছে থেকে অবহেলা পাবার জন্য, কাছের কিছু বন্ধুদের দ্বারা বারবার Betray এর স্বীকার হওয়ার জন্য…
কবিতা পড়তে আমার খুব ভাল লাগে। এটি আমার একটি অতি প্রিয় কবিতা। না, আমি লিখি নি, সংগৃহীত…
কি দেব তোমায় বল ?
আমি যে মেঘ নই যে তোমায় বৃষ্টি দেব
আমি অসীম নীলিমাও নই যে তোমায় স্নিগ্ধতা দেবো
আমি এক ব্যথিত মানুষ, এমন হৃদয় ভরা ভালবাসি কই ?
আমার ঘরে ফুল ফোটাব, কখনো হাসির রাশি দেব উপহার
তার মত কিছুই তো নেই !!!!!
আমার হাতদুটি এত আলোকিত নয় যে,
অসুখী শরীরে ছোঁয়া দেব আর সেরে যাবে তোমার সব অসুখ।
আমিতো শিশির নই যে তোমার রুক্ষপত্র সিক্ত করবো
আমি কোন কুলুকুলু নদী নই যে,
তোমার হৃদয়ের শস্যক্ষেত ভিজিয়ে দেবো।
এমনকি কোন অরণ্য উদ্ভিদ নই যে,
তোমার দুঃখের পাশে ফুটেঁ থাকবো চাঁপা কি বকুল হয়ে।
আমি কোন শিউলি নই তোমার, ভোরের শুভ্র শয্যা বিছাব।
আমি কোন তৃণ নই যে, বুক পেতে দেব মাথা রেখে অবসাদে শোবে।
এমনকি ঝড়া পাতাও নই যে, বন হবো
ভালবেসে টিপটাপ সারারাত ঝড়বো তোমার সিথানে।
আমি শুধু দিতে পারি ………………… একগুচ্ছ কষ্ট ।।
মাঝে মাঝে যখন খুব একা লাগে তখন চোখ বন্ধ করে প্রাণপনে ভাবতে চেষ্টা করি, “আমার ভালবাসার মানুষটি নীল রঙের শাড়ী, হাতে কাঁচের চুড়ী, কপালে ছোট্ট ঠিপ, ঠোঁটে হালকা লিপষ্টিক, খোঁপায় বেলী ফুলের মালা পড়ে আমার পাশে এসে বসেছেন। হাসিমুখে আমার হাতখানা আলতো করে নিজের দুই হাতের মাঝখানে নিয়ে গল্প করছে আর আমি পূর্ণ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে আছি !” এভাবে ভাবতে ভাবতে আমায় কখনও কখনও এই ভাবনাটাকে বাস্তব বলে মনে হয়। যেন আমি তার গন্ধ পাই, তার স্পর্শ অনুভব করতে পারি।
উচ্ছলতায় ভারা দিন গুলোতে যেমন ছিলাম, এখনও সেই দিন গুলোর মুখোমুখি হলে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করি। তবুও মনের এককোণায় একটা বিষন্নতা সর্বদাই থাকে। অন্যসব পরাজিত আর ব্যর্থ মানুষের মত আমিও তাকিয়ে আছি অনাগত ভবিষ্যতের দিকে, অপেক্ষায় আছি একটি সুন্দর মুহুর্তের, একটুকরো সুখের……।
হয়ত একদিন আমার জীবনেও স্থায়ী ভাবে আসবে কোন এক নারী – ভালবাসার আলোকবর্তিকা নিয়ে। আর সেদিন পর্যন্ত পৃথিবীর
সমস্ত ভালবাসা বুকে নিয়ে আমার তাঁরই জন্যে অমলিন অপেক্ষা- যে হবে সেই মুহুর্তে আমার অতি আপনজন……..।
কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাওয়া ঠিক না। এতে কেবলই কষ্ট বাড়ে….. জীবনে আমি অনেক ভুল করেছি। মাঝে মাঝে মনে হয় ভুল কোন জীনিসই জীবনে রাখতে নেই। আমরা প্রতিটি স্বতন্ত্র মানুষের কাছে জীবনের অর্থও ভিন্ন ভিন্ন। চারদিকে অসংখ্য ভুলের ছড়াছড়ি। প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা, প্রবঞ্চিতকে দেয় দাহ আর অনুতপ্তকে কি দেয় জানেন ?
প্রেম, অনুতপ্তকে দেয় হাহাকার। তীব্র হাহাকার, পাঁজর ভাঙার মত হাহাকার……………… এই হাহাকার সঙ্গী করেই আমি হাঁটছি……. বহু পথ যেতে হবে আমায়……
আজ চমৎকার জ্যোৎনা উঠেছে। আকাশের ঠিক মাঝখানে যেমন মায়াবতী নারীরা কপালের ঠিক মাঝখানে টিপ পড়ে, তেমনি ফুঁটে আছে চাঁদ মামা। আর সূর্য থেকে আলো নিয়ে তাকে জ্যোৎস্নায় রূপান্তরিত করে আমারদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে। চারদিক জ্যোৎনার বন্যায় ভেসে যাচ্ছে।আমার মত ঘূণেধরা,আট-পৌরে মানুষগুলো - যারা হাজারো পলিপ নিয়ে চলে, তারাও আজ জ্যোৎনার রূপালী আলোয় নিজের ছায়া দেখতে পায় যেমন করে আমি পাচ্ছি। সব মানুষ, দালানকোঠা, জীবজন্তু, পশুপাখি ইচ্ছেমত জ্যোৎস্না গায়ে মেখে আনন্দে অবগাহন করছে। ব্যর্থ আর ঘূণে-ধরা মানুষগুলো আকাশের দিকে তাকিয়ে জ্যোৎস্না গায়ে মাখতে মাখতে ভবিষ্যতের স্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়। নিজের গোলাপ পূর্ণ হৃদয় সম্পূর্ণ সমর্পণ করতে চায় ভালবাসার মানুষটিকে আর ভালবাসার মানুষটিকে আলিঙ্গন করে অন্তহীণ সুখ অনুভব করতে চায়। আমার কাছে যদিও সুখটির চেয়ে স্বপ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। কারন সুখের স্বপ্ন, সুখের চেয়ে প্রলম্বিত। সুখ মুহুর্তের আর স্বপ্ন ……………???
স্বপ্নতো চিরদিনের…………… চিরকালের……………
ভাল থাকবেন। শুভ হোক আপনার জীবনের প্রতিটি দিন- আপনার কাছের মানুষদের সাথে নিয়ে আর ভালবাসার মানুষটির অকৃত্রিম ভালবাসায়….. আমিন, আমিন, আমিন।
ফেলে আসা গোধুলীতে হল না আর ফানুস উড়ানো
ভুলের স্রোতে ভুলে গিয়ে তোমারো দেয়া হয় না আর হাতছানি
আমারি স্বপ্নের আকাশ আজ কৃষ্ণসাজে সাজলো
আর হবে না পিছু ফিরে দেখা জীবনের গ্লানি।
ইতি
সিফাত
সিফাতের ফ্লাইট এর সময় হয়ে যাচ্ছে। তার সাথে দেখা করতে এসেছে সোনিয়া নামের একটি মেয়ে। মেয়েটা সিফাতকে অনেক ভালবাসে। সিফাতের পছন্দ-অপছন্দ, ভাললাগা সবকিছুই সে জানে।
চলে যাওয়ার আগে মেয়েটি সিফাতকে বলে,
“ ভাইয়া ! আমার অসীম ভালবাসার বিনিময়ে হলেও কি আপনি আমায় একবিন্দু ভালবাসা দিতে পারবেন না ???”
মাথা নিচু করে ফেলে সিফাত। পড়া না পারা ছাত্রের মত বলে, “একজনের ভালবাসায় আমার হৃদয়টা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে আছে। আর একজনের ভালবাসা আমি কোথায় রাখবো ? আর আমি যে আমার ভালবাসাটুকু একজনকে দিয়ে দিয়েছি কবেই। আজ তোমাকে দেওয়ার মত আমার কাছে কিছুই নেই। আমার ক্ষমা করো’।
কথাটা বলেই সিফাত গাড়িতে উঠতে এগিয়ে যায়। পেছনে মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। কান্নার জ্বলে মেয়েটির চোখের কাজল লেপটে গিয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে।
গাড়ি এয়ারপোর্ট এর দিকে চলছে। সিফাত এর পাশে বসে ওর একটা হাত ধরে রেখেছে সজীব। যেন কিছুতেই কাছের মানুষটিকে চলে যেতে দিবে না। কী মনে করে যেন সজীব একটু পর পরই কেঁপে উঠছে।
সিফাত বুঝতে পারে কিন্তু কিছু বলে না…… যেন নীরবতা পালনের এক খেলায় নেমেছে সবাই।
বোর্ডিং হয়ে গেচে। সিফাত এবার ইমিগ্রেশনে দাড়াবে। যাওয়ার আগে সে শেষ বারের মত সমস্ত আবেগ নিয়ে সজীবকে জড়িয়ে ধরে আর চিবুক বেয়ে দুজনের চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা গরম জ্বল বেড়িয়ে পড়ে। এরপর ব্লেজারের পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে সজীবের হাতে দিয়ে বলে, পারলে এটা তমাকে পাঠিয়ে দিস। ….
প্লেনের সিটে বসে সিফাত তমাকে এসএমএস লিখে….
আমি তোমায় কতটা ভালবাসি তা তুমি কোন দিন জানবে না, কোন দিন না। ‘যে থাকে আঁখি পল্লবে তার সাথে কেন দেখা হবে; নয়নের জ্বলে যার বাস- সে তো রবে নয়নে নয়নে’। তুমি আমার দৃষ্টিসীমার মাঝে বেঁচে থাকবে অনেক অনেক দিন।
প্লেনের ক্যাপ্টেন ঘোষণা দিল, এখনই তারা যাত্রা মুরু করবে। সিফাত শেষবারের মত এসএমএসটা তমা’র নাম্বারে পাঠিয়ে মোবাইলটা বন্ধ করে দিল।
ধীরে ধীরে প্লেন রানওয়ে পার হয়ে আকাশে উড়তে শুরু করল।
সিফাত মনে মনে তমার কথা ভাবছে। তার মন তাকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা তমা কি চিঠি বা এসএমএসটা পাবে ???
মুচকি হাসে সিফাত। মনে মনেই উত্তর দেয়, পাক বা না পাক তবুও…… অপেক্ষা।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, কষ্টকে যে পুষে রাখতে চায়, ব্যথার শাস্তি তার চিরদিনের।
আজন্ম স্বপ্নের বিসর্জন দিয়ে, কিভাবে শূন্যতা নিয়ে বেঁচে থাকা যায় তাই এবার শেখার পালা……….
Friday, October 21, 2011
আকুতি
উৎসর্গ…
মোঃ তৌফিক আরমান
আমার এই ভাইটা বেশ সরল।
বাইরের স্বার্থে ভরা পৃথিবীর অনেকটাই তার অজানা।
কোনদিন বলতে পারি নি, কত ভালবাসি তোকে…….
জানবি না……কোনদিন জানবি না……
আচ্ছা রাহুল ভাইয়া, চাচ্চু কতদূর ??? সেই গতকাল রাতে ঢাকা রওনা দিয়েছে, কিন্তু এখনো পৌছায় নি। একটু কল দিয়ে খবর নেন না প্লিজ…
তুইতো ঠিক-ই বলছিল। বাবা তো এখনো পৌছালো না !!!
সাথে সাথে মোবাইলটা হাতে নিয়ে রাহুল তার বাবাকে কল দেয়।
হ্যালো বাবা, আসসালামু আলাইকুম। কতদূর তুমি ? এখনো পৌছালা না !!!
এখন আমি সাভার পার হচ্ছি বাবা। আর হয়ত এক-দেড় ঘন্টার মধ্যে পৌছে যাব।
ফোন রাখার পর রাহুল কেমন যেন আনমোনা হয়ে যায়। বাসার ড্রইং রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। তার দুষ্টি যেন একজায়গায় স্থির হয়ে গেছে।
নীরব কখন যে তার পেছনে এসে দাড়িয়েছে সে টের-ই পায় নি। আলতো করে নীরব তার হাতখানা রাহুলের কাধেঁর উপর রাখে।
কী ভাবছেন ভাইয়া ??? বেশ ক্ষীণ কন্ঠে নীরব জিঞ্জেস করে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাহুল বলে, কিছু না রে…! বাবার কথা ভাবছি….
বয়স হয়েছে মানুষটার। তবুও সারারাত জার্নি করে ঢাকায় এসে, সারাদিন কাজ করে আবার রাতের কোচে বাড়ি ফেরে। কত কষ্ট হয়, তাই না রে …
ঠিক-ই বলেছেন ভাইয়া। চাচ্চুর বেশ কষ্ট হয়। তবে চাচ্চুকে থাকতে বললেও থাকে না। তিনি আবার রাতের কোচে চলে যায়।
বেশ করুণ স্বরে নীরব ডাকে, ভাইয়া …..!!!
বেশ ধীরে মাথা ঘুড়িয়ে রাহুল বলে, বল ।
চাচ্চুর শরীর বেশ খারাপ। কাউকে কিছু বলেন না। ডাক্তারও দেখাতে চায় না। তবে কিছুদিন আগে জোর করে ডাক্তার দেখানো হয়েছিল। আপনি কি জানেন, চাচ্চু অনেক গুলো ঔষধ খায় ? যতদূর শুনেছি তিনজন ডাক্তারের ঔষধ খেতে হয় তাকে।
রাহুল মাথা নিচু করে কথা গুলো শুনচ্ছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতার ঘরে প্রবেশ করছে। তবুও এই বাতাসকে রাহুলের বড্ড বেশি অসহ্য মনে হচ্ছে।
হঠাৎ একটুকরো বিষন্নতা এসে ঠাঁই নিল রাহুলের মনে। আর ধীরে ধীরে সেটা ছেয়ে গেল তার সমস্ত চেতনায়, সমস্ত অস্তিত্বে……
কিছু ভাল লাগছে না। সবকিছুর মধ্যেই যেন কিছুটা অসম ভাব আছে। কেবলই অন্তরের অন্তঃক্ষরণ এর মাঝে বাস করা।
এমন সময় রাহুলের মোবাইল বেজে ওঠে। তার বাবা ফোন করেছে।
দরজা খুলতেই রাহুল তার বাবার হাতের ব্যাগটা আর অন্যান্য জিনিসপত্র নিজের হাতে নেয়।
হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে এসে তিনি নাস্তা খাওয়া শুরু করেন।
বলেন, দুপুর হয়ে গেছে অথচ কিছুই খাই নি। খুব ক্ষিদে পেয়েছে।
রাহুল ক্ষীণ কন্ঠে তার বাবার জন্য হাফ কাপ চা বানাতে বলে। নাস্তা খাওয়া শেষ হলে রাহুলের বাবা সোফায় বসে চা খাওয়া শুরু করেন আর সিগারেট ধরান। আর আস্তে আস্তে গল্প জুড়ে দেন অনেকদিন পর দেশে ফেরা তার ছোট সন্তান রাহুলের সাথে। আর তার পাশে আছে তারই চাচাত ভাই নীরব।
অনেকক্ষণ গল্প করার পর রাহুলের বাবা, নীরব আর রাহুলের সাথে দুপুরের খাবার খেয়ে বাইরে বেড়িয়ে পড়েন কাজে। রাহুল আনমনে তাকিয়ে থাকে তার বাবার দিকে।
একজন মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে যান্ত্রিক শহরে তার পরিবারের জন্যে হালাল রিযিক উপার্জনের উদ্দেশ্যে। বয়সের ভার আর দায়িত্ববোধের চাপে তিনার ঘাড় একটু নুয়ে পড়লেও তিনি চলছেন তার মতই……সারাদিন রৌদ্রে বেড়ানোর জন্যে শ্যাম বর্ণের মানুষটির মুখ আরো একটু ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বয়সের কারনে চোখের চশমাটার পাওয়ার আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবুও নিজের সাধ্যমত তিনি পরিশ্রম করে যাচ্ছেন……….
একেই হয়ত বলে পিতা….. পিতার পিতৃত্ব…… কিংবা দায়িত্ববোধ ….
রাত প্রায় ১০.৪৫ বেজে গেছে ঘড়িতে, কিন্তু এখনও রাহুলের বাবা বাড়িতে ফেরেন নি। অবশেষে রাত ১১.১৫ এর দিকে তিনি বাসায় ফেরেন। বাসায় ফিরলেই, রাহুল বেশ যত্ন নিয়ে তার বাবাকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এগিয়ে দেন।
রাতের খাওয়া শেষ হলে রাহুলের বাবা সোফায় বসে সিগারেট ধরান।
রাহুল ধীর কন্ঠে বলেন, বাবা ! বয়স হচ্ছে। এখন একটু সিগারেট খাওয়াটা কমানো দরকার।
রাহুলের বাবা সাথে সাথেই বলেন, হ্যাঁ কমানো দরকার, জানি। তুমিতো বাসা আসছোই। তখন একটু একটু করে কমাবো ইনসাল্লাহ।
আমিতো বাবা মাত্র কয়েকদিন থাকবো। এর মাঝে কি কমাতে পারবে ???
হ্যাঁ পারব। তুমি বললে ঠিকই পারবো।
চল বাবা, তোমার ঔষধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তুমি ঘরে যাও আমি পানি নিয়ে আসছি।
রাহুলের বাবা ঘরে গিয়ে ব্যাগ থেকে ঔষধ বের করেন। রাহুল একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে বলে, এগুলো কিসের ঔষধ ???
এগুলো টাইফয়েড এর ঔষধ বাবা।
পরের প্যাকেটটা খুলতেই রাহুলের বাবা বলে, এগুলো দাতেঁর ব্যথার ঔষধ। এই প্যাকেটের ঔষধ খাওয়ার পর তিনি বলেন আরো ঔষধ আছে।
আরেকটা প্যাকেটের ঔষধ ফুড়ে তিনি হাতে নেন। রাহুল পানির গ্লাস টা তিনার দিকে এগিয়ে দেন। নিজের বাবা কতটা অসুস্থ হলে এতগুলো ঔষধ খেতে হয় তাই ভাবছে রাহুর। অজানা কারনে তার চোখের কোণায় পানি জমতে শুরু করেছে।
ঔষধ খাওয়া শেষ করে তার বাবা বিছানায় শুলে, রাহুল বলে, বাবা তোমার পা’গুলো কি আমি একটু চিপে দেব তাহলে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে পারবেন ???
না, না লাগবে না বাবা। আমি এমনিতেই ঘুমোতে পারব। তুমি কখন ঘুমাবা ???
আমি এখন গোসল করে এশার নামায পড়ব, তারপর ঘুমাব।
তারপর রাহুল গোসল সেরে এশার নামায আদায় করে। ড্রইং রুমে চারপাশে বেশ অন্ধকার। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। চারদিক কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগছে রাহুলের।
জানালা দিয়ে ক্ষীণ আলো ঘরে প্রবেশ করছে। রাহুল এই ক্ষীণ আলোর মাঝেই নিজের ছায়া দেখার চেষ্টা করছে। আজ রাহুলের নিজেকেই বড্ড বেশি অচেনা মনে হচ্ছে। চারদিকের অন্ধকার আর রাতের নিস্তবদ্ধতায় রাহুল কেঁপে ওঠে।
আকুল হৃদয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে আর তার চোখের কোণা দিয়ে গরম, দগ্ধ জ্বল গড়িয়ে পড়ে নীরবে। আকুল হৃদয়ে প্রার্থনা করে, আল্লাহ তুমিতো সবার মনের খবর জানো, সবার কষ্টের কথা গুলো জানো। তবে কি তুমি পারো না আমাদের সবার কষ্টগুলো একচিলতে দূর করে দিতে। তোমার কত ক্ষমতা !!! তুমিতো বলেছ, বান্দা আমাকে যেমন মনে করে আমি তার কাছে তেমনই।
আমি রিক্ত, নিঃস হাত তুলে তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, আমার বাবাকে তুমি সুস্থ করে দাও। আমার বাবাকে তুমি সুস্থ করে দাও প্রভু। আমাদের ভুল কৃতকর্মের জন্যে তুমি আমাদের এতবড় শাস্তি দিও না খোদা, দিও না……….
রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। কিন্তু রাহুল এখনো নামাযে দাড়িয়ে মুনাজাত করছে।
আর চোখের গরম জ্বল রাহুলের চিবুক বেয়ে একটু একটু করে গড়িয়ে পড়ছে রাতের নিস্তবদ্ধতায়…….
মোঃ তৌফিক আরমান
আমার এই ভাইটা বেশ সরল।
বাইরের স্বার্থে ভরা পৃথিবীর অনেকটাই তার অজানা।
কোনদিন বলতে পারি নি, কত ভালবাসি তোকে…….
জানবি না……কোনদিন জানবি না……
আচ্ছা রাহুল ভাইয়া, চাচ্চু কতদূর ??? সেই গতকাল রাতে ঢাকা রওনা দিয়েছে, কিন্তু এখনো পৌছায় নি। একটু কল দিয়ে খবর নেন না প্লিজ…
তুইতো ঠিক-ই বলছিল। বাবা তো এখনো পৌছালো না !!!
সাথে সাথে মোবাইলটা হাতে নিয়ে রাহুল তার বাবাকে কল দেয়।
হ্যালো বাবা, আসসালামু আলাইকুম। কতদূর তুমি ? এখনো পৌছালা না !!!
এখন আমি সাভার পার হচ্ছি বাবা। আর হয়ত এক-দেড় ঘন্টার মধ্যে পৌছে যাব।
ফোন রাখার পর রাহুল কেমন যেন আনমোনা হয়ে যায়। বাসার ড্রইং রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। তার দুষ্টি যেন একজায়গায় স্থির হয়ে গেছে।
নীরব কখন যে তার পেছনে এসে দাড়িয়েছে সে টের-ই পায় নি। আলতো করে নীরব তার হাতখানা রাহুলের কাধেঁর উপর রাখে।
কী ভাবছেন ভাইয়া ??? বেশ ক্ষীণ কন্ঠে নীরব জিঞ্জেস করে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাহুল বলে, কিছু না রে…! বাবার কথা ভাবছি….
বয়স হয়েছে মানুষটার। তবুও সারারাত জার্নি করে ঢাকায় এসে, সারাদিন কাজ করে আবার রাতের কোচে বাড়ি ফেরে। কত কষ্ট হয়, তাই না রে …
ঠিক-ই বলেছেন ভাইয়া। চাচ্চুর বেশ কষ্ট হয়। তবে চাচ্চুকে থাকতে বললেও থাকে না। তিনি আবার রাতের কোচে চলে যায়।
বেশ করুণ স্বরে নীরব ডাকে, ভাইয়া …..!!!
বেশ ধীরে মাথা ঘুড়িয়ে রাহুল বলে, বল ।
চাচ্চুর শরীর বেশ খারাপ। কাউকে কিছু বলেন না। ডাক্তারও দেখাতে চায় না। তবে কিছুদিন আগে জোর করে ডাক্তার দেখানো হয়েছিল। আপনি কি জানেন, চাচ্চু অনেক গুলো ঔষধ খায় ? যতদূর শুনেছি তিনজন ডাক্তারের ঔষধ খেতে হয় তাকে।
রাহুল মাথা নিচু করে কথা গুলো শুনচ্ছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতার ঘরে প্রবেশ করছে। তবুও এই বাতাসকে রাহুলের বড্ড বেশি অসহ্য মনে হচ্ছে।
হঠাৎ একটুকরো বিষন্নতা এসে ঠাঁই নিল রাহুলের মনে। আর ধীরে ধীরে সেটা ছেয়ে গেল তার সমস্ত চেতনায়, সমস্ত অস্তিত্বে……
কিছু ভাল লাগছে না। সবকিছুর মধ্যেই যেন কিছুটা অসম ভাব আছে। কেবলই অন্তরের অন্তঃক্ষরণ এর মাঝে বাস করা।
এমন সময় রাহুলের মোবাইল বেজে ওঠে। তার বাবা ফোন করেছে।
দরজা খুলতেই রাহুল তার বাবার হাতের ব্যাগটা আর অন্যান্য জিনিসপত্র নিজের হাতে নেয়।
হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে এসে তিনি নাস্তা খাওয়া শুরু করেন।
বলেন, দুপুর হয়ে গেছে অথচ কিছুই খাই নি। খুব ক্ষিদে পেয়েছে।
রাহুল ক্ষীণ কন্ঠে তার বাবার জন্য হাফ কাপ চা বানাতে বলে। নাস্তা খাওয়া শেষ হলে রাহুলের বাবা সোফায় বসে চা খাওয়া শুরু করেন আর সিগারেট ধরান। আর আস্তে আস্তে গল্প জুড়ে দেন অনেকদিন পর দেশে ফেরা তার ছোট সন্তান রাহুলের সাথে। আর তার পাশে আছে তারই চাচাত ভাই নীরব।
অনেকক্ষণ গল্প করার পর রাহুলের বাবা, নীরব আর রাহুলের সাথে দুপুরের খাবার খেয়ে বাইরে বেড়িয়ে পড়েন কাজে। রাহুল আনমনে তাকিয়ে থাকে তার বাবার দিকে।
একজন মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে যান্ত্রিক শহরে তার পরিবারের জন্যে হালাল রিযিক উপার্জনের উদ্দেশ্যে। বয়সের ভার আর দায়িত্ববোধের চাপে তিনার ঘাড় একটু নুয়ে পড়লেও তিনি চলছেন তার মতই……সারাদিন রৌদ্রে বেড়ানোর জন্যে শ্যাম বর্ণের মানুষটির মুখ আরো একটু ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বয়সের কারনে চোখের চশমাটার পাওয়ার আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবুও নিজের সাধ্যমত তিনি পরিশ্রম করে যাচ্ছেন……….
একেই হয়ত বলে পিতা….. পিতার পিতৃত্ব…… কিংবা দায়িত্ববোধ ….
রাত প্রায় ১০.৪৫ বেজে গেছে ঘড়িতে, কিন্তু এখনও রাহুলের বাবা বাড়িতে ফেরেন নি। অবশেষে রাত ১১.১৫ এর দিকে তিনি বাসায় ফেরেন। বাসায় ফিরলেই, রাহুল বেশ যত্ন নিয়ে তার বাবাকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এগিয়ে দেন।
রাতের খাওয়া শেষ হলে রাহুলের বাবা সোফায় বসে সিগারেট ধরান।
রাহুল ধীর কন্ঠে বলেন, বাবা ! বয়স হচ্ছে। এখন একটু সিগারেট খাওয়াটা কমানো দরকার।
রাহুলের বাবা সাথে সাথেই বলেন, হ্যাঁ কমানো দরকার, জানি। তুমিতো বাসা আসছোই। তখন একটু একটু করে কমাবো ইনসাল্লাহ।
আমিতো বাবা মাত্র কয়েকদিন থাকবো। এর মাঝে কি কমাতে পারবে ???
হ্যাঁ পারব। তুমি বললে ঠিকই পারবো।
চল বাবা, তোমার ঔষধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তুমি ঘরে যাও আমি পানি নিয়ে আসছি।
রাহুলের বাবা ঘরে গিয়ে ব্যাগ থেকে ঔষধ বের করেন। রাহুল একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে বলে, এগুলো কিসের ঔষধ ???
এগুলো টাইফয়েড এর ঔষধ বাবা।
পরের প্যাকেটটা খুলতেই রাহুলের বাবা বলে, এগুলো দাতেঁর ব্যথার ঔষধ। এই প্যাকেটের ঔষধ খাওয়ার পর তিনি বলেন আরো ঔষধ আছে।
আরেকটা প্যাকেটের ঔষধ ফুড়ে তিনি হাতে নেন। রাহুল পানির গ্লাস টা তিনার দিকে এগিয়ে দেন। নিজের বাবা কতটা অসুস্থ হলে এতগুলো ঔষধ খেতে হয় তাই ভাবছে রাহুর। অজানা কারনে তার চোখের কোণায় পানি জমতে শুরু করেছে।
ঔষধ খাওয়া শেষ করে তার বাবা বিছানায় শুলে, রাহুল বলে, বাবা তোমার পা’গুলো কি আমি একটু চিপে দেব তাহলে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে পারবেন ???
না, না লাগবে না বাবা। আমি এমনিতেই ঘুমোতে পারব। তুমি কখন ঘুমাবা ???
আমি এখন গোসল করে এশার নামায পড়ব, তারপর ঘুমাব।
তারপর রাহুল গোসল সেরে এশার নামায আদায় করে। ড্রইং রুমে চারপাশে বেশ অন্ধকার। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। চারদিক কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগছে রাহুলের।
জানালা দিয়ে ক্ষীণ আলো ঘরে প্রবেশ করছে। রাহুল এই ক্ষীণ আলোর মাঝেই নিজের ছায়া দেখার চেষ্টা করছে। আজ রাহুলের নিজেকেই বড্ড বেশি অচেনা মনে হচ্ছে। চারদিকের অন্ধকার আর রাতের নিস্তবদ্ধতায় রাহুল কেঁপে ওঠে।
আকুল হৃদয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে আর তার চোখের কোণা দিয়ে গরম, দগ্ধ জ্বল গড়িয়ে পড়ে নীরবে। আকুল হৃদয়ে প্রার্থনা করে, আল্লাহ তুমিতো সবার মনের খবর জানো, সবার কষ্টের কথা গুলো জানো। তবে কি তুমি পারো না আমাদের সবার কষ্টগুলো একচিলতে দূর করে দিতে। তোমার কত ক্ষমতা !!! তুমিতো বলেছ, বান্দা আমাকে যেমন মনে করে আমি তার কাছে তেমনই।
আমি রিক্ত, নিঃস হাত তুলে তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, আমার বাবাকে তুমি সুস্থ করে দাও। আমার বাবাকে তুমি সুস্থ করে দাও প্রভু। আমাদের ভুল কৃতকর্মের জন্যে তুমি আমাদের এতবড় শাস্তি দিও না খোদা, দিও না……….
রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। কিন্তু রাহুল এখনো নামাযে দাড়িয়ে মুনাজাত করছে।
আর চোখের গরম জ্বল রাহুলের চিবুক বেয়ে একটু একটু করে গড়িয়ে পড়ছে রাতের নিস্তবদ্ধতায়…….
Tuesday, September 13, 2011
পার্থক্য...
উৎসর্গ…
এঞ্জেল অঙ্গনা…
আমায় বড় ভাইয়ের মত মানে। অতি চমৎকার করে অধিকার
নিয়ে কথা বলে সে! আমি তন্ময় হয়ে শুনি। বেশ ভাল লাগে।
সাধারণের মাঝেও একটু অন্যরকম। পার্থক্য করা যায় সহজেই !
কী চমৎকার জ্যোৎস্না উঠেছে দেখ ?
অন্ধকারে জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোয় বৃক্ষগুলোকে মনে হচ্ছে তারা যেন সাক্ষীর মত দাড়িয়ে আছে। পাতাগুলো স্থির, আবার কোনটা মাঝে মাঝে দুলছেও।
হয়ত আমাদের বলে দিচ্ছে, হে মানব সমাজ, তোমাদের শত অবহেলা সহ্য করেও আমি বিশ্বাসী বন্ধুর মতই তোমাদের পাশে আছি……..বেঁচে আছি।
অল্প অল্প কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে চারপাশের পরিবেশ। স্রস্টার অসীম করুণা বয়ে যাচ্ছে অবিরত।
পুথিবীর সব কিছুকেই কেমন যেন নির্ভার মনে হচ্ছে। কোন দায় নেই, কোন দায়িত্ব নেই…… কেবলই ভাবলেশহীণ ভাবে বেঁচে থাকা……..
আচ্ছা রোকন, বলতো আমার মনের ভেতরটায় এমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেন ???
যেন বুকের ভেতরটায় কেউ একজন ছিল, যে আজ ভেতরটা শূন্য করে চলে গেছে।
আজ, সেই মানুষটাকে বড্ড বেশি মনে পড়ছে। যদিও মনে রাখার মত সে অনেক কিছুই করেছে !!!
কোথায় যেন পড়েছিলাম,
“দুই উপায়ে মানুষের মনে জায়গা করা যায় সহজে- এক, বিখ্যাত হয়ে, দ্বিতীয় কুখ্যাত হয়ে’’
অথচ কী আশ্বর্য !!! আজ আমার নাদিরাকেই বেশি মনে পড়ছে। মনে পড়ছে তার মানবীয় কাজ গুলোর কথা।
রোকন জিঞ্জেস করে, আচ্ছা তোদের মাঝে বিচ্ছেদ কেন হলো ???
আমি কিছু বলি না। কেবল তাকিয়ে থাকি শূন্যতা নিয়ে ওই দূর নীলিমায়…….
আমি খুব সুন্দর করে নাদিরাকে ভালবাসার চেষ্টা করেছিলাম। আমার দিক থেকে যথেষ্ট responsible, careful থাকার চেষ্টা করেছিলাম।
সব-ই ছিল, কেবল ছিল না আমার প্রতি ওর বিশ্বাস।
সে মানুষের কথায় বিশ্বাস করত, অথচ আমার কথা বিশ্বাস করত না। বাইরে কার কাছে কি শুনে আমায় এসে বলত, আমার বাবা নাকি পরকীয়া করে, আমি নাকি জারজ সন্তান। সহ আরো অনেক খারাপ কথা। এমনকি আমাকে নিয়েও বাজে বাজে কথা বলতে সে দ্বিধাবোধ করত না।
আমি চেষ্টা করতাম সেগুলো ঠান্ডা মাথায় শুনতে । কারন, মানুষ রেগে গেলে উল্টোপাল্টা বলে, এটাই স্বাভাবিক।
আর আমাদের মাঝে ঝগড়া লেগেই থাকত। একটা জিনিস কি জানিস, জোর করে ভালবাসা হয় না।
পরে অবশ্য সে স্যরি বলত. কিন্তু এতটুকু তো বোঝা যায়, কে স্যরি অনুতপ্ত হয়ে বলে আর কে মন রক্ষার্থে বলে…….
অনেক ঝগড়া আর ঝামেলার পর আমাদের ব্রেক আপ হয়ে যায়। এর পরও সে সুযোগ পেলেই আমার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করত।
আমি একদিন বড় ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলাম এ বিষয়ে। আমি তাকে বলেছি, ভাইয়া আমি নাদিরাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। কারন সবাই ক্ষমা করতে পারে না। যারা পারে তারা সত্যিই ভাগ্যবান। তবে ভুলে যাই নি তার দেওয়া কষ্টগুলো। ভুলে গেলেতো আর শিক্ষা নেওয়া হবে না, তাই না ?
রোকন তন্ময় হয়ে কথাগুলো শুনছে। আচ্ছা, এখন তার খবর কি জানিস ???
জানি। এখন সে অন্য একটি ছেলের সাথে প্রেম করে। সেই ছেলেটা একদিন ফেইসবুকে আমায় রিকুয়েষ্ট পাঠায়। আমি বুঝতে পারি সে কে। পরে একদিন তার সাথে চেট করি।
সে আমায় অনেক প্রশ্ন জিঞ্জেস করে, কেন আমাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে গেল, আমার কি দোষ ছিল, নাদিরা কেমন মেয়ে ইত্যাদি।
আড়মোরা ভেঙ্গে চোখ বড় বড় করে রোকন তাকিয়ে থাকে আমার দিকে ! !
তুই কি বললি তখন ???
আমি ওকে বলেছি, নাদিরা খুব ভাল মেয়ে। আসলে আমার কারনেই আমাদের সম্পর্ক ভেঙ্গেছিল। আমি খুব রাগী একটা মানুষ আর আমাদের মাঝে মতের মিল ছিল না। নাদিরা অনেক চেষ্টা করেছে সমঝোতা করার, ভাল লাগানোর কিন্তু আমিই পারি নি !!!!!
রোকন বলে, তুই এই মিথ্যে কথা গুলো বললি কেন ????
আমি মিথ্যে বলিনি বন্ধু। আসলে কোথায় যেন পড়েছিলাম, “কারো সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে তার সম্পর্কে ভাল ভাল কথা বলতে হয়”।
আমি যা শিখেছি তাই বলেছি আর কি। আর নাদিরা সত্যিই একটা ভাল মেয়ে ।
কথাটা শুনে রোকন কিছুটা রেগে যায়। আমি তোকে সত্যিই বুঝি না। তুই একটা পাগল……বদ্ধ পাগল……..
আমি সব শুনে কেবলই হাসি আর তাকিয়ে থাকি……… আর জ্যোৎস্না গলে গলে পড়ছে……..
স্টুয়ার্ট ফক্স নামের একজন ব্যক্তি তার এক বন্ধু সহ অস্ট্রেলিয়ার একটি বুফে-তে খেতে গিয়েছিল। খাওয়া দাওয়া শেষ করার পর স্টুয়ার্ট আর তার বন্ধু বিল পে করে চলে আসছিল। নিজের সেল ফোনটা ভুলে রেখে আসায় স্টুয়ার্ট আবার বুফেতে সেই টেবিলে যায়। সেলটা নিয়ে ফেরার সময় ঘটে যায় দূর্ঘটনা। মেঝেতে একটু পানি পড়েছিল তা কেউ লক্ষ্য করে নি। আর স্টুয়ার্ট সেখানে পা পিছলে পড়ে যায়। এরপর সে ক্ষতিপূরন এর জন্য আদালতে মামলা করে। আদালত তার মামলায় বুফে কর্তৃপক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করে। এরপর ওই বুফে কর্তৃপক্ষ স্টুযার্টকে ১০০০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার ক্ষতি পূরণ দেয়।
আরেকটা ঘটনা বলি……..
আমি সেদিন কলেজগেট থেকে হেঁটে আসছিলাম। রাত প্রায় ৯ টা বাজে। একজন আপু মেডিকেলে পড়ে, মনে হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ইন্টার্নী করছে। তিনি হেঁটে আসছিলেন। সে সময় আশা ইউনিভার্সিটির সামনে প্রচন্ড জ্যাম লেগেছিল। ইলেকট্রিসিটি না থাকায় রাস্তার আশেপাশে বা নিচে গর্ত আছে কি না তা বোঝা যাচ্ছিল না। আশা ইউনিভার্সিটির একটু আগে রাস্তার পাশেই একটা বড় গর্ত ছিল। হঠাৎ সে আপু হাঁটতে হাঁটতে সেই গর্তের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চারপাশে গাড়ি গিজগিজ করছে। অবশেষে তিনি পা বাড়ালে তার বাম পা পড়ে যায় গর্তে। সাথে সাথেই তিনি হাউমাউ করে চিৎকার করে কেঁদে উঠেন। তিনার পা-টা যে ভেঙ্গে গিয়েছিল তা আর বোঝার বাকি ছিল না। অবশেষে পথচারিরা তাকে গর্ত থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল।
উপরোক্ত দুটি ঘটনাকে বিচার করলে আমরা দেখতে পাই, সামান্য পা পিছলে পড়ে যাওয়ার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় ক্যাফে কর্তৃপক্ষকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। অথচ আমাদের দেশের সেবা দানকারী প্রতিষ্টান যাদের দায়িত্বে অবহেলার কারনেই সেই মানুষটি গর্তে পড়ে গিয়ে পা ভাঙল তাদের কিছুই হয় না। তাদের কোন চিন্তাভাবনাও নেই এ নিয়ে। নেই সেবাদানকারী প্রতিষ্টানের মানুষের জীবন রক্ষার্থে কোন প্রচেষ্টা। থাকলে নিশ্চই তারা ওই গর্তের পাশে, সতর্ক বাণী সংবলিত কোন সাইনবোর্ড অবশ্যই লাগাতেন।
হায় !সেবাদানকারী বাইরের দেশের প্রতিষ্টান আর আমাদের দেশের সেবাদানকারী প্রতিষ্টানের মধ্যে কত পার্থক্য !!!!!!!
মার্কিন সিনেটর জন মেকেইন তার বিবাহের পরও অন্য একজন মহিলা’র সাথে সম্পর্ক রেখেছিলেন। পরে বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেলে, তিনি মিডিয়াতে ওই মহিলার চরিত্র সম্পর্কে বিভিন্ন মিথ্যকথা বলেন। অথচ যতদূর জানা যায়, ওই মহিলা সেরকম খারাপ চরিত্রের ছিলেন না।
কেন জানি আমরা মানুষেরা ইদানিং কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি। মানুষের ক্ষতি করেও এমনকি বিশ্বাসঘাতকতা করেও আমাদের কোন অনুশোচনা হয় না। আমরা যদিও সৃষ্টির সেরা জীব তবুও আমরা ভুল করবো এটাই স্বাভাবিক। আর ভুল করেই আমরা প্রমাণ করি, আমরা পরম করুণাময়ের অতি সাধারণ একটি সৃষ্টি মাত্র।
প্রিয় পাঠক, আমরা ভুল করি, সবাই ভুল করে। তবুও আমরা যেন বন্ধনের বিশুদ্ধতা আর বন্ধনের প্রতি বিশ্বাস বজায় রাখার চেষ্টা করি। ছোট-খাট ভুল যেন বন্ধনের প্রতি কোন আঁচর না ফেলে সেদিকে খেয়াল রাখি।
আমরা সবাই জানি, ক্ষমা মহত্বের লক্ষণ। আমরা মহৎ হতে না পারি, তবুও যেন মানুষকে ক্ষমা করে স্রস্টার এই গুণ-টা অর্জনের চেষ্টা করি। তবে এই ক্ষমা হওয়া উচিত তাদের জন্য যারা ভুল করে অনুতপ্ত হয়।
তাদের জন্য নয় যারা বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাদের সাথে। তবুও অদ্ভুত হলেও সত্য যে, আমরা আমাদের ক্ষমতাবানদেরও ক্ষমা করে দিচ্ছি এত কষ্ট, লাঞ্চনা, অপমান আর বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করার পরও……..
একজন সত্যিকারের মানুষ আর আমাদের মাছে পার্থক্য কতটুকু বলুন তো?????
এঞ্জেল অঙ্গনা…
আমায় বড় ভাইয়ের মত মানে। অতি চমৎকার করে অধিকার
নিয়ে কথা বলে সে! আমি তন্ময় হয়ে শুনি। বেশ ভাল লাগে।
সাধারণের মাঝেও একটু অন্যরকম। পার্থক্য করা যায় সহজেই !
কী চমৎকার জ্যোৎস্না উঠেছে দেখ ?
অন্ধকারে জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোয় বৃক্ষগুলোকে মনে হচ্ছে তারা যেন সাক্ষীর মত দাড়িয়ে আছে। পাতাগুলো স্থির, আবার কোনটা মাঝে মাঝে দুলছেও।
হয়ত আমাদের বলে দিচ্ছে, হে মানব সমাজ, তোমাদের শত অবহেলা সহ্য করেও আমি বিশ্বাসী বন্ধুর মতই তোমাদের পাশে আছি……..বেঁচে আছি।
অল্প অল্প কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে চারপাশের পরিবেশ। স্রস্টার অসীম করুণা বয়ে যাচ্ছে অবিরত।
পুথিবীর সব কিছুকেই কেমন যেন নির্ভার মনে হচ্ছে। কোন দায় নেই, কোন দায়িত্ব নেই…… কেবলই ভাবলেশহীণ ভাবে বেঁচে থাকা……..
আচ্ছা রোকন, বলতো আমার মনের ভেতরটায় এমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেন ???
যেন বুকের ভেতরটায় কেউ একজন ছিল, যে আজ ভেতরটা শূন্য করে চলে গেছে।
আজ, সেই মানুষটাকে বড্ড বেশি মনে পড়ছে। যদিও মনে রাখার মত সে অনেক কিছুই করেছে !!!
কোথায় যেন পড়েছিলাম,
“দুই উপায়ে মানুষের মনে জায়গা করা যায় সহজে- এক, বিখ্যাত হয়ে, দ্বিতীয় কুখ্যাত হয়ে’’
অথচ কী আশ্বর্য !!! আজ আমার নাদিরাকেই বেশি মনে পড়ছে। মনে পড়ছে তার মানবীয় কাজ গুলোর কথা।
রোকন জিঞ্জেস করে, আচ্ছা তোদের মাঝে বিচ্ছেদ কেন হলো ???
আমি কিছু বলি না। কেবল তাকিয়ে থাকি শূন্যতা নিয়ে ওই দূর নীলিমায়…….
আমি খুব সুন্দর করে নাদিরাকে ভালবাসার চেষ্টা করেছিলাম। আমার দিক থেকে যথেষ্ট responsible, careful থাকার চেষ্টা করেছিলাম।
সব-ই ছিল, কেবল ছিল না আমার প্রতি ওর বিশ্বাস।
সে মানুষের কথায় বিশ্বাস করত, অথচ আমার কথা বিশ্বাস করত না। বাইরে কার কাছে কি শুনে আমায় এসে বলত, আমার বাবা নাকি পরকীয়া করে, আমি নাকি জারজ সন্তান। সহ আরো অনেক খারাপ কথা। এমনকি আমাকে নিয়েও বাজে বাজে কথা বলতে সে দ্বিধাবোধ করত না।
আমি চেষ্টা করতাম সেগুলো ঠান্ডা মাথায় শুনতে । কারন, মানুষ রেগে গেলে উল্টোপাল্টা বলে, এটাই স্বাভাবিক।
আর আমাদের মাঝে ঝগড়া লেগেই থাকত। একটা জিনিস কি জানিস, জোর করে ভালবাসা হয় না।
পরে অবশ্য সে স্যরি বলত. কিন্তু এতটুকু তো বোঝা যায়, কে স্যরি অনুতপ্ত হয়ে বলে আর কে মন রক্ষার্থে বলে…….
অনেক ঝগড়া আর ঝামেলার পর আমাদের ব্রেক আপ হয়ে যায়। এর পরও সে সুযোগ পেলেই আমার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করত।
আমি একদিন বড় ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলাম এ বিষয়ে। আমি তাকে বলেছি, ভাইয়া আমি নাদিরাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। কারন সবাই ক্ষমা করতে পারে না। যারা পারে তারা সত্যিই ভাগ্যবান। তবে ভুলে যাই নি তার দেওয়া কষ্টগুলো। ভুলে গেলেতো আর শিক্ষা নেওয়া হবে না, তাই না ?
রোকন তন্ময় হয়ে কথাগুলো শুনছে। আচ্ছা, এখন তার খবর কি জানিস ???
জানি। এখন সে অন্য একটি ছেলের সাথে প্রেম করে। সেই ছেলেটা একদিন ফেইসবুকে আমায় রিকুয়েষ্ট পাঠায়। আমি বুঝতে পারি সে কে। পরে একদিন তার সাথে চেট করি।
সে আমায় অনেক প্রশ্ন জিঞ্জেস করে, কেন আমাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে গেল, আমার কি দোষ ছিল, নাদিরা কেমন মেয়ে ইত্যাদি।
আড়মোরা ভেঙ্গে চোখ বড় বড় করে রোকন তাকিয়ে থাকে আমার দিকে ! !
তুই কি বললি তখন ???
আমি ওকে বলেছি, নাদিরা খুব ভাল মেয়ে। আসলে আমার কারনেই আমাদের সম্পর্ক ভেঙ্গেছিল। আমি খুব রাগী একটা মানুষ আর আমাদের মাঝে মতের মিল ছিল না। নাদিরা অনেক চেষ্টা করেছে সমঝোতা করার, ভাল লাগানোর কিন্তু আমিই পারি নি !!!!!
রোকন বলে, তুই এই মিথ্যে কথা গুলো বললি কেন ????
আমি মিথ্যে বলিনি বন্ধু। আসলে কোথায় যেন পড়েছিলাম, “কারো সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে তার সম্পর্কে ভাল ভাল কথা বলতে হয়”।
আমি যা শিখেছি তাই বলেছি আর কি। আর নাদিরা সত্যিই একটা ভাল মেয়ে ।
কথাটা শুনে রোকন কিছুটা রেগে যায়। আমি তোকে সত্যিই বুঝি না। তুই একটা পাগল……বদ্ধ পাগল……..
আমি সব শুনে কেবলই হাসি আর তাকিয়ে থাকি……… আর জ্যোৎস্না গলে গলে পড়ছে……..
স্টুয়ার্ট ফক্স নামের একজন ব্যক্তি তার এক বন্ধু সহ অস্ট্রেলিয়ার একটি বুফে-তে খেতে গিয়েছিল। খাওয়া দাওয়া শেষ করার পর স্টুয়ার্ট আর তার বন্ধু বিল পে করে চলে আসছিল। নিজের সেল ফোনটা ভুলে রেখে আসায় স্টুয়ার্ট আবার বুফেতে সেই টেবিলে যায়। সেলটা নিয়ে ফেরার সময় ঘটে যায় দূর্ঘটনা। মেঝেতে একটু পানি পড়েছিল তা কেউ লক্ষ্য করে নি। আর স্টুয়ার্ট সেখানে পা পিছলে পড়ে যায়। এরপর সে ক্ষতিপূরন এর জন্য আদালতে মামলা করে। আদালত তার মামলায় বুফে কর্তৃপক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করে। এরপর ওই বুফে কর্তৃপক্ষ স্টুযার্টকে ১০০০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার ক্ষতি পূরণ দেয়।
আরেকটা ঘটনা বলি……..
আমি সেদিন কলেজগেট থেকে হেঁটে আসছিলাম। রাত প্রায় ৯ টা বাজে। একজন আপু মেডিকেলে পড়ে, মনে হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ইন্টার্নী করছে। তিনি হেঁটে আসছিলেন। সে সময় আশা ইউনিভার্সিটির সামনে প্রচন্ড জ্যাম লেগেছিল। ইলেকট্রিসিটি না থাকায় রাস্তার আশেপাশে বা নিচে গর্ত আছে কি না তা বোঝা যাচ্ছিল না। আশা ইউনিভার্সিটির একটু আগে রাস্তার পাশেই একটা বড় গর্ত ছিল। হঠাৎ সে আপু হাঁটতে হাঁটতে সেই গর্তের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চারপাশে গাড়ি গিজগিজ করছে। অবশেষে তিনি পা বাড়ালে তার বাম পা পড়ে যায় গর্তে। সাথে সাথেই তিনি হাউমাউ করে চিৎকার করে কেঁদে উঠেন। তিনার পা-টা যে ভেঙ্গে গিয়েছিল তা আর বোঝার বাকি ছিল না। অবশেষে পথচারিরা তাকে গর্ত থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল।
উপরোক্ত দুটি ঘটনাকে বিচার করলে আমরা দেখতে পাই, সামান্য পা পিছলে পড়ে যাওয়ার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় ক্যাফে কর্তৃপক্ষকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। অথচ আমাদের দেশের সেবা দানকারী প্রতিষ্টান যাদের দায়িত্বে অবহেলার কারনেই সেই মানুষটি গর্তে পড়ে গিয়ে পা ভাঙল তাদের কিছুই হয় না। তাদের কোন চিন্তাভাবনাও নেই এ নিয়ে। নেই সেবাদানকারী প্রতিষ্টানের মানুষের জীবন রক্ষার্থে কোন প্রচেষ্টা। থাকলে নিশ্চই তারা ওই গর্তের পাশে, সতর্ক বাণী সংবলিত কোন সাইনবোর্ড অবশ্যই লাগাতেন।
হায় !সেবাদানকারী বাইরের দেশের প্রতিষ্টান আর আমাদের দেশের সেবাদানকারী প্রতিষ্টানের মধ্যে কত পার্থক্য !!!!!!!
মার্কিন সিনেটর জন মেকেইন তার বিবাহের পরও অন্য একজন মহিলা’র সাথে সম্পর্ক রেখেছিলেন। পরে বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেলে, তিনি মিডিয়াতে ওই মহিলার চরিত্র সম্পর্কে বিভিন্ন মিথ্যকথা বলেন। অথচ যতদূর জানা যায়, ওই মহিলা সেরকম খারাপ চরিত্রের ছিলেন না।
কেন জানি আমরা মানুষেরা ইদানিং কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি। মানুষের ক্ষতি করেও এমনকি বিশ্বাসঘাতকতা করেও আমাদের কোন অনুশোচনা হয় না। আমরা যদিও সৃষ্টির সেরা জীব তবুও আমরা ভুল করবো এটাই স্বাভাবিক। আর ভুল করেই আমরা প্রমাণ করি, আমরা পরম করুণাময়ের অতি সাধারণ একটি সৃষ্টি মাত্র।
প্রিয় পাঠক, আমরা ভুল করি, সবাই ভুল করে। তবুও আমরা যেন বন্ধনের বিশুদ্ধতা আর বন্ধনের প্রতি বিশ্বাস বজায় রাখার চেষ্টা করি। ছোট-খাট ভুল যেন বন্ধনের প্রতি কোন আঁচর না ফেলে সেদিকে খেয়াল রাখি।
আমরা সবাই জানি, ক্ষমা মহত্বের লক্ষণ। আমরা মহৎ হতে না পারি, তবুও যেন মানুষকে ক্ষমা করে স্রস্টার এই গুণ-টা অর্জনের চেষ্টা করি। তবে এই ক্ষমা হওয়া উচিত তাদের জন্য যারা ভুল করে অনুতপ্ত হয়।
তাদের জন্য নয় যারা বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাদের সাথে। তবুও অদ্ভুত হলেও সত্য যে, আমরা আমাদের ক্ষমতাবানদেরও ক্ষমা করে দিচ্ছি এত কষ্ট, লাঞ্চনা, অপমান আর বিশ্বাসঘাতকতা সহ্য করার পরও……..
একজন সত্যিকারের মানুষ আর আমাদের মাছে পার্থক্য কতটুকু বলুন তো?????
Wednesday, June 29, 2011
উপলব্ধি
উৎসর্গ…
প্রিয় আনোয়ার ভাই…
আপনার চমৎকার ব্যবহার শুধু আমাকেই না বরং আরো
অনেককেই মুগ্ধ করেছে, কিন্তু আপনি জানেন না !!!
এই শুনছো ? কই তুমি ? এতবার ডাকতে হয় তোমায় !!!!!! কি কাজে যে এত ব্যস্ত থাক তোমরা !!!!
খানিকক্ষণ পর রান্নাঘর থেকে শাড়ীর আঁচলে হাত মুছতে মুছতে আশরাফ সাহেবের স্ত্রী এসে বলে, কি ব্যাপার ? এত চিৎকার করে ডাকছেন কেন ???
আশরাফ সাহেব মুখটা গম্ভীর করে বলেন, চিৎকার করব না !!! এমন একটা খবর আছে যে তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে।
ভ্রু কুঁচকে তার স্ত্রী জিঞ্জেস করেন, কি খবর ???
আশরাফ সাহেব খানিকটা কাছে এসে মুখে হাসি এনে বলেন, তোমার ছেলে মেডিকেলে চান্স পেয়েছে।
ভাবলেশহীণ কন্ঠে তার স্ত্রী বলেন, এই সকাল সকাল কি আপনার দুষ্টুমি না করলে হয় না ???
আশরাফ সাহেব তার দুটো হাত দিয়ে আলতো করে তার স্ত্রীর গালদুটো ধরে বললেন, সত্যি তোমার ছেলে মেডিকেলে চান্স পেয়েছে।
এবার কথাটা শুনেই তার স্ত্রী হতবাক হয়ে যান। যেন কথাটা বিশ্বাসই হয় না…
আশরাফ সাহেব তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তোমার মত মা পেয়েছে বলেই আজ সিফাত মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। তুমি কত যত্ন করে ওদের মানুষ করেছ এবং এখনো করছো !!!
কথাগুলো শুনতে শুনতে সিফাতের মায়ের চোখের কোণায় কখন যে জল জমে গেছে তিনি টেরই পান নি ….
শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, এত খুশির খবর অথচ মিষ্টি আনেন নি !!!
আশরাফ সাহেব জিভে কামর দিয়ে বলেন, ঠিকই তো ! আসলে তোমায় খবরটা না জানানো পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিলাম না। যাচ্ছি, এখনই মিষ্টি নিয়ে আসছি…..
সিফাত এরই মধ্যে তার রেজাল্টের খবর জেনেছে। বাড়ি ফিরলেই তার মা তাকে অসীম মমতা নিয়ে জড়িয়ে ধরে, কপালের ঠিক মাঝখানটায় আলতো করে চুমু খায়। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে একনয়নে।
ওভাবে কি দেখছো মা ???
কিছু না। তোর চাঁদ মুখখানা দেখছি…
কথাটা শুনেই সিফাত লজ্জা পেয়ে যায়। চোখের চশমাটা একটু উপরে তুলে বলে, আমি একটু আমার রুমে যাচ্ছি মা…
খানিকক্ষণ পর তিতি লাফাতে লাফাতে সিফাতের রুমে এসেই বলে, ভাইয়া, তুমি এত বড় রেজাল্ট করলে কিভাবে ??? তোমার রেজাল্ট তো আমার মাথায়ই ঢুকছে না।
কাথাটা বলতে বলতে তিতি সিফাতের পাশে গিয়ে বসে। সিফাত মুচকি হেসে তিতির একটা হাত ধরে বলে, তোকে আর বুঝতে হবে না এখন, পরে বুঝলেই চলবে।
হঠাৎ উঠে দাড়িয়ে তিতি বলে, এই ড্রেসটা পরে আমায় কেমন লাগছে বলতো ???
খুব সুন্দর লাগছে। একেবারে পরীর মত…।
শুধু ওড়নার এই জায়গাটায় ইঁদুর কেটেছে। কি বিচ্ছিরি লাগছে দেখ তো ?
কথাটা শুনেই মন খারাপ হয়ে যায় সিফাতের। মাথা নিচু করে বলে, আমি সামনের মাসের মাইনে পেলে তোকে একটা জামা কিনে দেব।
সাথে সাথে তিতি বলে, ধুর বোকা ছেলে ! আমি জামা কিনে চেয়েছি নাকি ???
আচ্ছা ভাইয়া, আমরা বড়লোক হলে কেমন হতো ? কথাটা বলেই তিতি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে থাকে…।
সিফাত বলে, না- ভালো হত না। আমার এই জীবনটাই খুব পছন্দের।
তোর কলেজে-তো অনেক ধনী মানুষের মেয়েরা পড়ে। একদিন তাদের জিঞ্জেস করিস তো, তারা কি বলতে পারে বর্ষাকালে টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ কি রকম ? জ্যোৎস্না রাতে চাঁদ দেখার আনন্দ কতটুকু ? মায়ের হাতে শীতের সকালে খিঁচুড়ি আর ডিমভাজি খাওয়ার মজা কতটুকু ? ছেলেমেয়ের অল্প আনন্দেই মায়ের চোখে আনন্দের বন্যা বয়ে যাওয়ার অপূর্ব দৃশ্য কি দেখেছে ? কিংবা শীতকালে, ছোট ভাই-বোনদের নিজের একমাত্র কাঁথাটুকু দিয়ে দেওয়ার মত সেক্রিফাইস কাকে বলে ?
আড়মোরা ভেঙে তিতি বলে, অসম্ভব ! তারা তো এসবের কোনটাই জানে না। তাদের মুখে গল্প শুনে যতদূর জেনেছি, তারা নাকি বৃষ্টিতে ভেজার কিংবা জ্যোৎস্না রাতে চাঁদ দেখার সময়ই পায় না !!! বাসায় বুয়া এসে রান্না করে দিয়ে যায়। তাদের মা নাকি বছরে ২/১ দিন রান্নাঘরে যায় ! তাদের নাকি বড় ভাই-বোনদের সাথে সারাদিনে কখনও একবার কথাও হয় না !!!
অপূর্ব মমতা নিয়ে তিতি সিফাতের দিকে তাকায়।
আমি খুব ভাগ্যবতী ভাইয়া। তোমার মত একটি ভাইয়া পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের বিষয়।
তুমি কি জান ভাইয়া, তুমি একটা পাগল ???
সিফাত মুখে হাসি এনে বলে, কেন ???
তুমি এমন একজন মানুষ, যে কিনা তার বোনের পরীক্ষার সময় সারাটাক্ষণ হলের বাইরে ছাতা আর জুস নিয়ে দাড়িয়ে থাকে। টিউশনির মাইনে পেলে পুরোটাই এনে মায়ের হাতে তুলে দেয়। মাঝে মধ্যেই ছোট বোনকে নিয়ে ফুচকা কেতে যায়। পরীক্ষার সময় নিজে, গ্লাসে রাখা দুধটুকু না খেয়ে, বিভিন্ন বাহানা করে-গল্প বানিয়ে ছোট বোনকে খাওয়ায়। পরিবারের কারো মন খারাপ হলে তার মন ভাল করার জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকে। কারো কোন প্রয়োজন হলেই সাধ্যমত সাহায্য করে। নিজের তৈরি করা নোট সে কি না নিজের প্রতিদ্বন্দীকে পড়তে দেয় অবলীলায়….!!!
আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমার ভাইয়ের মত একটা ভাইও পৃথিবীতে পাওয়া যাবে না। আমি যদি দ্বিতীয় বার জন্মগ্রহণ করি তাহলেও আমি তোমাকেই আমার ভাই হিসেবে পেতে চাই। তোমার মাথার নিচের অনাবিল আশ্রয়ে ঠাঁই পেতে চাই।
সিফাতের চোখের কোণায় পানি চমতে শুরু করেছে।
মায়াভরা কন্ঠে তিতি বলে, বলতে পার কিভাবে তোমার মত একজন পরপোকারী, বিশ্বাসী আর শুদ্ধ মানুষ হওয়া যায় ??? বল না, ভাইয়া ???....
আশরাফ সাহেব বারান্দায় চেয়ারে বসে কি যেন ভাবছিলেন।
ঘড়িতে বাজে প্রায় রাত ন’টা। সিফাত কখন তার পাশে এসে বসেছে তিনি টেরই পান নি।
কি ভাবছো বাবা ???
মাথা ঘুড়িয়ে বলেন, ও সিফাত ! কিছু না রে …. এমনি…..
আজ জ্যোৎস্না উঠেছে। দেখ, চারদিক জ্যোৎস্নার রূপালী রং ধারণ করেছে। যেন আজ প্রকৃতির পূর্ণজন্মের দিন।
হ্যাঁ ঠিক ই বলেছিস।
আচ্ছা সিফাত, তোর কাছে জীবনের মানে কি ???
ভ্রু কুঁচকে সিফাত বলে, হঠাৎ এ প্রশ্ন বাবা ??? না, এমনি করলাম।
জ্যোস্নার রূপালী আলোয় আলোকিত আকাশের দিকে তাকিয়ে সিফাত বলে, আমার মতে ‘পাওয়া আর না পাওয়ার দোদুল্যমানই হচ্ছে জীবন’। তবে বাবা জীবনের আর একটা অর্থ আছে আর সেটা হল অপেক্ষা। এই অপেক্ষার পালাবদল হয় আমাদের ক্ষণে ক্ষণে…।
এবার বল, তোমার কাছে জীবনের সঙ্গা কি ???
আমি খুবই সাদাসিধে একজন মানুষ। তাই আমার সঙ্গাটাও সরল। আমার মতে, ‘জীবন মানে উপলব্ধি’। এক-একটি জিনিসের অভিঙ্গতা লাভ করা।
আর তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই উপভোগ করা উচিত।
আশরাফ সাহেব জিঞ্জেস করেন, তুই তোর জীবনকে কতটুকু উপভোগ করিস ???
বাবা, জীবনের কাছে আমার কোন অভিযোগ নেই। প্রতি সকালে মা অতি মমতা নিয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে আমায় নাস্তা খেতে দেন। আর সাথে একরাশ মমতা নিয়ে তাকিয়ে সন্তানের খাওয়া দেখেন। আমি এটা উপভোগ করি। ক্লাসের পর আমি টিউশনি করাতে যাই। টিউশনি থেকে ফেরার সময় দেখি, বন্ধুরা বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেয় অথচ আমি পারি না। আমি এটাও উপভোগ করি। অনেকেই রিক্সায় কিংবা বাসে চড়ে কলেজে যায়। আমি পিচঢালা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কলেজে যাই। আমি এটাও উপভোগ করি। ক্লাসের পর কিংবা ছুটির দিনে বন্ধুরা তাদের প্রিয়মানুষকে নিয়ে এখানে ওখানে বেড়াতে যায়। অথচ আমি বাড়ি ফিরে আমার পরিবারের সাথে সময় কাটাই। আমি এটাও উপভোগ করি। আমাদের রাজনীতিবিদদের অকথ্য গালাগালি শুনলে আমার হাসি পায় অপর দিকে গরীব দু:খী মানুষ দেখলেই আমার বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে তাদের কষ্টের কথা ভেবে। আমি এগুলোও উপভোগ করি।
আশরাফ সাহেব ম্লান কন্ঠে বলেন, আমি তোর জন্য কিছুই করতে পারলাম না রে !!!
সিফাত বলে, বাবা তুমি এমনিতেই এতকিছু করেছ যে, আমি সারাজীবন চেষ্টা করলেও এর প্রতিদান দিতে পারব না।
আমরা প্রতিদিন মাছ-গোশত খেতে না পারি, প্রতিমাসে কিংবা বছরে চাইনিজ খেতে না পারি, এয়ার কন্ডিশন রুমে ঘুমাতে না পারি, নতুন নতুন জামা-কাপড় চাইলেই পড়তে না পারি, আমরা অন্য আরেকটা জিনিস পারি যা অনেকেই পারে না। পাহাড় সমান সম্পদ থাকা সত্ত্বেও অনেকে পারে না।
আর সেটা হল, অনেক অল্প জিনিসের মাঝেই আনন্দ খুঁজে নেওয়া আর জীবনকে উপভোগ করা। …..
সিফাতের ৪র্থ বর্ষের রেজাল্ট বেরিয়েছে। সবমিলিয়ে সে এবারও প্রথম হয়েছে। বাসার সবাই মহাখুশি।
সেই খুশিতে আজ আশরাফ সাহেব সবাইকে ফুচকা খাওয়াবে।
ছোটবোন তিতি কাপড় পরে রেডি হয়ে গিয়েছে। তার মায়ের রুমে গেলেই তিতি লক্ষ্য করে, আজ তার মা ঠোঁটে হালকা লিপষ্টিক দিয়েছে, কপালের ঠিক মাঝখানে একটা বড় টিপ দিয়েছে।
দীর্য ২১ বছরের সংসার জীবনে তিতির মা হাতে গোণা মাত্র ২/৩ বার সেজেছে।
তিতি মুচকি হেসে বলে, মা তোমায় বেশ সুন্দরী লাগছে।
সাথে সাথে লজ্জা পেয়ে যায় তার মা। নিজেকে আড়াল করার জন্য কি যেন খুঁজতে শুরু করে।
তিতি বলে, যাই বাবাকে গিয়ে বলি আমরা সবাই রেডি……
ফজরের আযান হয়েছে। নামায আদায় করে আশরাফ সাহেব সিফাতের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। তিনি সিফাতের মাথার কাছে গিয়ে বসে আলতো করে তার চুলে হাত বুলাতে থাকে।
ধীর কন্ঠে ডাকে, সিফাত, বাবা সিফাত। ঘুম থেকে ওঠ। ফজরের নামায পড়বি না ???
ঘুম থেকে ওঠে বিছানায় বসে সিফাত বলে, ভালোই করেছ আমায় ডেকে। নইলে নামাযটা মিস হয়ে যেত।
আশরাফ সাহেব বলেন, একজন মানুষ তার জীবনে সবকিছু পায় না কখনই। আর যদি পেত তাহলে জীবনের স্বার্থকতা বলে কিছু থাকত না। তবে প্রতিটি মানুষই কিছু কিছু মূল্যবান জিনিস পায়। আমিও পেয়েছি।
জানিস সেটা কি ???? না, জানি না বাবা।
আমার সেই মূল্যবান জিনিসটা হল, তুই – আমার সন্তান।
এক জীবনে যে কতগুলো পূণ্য করলেই তোর মত সন্তান পাওয়া যায় তা আল্লাহই জানেন। কিন্তু আমি তোর বাবা হতে পেরে ধন্য।
সিফাত কিছু বলে না, কেবল মাথা নিচু করে থাকে।
দু’জনের চোখ চিকচিক করছে। খানিকক্ষণ পরেই বর্ষার জলধারার মত জ্বল গড়িয়ে পড়বে।
বাইরে রাতজাগা পাখিগুলো কিচিরমিচির করছে।
আস্তে আস্তে সকাল হচ্ছে।
একবুক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে উদিত হচ্ছে নতুন দিনের সূর্য……….
প্রিয় আনোয়ার ভাই…
আপনার চমৎকার ব্যবহার শুধু আমাকেই না বরং আরো
অনেককেই মুগ্ধ করেছে, কিন্তু আপনি জানেন না !!!
এই শুনছো ? কই তুমি ? এতবার ডাকতে হয় তোমায় !!!!!! কি কাজে যে এত ব্যস্ত থাক তোমরা !!!!
খানিকক্ষণ পর রান্নাঘর থেকে শাড়ীর আঁচলে হাত মুছতে মুছতে আশরাফ সাহেবের স্ত্রী এসে বলে, কি ব্যাপার ? এত চিৎকার করে ডাকছেন কেন ???
আশরাফ সাহেব মুখটা গম্ভীর করে বলেন, চিৎকার করব না !!! এমন একটা খবর আছে যে তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে।
ভ্রু কুঁচকে তার স্ত্রী জিঞ্জেস করেন, কি খবর ???
আশরাফ সাহেব খানিকটা কাছে এসে মুখে হাসি এনে বলেন, তোমার ছেলে মেডিকেলে চান্স পেয়েছে।
ভাবলেশহীণ কন্ঠে তার স্ত্রী বলেন, এই সকাল সকাল কি আপনার দুষ্টুমি না করলে হয় না ???
আশরাফ সাহেব তার দুটো হাত দিয়ে আলতো করে তার স্ত্রীর গালদুটো ধরে বললেন, সত্যি তোমার ছেলে মেডিকেলে চান্স পেয়েছে।
এবার কথাটা শুনেই তার স্ত্রী হতবাক হয়ে যান। যেন কথাটা বিশ্বাসই হয় না…
আশরাফ সাহেব তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তোমার মত মা পেয়েছে বলেই আজ সিফাত মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। তুমি কত যত্ন করে ওদের মানুষ করেছ এবং এখনো করছো !!!
কথাগুলো শুনতে শুনতে সিফাতের মায়ের চোখের কোণায় কখন যে জল জমে গেছে তিনি টেরই পান নি ….
শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, এত খুশির খবর অথচ মিষ্টি আনেন নি !!!
আশরাফ সাহেব জিভে কামর দিয়ে বলেন, ঠিকই তো ! আসলে তোমায় খবরটা না জানানো পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিলাম না। যাচ্ছি, এখনই মিষ্টি নিয়ে আসছি…..
সিফাত এরই মধ্যে তার রেজাল্টের খবর জেনেছে। বাড়ি ফিরলেই তার মা তাকে অসীম মমতা নিয়ে জড়িয়ে ধরে, কপালের ঠিক মাঝখানটায় আলতো করে চুমু খায়। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে একনয়নে।
ওভাবে কি দেখছো মা ???
কিছু না। তোর চাঁদ মুখখানা দেখছি…
কথাটা শুনেই সিফাত লজ্জা পেয়ে যায়। চোখের চশমাটা একটু উপরে তুলে বলে, আমি একটু আমার রুমে যাচ্ছি মা…
খানিকক্ষণ পর তিতি লাফাতে লাফাতে সিফাতের রুমে এসেই বলে, ভাইয়া, তুমি এত বড় রেজাল্ট করলে কিভাবে ??? তোমার রেজাল্ট তো আমার মাথায়ই ঢুকছে না।
কাথাটা বলতে বলতে তিতি সিফাতের পাশে গিয়ে বসে। সিফাত মুচকি হেসে তিতির একটা হাত ধরে বলে, তোকে আর বুঝতে হবে না এখন, পরে বুঝলেই চলবে।
হঠাৎ উঠে দাড়িয়ে তিতি বলে, এই ড্রেসটা পরে আমায় কেমন লাগছে বলতো ???
খুব সুন্দর লাগছে। একেবারে পরীর মত…।
শুধু ওড়নার এই জায়গাটায় ইঁদুর কেটেছে। কি বিচ্ছিরি লাগছে দেখ তো ?
কথাটা শুনেই মন খারাপ হয়ে যায় সিফাতের। মাথা নিচু করে বলে, আমি সামনের মাসের মাইনে পেলে তোকে একটা জামা কিনে দেব।
সাথে সাথে তিতি বলে, ধুর বোকা ছেলে ! আমি জামা কিনে চেয়েছি নাকি ???
আচ্ছা ভাইয়া, আমরা বড়লোক হলে কেমন হতো ? কথাটা বলেই তিতি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে থাকে…।
সিফাত বলে, না- ভালো হত না। আমার এই জীবনটাই খুব পছন্দের।
তোর কলেজে-তো অনেক ধনী মানুষের মেয়েরা পড়ে। একদিন তাদের জিঞ্জেস করিস তো, তারা কি বলতে পারে বর্ষাকালে টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ কি রকম ? জ্যোৎস্না রাতে চাঁদ দেখার আনন্দ কতটুকু ? মায়ের হাতে শীতের সকালে খিঁচুড়ি আর ডিমভাজি খাওয়ার মজা কতটুকু ? ছেলেমেয়ের অল্প আনন্দেই মায়ের চোখে আনন্দের বন্যা বয়ে যাওয়ার অপূর্ব দৃশ্য কি দেখেছে ? কিংবা শীতকালে, ছোট ভাই-বোনদের নিজের একমাত্র কাঁথাটুকু দিয়ে দেওয়ার মত সেক্রিফাইস কাকে বলে ?
আড়মোরা ভেঙে তিতি বলে, অসম্ভব ! তারা তো এসবের কোনটাই জানে না। তাদের মুখে গল্প শুনে যতদূর জেনেছি, তারা নাকি বৃষ্টিতে ভেজার কিংবা জ্যোৎস্না রাতে চাঁদ দেখার সময়ই পায় না !!! বাসায় বুয়া এসে রান্না করে দিয়ে যায়। তাদের মা নাকি বছরে ২/১ দিন রান্নাঘরে যায় ! তাদের নাকি বড় ভাই-বোনদের সাথে সারাদিনে কখনও একবার কথাও হয় না !!!
অপূর্ব মমতা নিয়ে তিতি সিফাতের দিকে তাকায়।
আমি খুব ভাগ্যবতী ভাইয়া। তোমার মত একটি ভাইয়া পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের বিষয়।
তুমি কি জান ভাইয়া, তুমি একটা পাগল ???
সিফাত মুখে হাসি এনে বলে, কেন ???
তুমি এমন একজন মানুষ, যে কিনা তার বোনের পরীক্ষার সময় সারাটাক্ষণ হলের বাইরে ছাতা আর জুস নিয়ে দাড়িয়ে থাকে। টিউশনির মাইনে পেলে পুরোটাই এনে মায়ের হাতে তুলে দেয়। মাঝে মধ্যেই ছোট বোনকে নিয়ে ফুচকা কেতে যায়। পরীক্ষার সময় নিজে, গ্লাসে রাখা দুধটুকু না খেয়ে, বিভিন্ন বাহানা করে-গল্প বানিয়ে ছোট বোনকে খাওয়ায়। পরিবারের কারো মন খারাপ হলে তার মন ভাল করার জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকে। কারো কোন প্রয়োজন হলেই সাধ্যমত সাহায্য করে। নিজের তৈরি করা নোট সে কি না নিজের প্রতিদ্বন্দীকে পড়তে দেয় অবলীলায়….!!!
আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমার ভাইয়ের মত একটা ভাইও পৃথিবীতে পাওয়া যাবে না। আমি যদি দ্বিতীয় বার জন্মগ্রহণ করি তাহলেও আমি তোমাকেই আমার ভাই হিসেবে পেতে চাই। তোমার মাথার নিচের অনাবিল আশ্রয়ে ঠাঁই পেতে চাই।
সিফাতের চোখের কোণায় পানি চমতে শুরু করেছে।
মায়াভরা কন্ঠে তিতি বলে, বলতে পার কিভাবে তোমার মত একজন পরপোকারী, বিশ্বাসী আর শুদ্ধ মানুষ হওয়া যায় ??? বল না, ভাইয়া ???....
আশরাফ সাহেব বারান্দায় চেয়ারে বসে কি যেন ভাবছিলেন।
ঘড়িতে বাজে প্রায় রাত ন’টা। সিফাত কখন তার পাশে এসে বসেছে তিনি টেরই পান নি।
কি ভাবছো বাবা ???
মাথা ঘুড়িয়ে বলেন, ও সিফাত ! কিছু না রে …. এমনি…..
আজ জ্যোৎস্না উঠেছে। দেখ, চারদিক জ্যোৎস্নার রূপালী রং ধারণ করেছে। যেন আজ প্রকৃতির পূর্ণজন্মের দিন।
হ্যাঁ ঠিক ই বলেছিস।
আচ্ছা সিফাত, তোর কাছে জীবনের মানে কি ???
ভ্রু কুঁচকে সিফাত বলে, হঠাৎ এ প্রশ্ন বাবা ??? না, এমনি করলাম।
জ্যোস্নার রূপালী আলোয় আলোকিত আকাশের দিকে তাকিয়ে সিফাত বলে, আমার মতে ‘পাওয়া আর না পাওয়ার দোদুল্যমানই হচ্ছে জীবন’। তবে বাবা জীবনের আর একটা অর্থ আছে আর সেটা হল অপেক্ষা। এই অপেক্ষার পালাবদল হয় আমাদের ক্ষণে ক্ষণে…।
এবার বল, তোমার কাছে জীবনের সঙ্গা কি ???
আমি খুবই সাদাসিধে একজন মানুষ। তাই আমার সঙ্গাটাও সরল। আমার মতে, ‘জীবন মানে উপলব্ধি’। এক-একটি জিনিসের অভিঙ্গতা লাভ করা।
আর তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই উপভোগ করা উচিত।
আশরাফ সাহেব জিঞ্জেস করেন, তুই তোর জীবনকে কতটুকু উপভোগ করিস ???
বাবা, জীবনের কাছে আমার কোন অভিযোগ নেই। প্রতি সকালে মা অতি মমতা নিয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে আমায় নাস্তা খেতে দেন। আর সাথে একরাশ মমতা নিয়ে তাকিয়ে সন্তানের খাওয়া দেখেন। আমি এটা উপভোগ করি। ক্লাসের পর আমি টিউশনি করাতে যাই। টিউশনি থেকে ফেরার সময় দেখি, বন্ধুরা বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেয় অথচ আমি পারি না। আমি এটাও উপভোগ করি। অনেকেই রিক্সায় কিংবা বাসে চড়ে কলেজে যায়। আমি পিচঢালা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কলেজে যাই। আমি এটাও উপভোগ করি। ক্লাসের পর কিংবা ছুটির দিনে বন্ধুরা তাদের প্রিয়মানুষকে নিয়ে এখানে ওখানে বেড়াতে যায়। অথচ আমি বাড়ি ফিরে আমার পরিবারের সাথে সময় কাটাই। আমি এটাও উপভোগ করি। আমাদের রাজনীতিবিদদের অকথ্য গালাগালি শুনলে আমার হাসি পায় অপর দিকে গরীব দু:খী মানুষ দেখলেই আমার বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে তাদের কষ্টের কথা ভেবে। আমি এগুলোও উপভোগ করি।
আশরাফ সাহেব ম্লান কন্ঠে বলেন, আমি তোর জন্য কিছুই করতে পারলাম না রে !!!
সিফাত বলে, বাবা তুমি এমনিতেই এতকিছু করেছ যে, আমি সারাজীবন চেষ্টা করলেও এর প্রতিদান দিতে পারব না।
আমরা প্রতিদিন মাছ-গোশত খেতে না পারি, প্রতিমাসে কিংবা বছরে চাইনিজ খেতে না পারি, এয়ার কন্ডিশন রুমে ঘুমাতে না পারি, নতুন নতুন জামা-কাপড় চাইলেই পড়তে না পারি, আমরা অন্য আরেকটা জিনিস পারি যা অনেকেই পারে না। পাহাড় সমান সম্পদ থাকা সত্ত্বেও অনেকে পারে না।
আর সেটা হল, অনেক অল্প জিনিসের মাঝেই আনন্দ খুঁজে নেওয়া আর জীবনকে উপভোগ করা। …..
সিফাতের ৪র্থ বর্ষের রেজাল্ট বেরিয়েছে। সবমিলিয়ে সে এবারও প্রথম হয়েছে। বাসার সবাই মহাখুশি।
সেই খুশিতে আজ আশরাফ সাহেব সবাইকে ফুচকা খাওয়াবে।
ছোটবোন তিতি কাপড় পরে রেডি হয়ে গিয়েছে। তার মায়ের রুমে গেলেই তিতি লক্ষ্য করে, আজ তার মা ঠোঁটে হালকা লিপষ্টিক দিয়েছে, কপালের ঠিক মাঝখানে একটা বড় টিপ দিয়েছে।
দীর্য ২১ বছরের সংসার জীবনে তিতির মা হাতে গোণা মাত্র ২/৩ বার সেজেছে।
তিতি মুচকি হেসে বলে, মা তোমায় বেশ সুন্দরী লাগছে।
সাথে সাথে লজ্জা পেয়ে যায় তার মা। নিজেকে আড়াল করার জন্য কি যেন খুঁজতে শুরু করে।
তিতি বলে, যাই বাবাকে গিয়ে বলি আমরা সবাই রেডি……
ফজরের আযান হয়েছে। নামায আদায় করে আশরাফ সাহেব সিফাতের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। তিনি সিফাতের মাথার কাছে গিয়ে বসে আলতো করে তার চুলে হাত বুলাতে থাকে।
ধীর কন্ঠে ডাকে, সিফাত, বাবা সিফাত। ঘুম থেকে ওঠ। ফজরের নামায পড়বি না ???
ঘুম থেকে ওঠে বিছানায় বসে সিফাত বলে, ভালোই করেছ আমায় ডেকে। নইলে নামাযটা মিস হয়ে যেত।
আশরাফ সাহেব বলেন, একজন মানুষ তার জীবনে সবকিছু পায় না কখনই। আর যদি পেত তাহলে জীবনের স্বার্থকতা বলে কিছু থাকত না। তবে প্রতিটি মানুষই কিছু কিছু মূল্যবান জিনিস পায়। আমিও পেয়েছি।
জানিস সেটা কি ???? না, জানি না বাবা।
আমার সেই মূল্যবান জিনিসটা হল, তুই – আমার সন্তান।
এক জীবনে যে কতগুলো পূণ্য করলেই তোর মত সন্তান পাওয়া যায় তা আল্লাহই জানেন। কিন্তু আমি তোর বাবা হতে পেরে ধন্য।
সিফাত কিছু বলে না, কেবল মাথা নিচু করে থাকে।
দু’জনের চোখ চিকচিক করছে। খানিকক্ষণ পরেই বর্ষার জলধারার মত জ্বল গড়িয়ে পড়বে।
বাইরে রাতজাগা পাখিগুলো কিচিরমিচির করছে।
আস্তে আস্তে সকাল হচ্ছে।
একবুক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে উদিত হচ্ছে নতুন দিনের সূর্য……….
Sunday, June 26, 2011
নীল তেপান্তরে
উৎসর্গ…
জনপ্রিয় লেখিকা, সুচিত্রা ভট্টাচার্য
“কাছের মানুষ” উপন্যাসে আপনি মানুষের জীবনের একাকীত্বের সার্থক চিত্র যেভাবে তুলে ধরেছেন, সেভাবে অন্য কেউ এত চমৎকার করে উপস্থাপন করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না।
আপনি জানেন না, এই উপন্যাসটা আমার সবচেয়ে প্রিয়। কারন, এই উপন্যাসের মাঝে আমি আমার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাই।
ভূমিকা…
আমার এক বন্ধুর জীবন থেকে নেওয়া এই গল্পটি। দেশের বাইরে পড়তে আসা একটি ছেলে যেসব অবহেলার অভিঙ্গতা লাভ করে তার মাঝে দু-একটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। প্রিয় বন্ধু, একটা গানের কয়েকটি লাইন কেবল বলতে চাই তোকে,
“যদি সবাই ফিরে যায়, ওরে ও অভাগা সবাই ফিরে যায়। ফিরবে না যে জানবি সে তোর, ফিরবে না যে জানবি সে তোর -ভাবনার মোরকে আছে ডুবে।ছিঁড়বে মোরক ফিরবে সে তার আপনও কুলায়……”।
নিজের রুমের চেয়ারে বসে লিমন বিড়বিড় করে বলছে,
Sharing is caring…….
তবে কেন আমার কাছের মানুষগুলো এত উদাসীন ???
গত দুইদিন ধরে লিমনের সাথে তার মা-বাবার কথা হয় না। যখন তার মা-বাবার তাঁর কথা খুব মনে পড়ে, তখন লিমনকে একদিন পর পর ফোন দেয়।
আর এভাবে কিছু দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আবার সেই আগের অবস্থা। ২-৩দিন এ একবার খবর নেওয়া।
প্রতিদিন সন্ধ্যের পর থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত লিমন আনমনে ভাবে, এই বুঝি তার মা-বাবা ফোন দিল। তার কোন কাছের মানুষ তার খবর নিল।
মাঝে মাঝে সে প্রশ্ন করে, আচ্ছা-আমাকে কেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠাল ???
মেনে নিলাম আমার সুন্দর একটি ভবিষ্যতের জন্য। তাই বলে কি, আমি কেমন আছি, কি করছি এসব খবর নেওয়ার ইচ্ছেও করে না আমার কাছের মানুষগুলোর ???
লিমন আসলে এসব প্রশ্ন গুলো নিজেকেই করছিলো।
রাতের খাবার ক্যান্টিনে সেরে লিমন নিজের রুমের দিকে ফিরছিল। হঠাৎ তার মোবাইলে ফোন আসে।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে, রানা ফোন করেছে।
হ্যালো, লিমন ? কি করছো ?
কিছু না। খেয়ে ফিরছি।
সময় থাকলে চল না ভিসি’র বাড়ির সামনে বসার জায়গাটায় গিয়ে একটু বসি। গল্প করি।
ঠিক আছে। আমি আসছি….
লিমন রানার কাছে গিয়েই প্রশ্ন করে, মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচেয়ে বড় কষ্ট কি বলতে পার ???
রানা বেশ হকচকিয়ে যায়।চোখের চশমাটা একটু ওপরে তুলে হাসিমুখ করে বলে, বুঝলাম না।
লিমন রানার পাশে বসতে বসতে বলে, তোমাকে আর বুঝতে হবে না।
তুমি কি জান, সুমি তোমায় ছেড়ে চলে গেল কেন ???
রানা বলে, জানি। আমার মত খারাপ মানুষকে সে কেন ভালবাসবে ? কেন আমার সাথে থাকবে ???
না, তুমি ভুল বলেছ। আমরা অতি চমৎকার করে ভালবাসতে পারি যা অনেকেই পারে না। আর মানুষ সেটা বুঝে না। তাই ভুল বুঝে, অভিমান করে চলে যায় দূরে…
রানা কিছু বলে না, কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর লিমন গান ধরে,
দেখেছি, দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।
তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলে আর মেলে না
দেখেছি, দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।
গান শেষ হলে ক্ষীণ কন্ঠে রানা জিঞ্জেস করে, তোমার কি মন খারাপ ?
লিমন কিছু বলে না। চুপচাপ নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাদের সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তার দিকে। যাকে আলোকিত করে রেখেছে ছোট ছোট সোডিয়াম বাতি।
হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে লিমন পায়েচারি করতে শুরু করে।
সাবলীল কন্ঠে বলে, মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচেয়ে বড় কষ্ট হল, যা বলতে প্রাণ কাঁদে তা কখনও বলা হয় না। আর মানুষ কেবলই সেই কথাটা বলার কাঙ্খিত সময়ের অপেক্ষায় থাকে…
জান রানা, আমার পরিবারের সবাই আমার উপর বেশ বিরক্ত। সেদিন বড় আপুর সাথে কথা হল। কি বলল শুনবা ?
রানা বলে, নিশ্চই তোমায় তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বলেছে।
না, সেটা বলে নি। বলেছে, ‘তোকে তো কেউ কিছু বলে না, যা বলে সব আমাকে। তোর জন্য সবাইকে ম্যানেজ করতে হয়। তোকে যেন কেউ কিছু না বলে তাই আমি
সামনে গিয়ে দাঁড়াই। যে করেই হোক সিজিপিএ টা একটু ভালো কর। আর কথা শুনতে ভাল লাগে না’।
বড় মামাও আমার সিজিপিএ নিয়ে আমার উপর বিরক্ত। আমি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি এটা তার পছন্দ নয়।
আমার বড় চাচা সেদিন আমায় ফোন করে বলেছে, তোর পেছনে অযথা টাকা নষ্ট হচ্ছে। পড়তে না পারলে চলে আয়।
বড় ভাইয়া আর ভাবীর সাথে আমার শেষ কবে কথা হয়েছে আমি নিজেও বলতে পারবে না।
মা’র হাতে টাকা থাকে না বলে, মা’ও নিয়মিত খবর নিতে পারে না। তবে তারাও যে আমার উপর বিরক্ত তা বোঝা যায়।
হাতে গোণা ২-৪ জন যেই বন্ধু আছে, তাদেরকে আমারই ফোন দিয়ে আমার অস্তিত্বের কথা মনে করিয়ে দিতে হয়। অথচ এই সব মানুষগুলোকে আমি প্রতিদিন কত মমতা নিয়ে ভাবি !!!!!
একটা মেয়েকে ভালবেসেছিলাম। হঠাৎ তারও বিয়ে হয়ে গেল। আমায় একা করে চলে গেল, কিন্তু যাওয়ার আগে একবার বলেও গেল না।
রানা কিছু বলে না। কেবলই গম্ভীর হয়ে মাটির নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
অনেকক্ষণ পরে বলে, তুমি এভাবে ভাবছ কেন ? সবাই তোমায় নিয়ে ভাবে, তোমায় ভালবাসে, শুধু যোগাযোগ করতে পারে না। হয়ত ব্যস্ত থাকে বিভিন্ন কারনে।
লিমন বলে, মিথ্যে আশ্বাস দিও না। ভালবাসা এবং কৃতঙ্গতাবোধ- এগুলো প্রকাশ করতে হয়।
আমার খালারা আমায় নিয়ে কানাঘষা করে, আমি নাকি একটি মেয়ের সাথে নিয়মিত কথা বলি আর টাকা উড়াই। বিদেশে এসেও নাকি আমার ফোনে কথা বলার ভুতটা যায় নি। আর সে জন্যই নাকি আমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছি।
অথচ কি জান, আমার মোবাইলে তেমন একটা ফোন আসে না। আমি ভার্সিটির বাইরে হাতেগোণা মাত্র কয়েকজনের সাথে কথা বলি।
আসলে আমি এমন একজন মানুষ, যার প্রতিটি কাজই হল ভুল। সে যাই করে, যাই বলে সবই অন্যের চোখে ভুল। যাকে বলে, ভুলে ভরা মানুষ…..
হঠাৎ রানা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, চল-এবার হলের দিকে পা বাড়াই। পরিবেশটা কেমন যেন অসহ্য মনে হচ্ছে।
প্রতিদিন রাতে বিছানায় গিয়ে লিমন ভাবে, ভুলে ভর্তি আমার জীবন। আচ্ছা কি করলে সবার চোখে আমার এই ভুল গুলো শুধরানো যায় ? কি করলে, আমি আমার কাছের মানুষগুলোর কাছে প্রিয় হতে পারব ?
অনেক ভাবে। ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে যায়।
গত ৭ দিন আগে লিমনের ছোট খালার বিয়ে হল। খুবই মজা হয়েছে সেখানে। সবাই এসেছিল, কেবল লিমনই যেতে পারে নি। কেউ লিমনকে জানায় নি, ওদিকে কি হচ্ছে। গায়ে হলুদ হয়েছে এটাও লিমন জানে না। বিয়ের অনুষ্টান শেষেও কেউ একটা ফোন করে লিমনকে কিছু জানায় নি। এমনকি লিমনের মা-বাবাও না। আর
লিমনের ভাই ? সে তো অনেক ব্যস্ত। কত দায়িত্ব তার মাথায় !!!
আমাদের এই পৃথিবীতে এক শ্রেণীর মানুষ আছে, যারা তার পরিবার, কাছের মানুষদের নিয়ে খুব বেশি কনসার্ন থাকে। লিমন সে ধরনের মানুষ।
অন্ধকারের একটা সুবিধা হল, এর মাঝে ক্ষীণ আলোর উপস্তিতিও সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়, যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। লিমন তেমনি আলো খোঁজার চেষ্টা করছে…
বিস্মৃতির অতল গভীরে ক্রমেই হারিয়ে যাওয়া লিমন ভাবে, সব ছেড়ে দিব, সব। আমার সব কাছের মানুষগুলোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবো। একলা চলার নীতি অনুসরণ করবো।
নিজের রুমে চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে লিমন এসব কথা ভাবছে।
হঠাৎ তার মন বলে ওঠে,
তুমি এমনটা করো না। তুমিও যদি অভিমানের বশবতী হয়ে অন্যান্য মানুষের মত আচরণ কর তবে
অতি সস্তা চিন্তার মানুষ আর তোমার মাঝে কি পার্থক্য থাকবে বল ??? তোমায় যে হতে হবে,
বসুন্ধরার মত সর্বংসহা; নদীর মত বেগবান, আকাশের মত উদার, বৃক্ষের মত পরপোকারী।
আড়মোরা ভেঙে লিমন পেছনে তাকায়।
দেখে, পেছনে কেউ নেই। কেবল ঘরের জানালা দিয়ে স্নিগ্ধ মৃদু বাতাস ঘরে প্রবেশ করছে।
সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। শীতল স্নিগ্ধ বাতাস তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
অনাবিল প্রশান্তিতে লিমনের শরীর ভরে উঠছে।
হালকা ভাবে চোখ বন্ধ করে লিমন, সাবলীল কন্ঠে বলে,
আমি এক অনন্য মানুষ। আমার স্বকীয়তা আমায় বজায় রাখতেই হবে। কারন, স্বকীয়তা বিসর্জন দেওয়ার অর্থ হল নিজেকে হারিয়ে ফেলা। সকল সমালোচনা গ্রহণ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করবো আমি আর এগিয়ে যাব।
হ্যাঁ, আমি এগিয়ে যাব দীপ্ত পায়ে………
জনপ্রিয় লেখিকা, সুচিত্রা ভট্টাচার্য
“কাছের মানুষ” উপন্যাসে আপনি মানুষের জীবনের একাকীত্বের সার্থক চিত্র যেভাবে তুলে ধরেছেন, সেভাবে অন্য কেউ এত চমৎকার করে উপস্থাপন করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না।
আপনি জানেন না, এই উপন্যাসটা আমার সবচেয়ে প্রিয়। কারন, এই উপন্যাসের মাঝে আমি আমার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাই।
ভূমিকা…
আমার এক বন্ধুর জীবন থেকে নেওয়া এই গল্পটি। দেশের বাইরে পড়তে আসা একটি ছেলে যেসব অবহেলার অভিঙ্গতা লাভ করে তার মাঝে দু-একটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। প্রিয় বন্ধু, একটা গানের কয়েকটি লাইন কেবল বলতে চাই তোকে,
“যদি সবাই ফিরে যায়, ওরে ও অভাগা সবাই ফিরে যায়। ফিরবে না যে জানবি সে তোর, ফিরবে না যে জানবি সে তোর -ভাবনার মোরকে আছে ডুবে।ছিঁড়বে মোরক ফিরবে সে তার আপনও কুলায়……”।
নিজের রুমের চেয়ারে বসে লিমন বিড়বিড় করে বলছে,
Sharing is caring…….
তবে কেন আমার কাছের মানুষগুলো এত উদাসীন ???
গত দুইদিন ধরে লিমনের সাথে তার মা-বাবার কথা হয় না। যখন তার মা-বাবার তাঁর কথা খুব মনে পড়ে, তখন লিমনকে একদিন পর পর ফোন দেয়।
আর এভাবে কিছু দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আবার সেই আগের অবস্থা। ২-৩দিন এ একবার খবর নেওয়া।
প্রতিদিন সন্ধ্যের পর থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত লিমন আনমনে ভাবে, এই বুঝি তার মা-বাবা ফোন দিল। তার কোন কাছের মানুষ তার খবর নিল।
মাঝে মাঝে সে প্রশ্ন করে, আচ্ছা-আমাকে কেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠাল ???
মেনে নিলাম আমার সুন্দর একটি ভবিষ্যতের জন্য। তাই বলে কি, আমি কেমন আছি, কি করছি এসব খবর নেওয়ার ইচ্ছেও করে না আমার কাছের মানুষগুলোর ???
লিমন আসলে এসব প্রশ্ন গুলো নিজেকেই করছিলো।
রাতের খাবার ক্যান্টিনে সেরে লিমন নিজের রুমের দিকে ফিরছিল। হঠাৎ তার মোবাইলে ফোন আসে।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে, রানা ফোন করেছে।
হ্যালো, লিমন ? কি করছো ?
কিছু না। খেয়ে ফিরছি।
সময় থাকলে চল না ভিসি’র বাড়ির সামনে বসার জায়গাটায় গিয়ে একটু বসি। গল্প করি।
ঠিক আছে। আমি আসছি….
লিমন রানার কাছে গিয়েই প্রশ্ন করে, মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচেয়ে বড় কষ্ট কি বলতে পার ???
রানা বেশ হকচকিয়ে যায়।চোখের চশমাটা একটু ওপরে তুলে হাসিমুখ করে বলে, বুঝলাম না।
লিমন রানার পাশে বসতে বসতে বলে, তোমাকে আর বুঝতে হবে না।
তুমি কি জান, সুমি তোমায় ছেড়ে চলে গেল কেন ???
রানা বলে, জানি। আমার মত খারাপ মানুষকে সে কেন ভালবাসবে ? কেন আমার সাথে থাকবে ???
না, তুমি ভুল বলেছ। আমরা অতি চমৎকার করে ভালবাসতে পারি যা অনেকেই পারে না। আর মানুষ সেটা বুঝে না। তাই ভুল বুঝে, অভিমান করে চলে যায় দূরে…
রানা কিছু বলে না, কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর লিমন গান ধরে,
দেখেছি, দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।
তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলে আর মেলে না
দেখেছি, দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা।
গান শেষ হলে ক্ষীণ কন্ঠে রানা জিঞ্জেস করে, তোমার কি মন খারাপ ?
লিমন কিছু বলে না। চুপচাপ নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাদের সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তার দিকে। যাকে আলোকিত করে রেখেছে ছোট ছোট সোডিয়াম বাতি।
হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে লিমন পায়েচারি করতে শুরু করে।
সাবলীল কন্ঠে বলে, মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচেয়ে বড় কষ্ট হল, যা বলতে প্রাণ কাঁদে তা কখনও বলা হয় না। আর মানুষ কেবলই সেই কথাটা বলার কাঙ্খিত সময়ের অপেক্ষায় থাকে…
জান রানা, আমার পরিবারের সবাই আমার উপর বেশ বিরক্ত। সেদিন বড় আপুর সাথে কথা হল। কি বলল শুনবা ?
রানা বলে, নিশ্চই তোমায় তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বলেছে।
না, সেটা বলে নি। বলেছে, ‘তোকে তো কেউ কিছু বলে না, যা বলে সব আমাকে। তোর জন্য সবাইকে ম্যানেজ করতে হয়। তোকে যেন কেউ কিছু না বলে তাই আমি
সামনে গিয়ে দাঁড়াই। যে করেই হোক সিজিপিএ টা একটু ভালো কর। আর কথা শুনতে ভাল লাগে না’।
বড় মামাও আমার সিজিপিএ নিয়ে আমার উপর বিরক্ত। আমি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি এটা তার পছন্দ নয়।
আমার বড় চাচা সেদিন আমায় ফোন করে বলেছে, তোর পেছনে অযথা টাকা নষ্ট হচ্ছে। পড়তে না পারলে চলে আয়।
বড় ভাইয়া আর ভাবীর সাথে আমার শেষ কবে কথা হয়েছে আমি নিজেও বলতে পারবে না।
মা’র হাতে টাকা থাকে না বলে, মা’ও নিয়মিত খবর নিতে পারে না। তবে তারাও যে আমার উপর বিরক্ত তা বোঝা যায়।
হাতে গোণা ২-৪ জন যেই বন্ধু আছে, তাদেরকে আমারই ফোন দিয়ে আমার অস্তিত্বের কথা মনে করিয়ে দিতে হয়। অথচ এই সব মানুষগুলোকে আমি প্রতিদিন কত মমতা নিয়ে ভাবি !!!!!
একটা মেয়েকে ভালবেসেছিলাম। হঠাৎ তারও বিয়ে হয়ে গেল। আমায় একা করে চলে গেল, কিন্তু যাওয়ার আগে একবার বলেও গেল না।
রানা কিছু বলে না। কেবলই গম্ভীর হয়ে মাটির নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
অনেকক্ষণ পরে বলে, তুমি এভাবে ভাবছ কেন ? সবাই তোমায় নিয়ে ভাবে, তোমায় ভালবাসে, শুধু যোগাযোগ করতে পারে না। হয়ত ব্যস্ত থাকে বিভিন্ন কারনে।
লিমন বলে, মিথ্যে আশ্বাস দিও না। ভালবাসা এবং কৃতঙ্গতাবোধ- এগুলো প্রকাশ করতে হয়।
আমার খালারা আমায় নিয়ে কানাঘষা করে, আমি নাকি একটি মেয়ের সাথে নিয়মিত কথা বলি আর টাকা উড়াই। বিদেশে এসেও নাকি আমার ফোনে কথা বলার ভুতটা যায় নি। আর সে জন্যই নাকি আমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছি।
অথচ কি জান, আমার মোবাইলে তেমন একটা ফোন আসে না। আমি ভার্সিটির বাইরে হাতেগোণা মাত্র কয়েকজনের সাথে কথা বলি।
আসলে আমি এমন একজন মানুষ, যার প্রতিটি কাজই হল ভুল। সে যাই করে, যাই বলে সবই অন্যের চোখে ভুল। যাকে বলে, ভুলে ভরা মানুষ…..
হঠাৎ রানা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, চল-এবার হলের দিকে পা বাড়াই। পরিবেশটা কেমন যেন অসহ্য মনে হচ্ছে।
প্রতিদিন রাতে বিছানায় গিয়ে লিমন ভাবে, ভুলে ভর্তি আমার জীবন। আচ্ছা কি করলে সবার চোখে আমার এই ভুল গুলো শুধরানো যায় ? কি করলে, আমি আমার কাছের মানুষগুলোর কাছে প্রিয় হতে পারব ?
অনেক ভাবে। ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে যায়।
গত ৭ দিন আগে লিমনের ছোট খালার বিয়ে হল। খুবই মজা হয়েছে সেখানে। সবাই এসেছিল, কেবল লিমনই যেতে পারে নি। কেউ লিমনকে জানায় নি, ওদিকে কি হচ্ছে। গায়ে হলুদ হয়েছে এটাও লিমন জানে না। বিয়ের অনুষ্টান শেষেও কেউ একটা ফোন করে লিমনকে কিছু জানায় নি। এমনকি লিমনের মা-বাবাও না। আর
লিমনের ভাই ? সে তো অনেক ব্যস্ত। কত দায়িত্ব তার মাথায় !!!
আমাদের এই পৃথিবীতে এক শ্রেণীর মানুষ আছে, যারা তার পরিবার, কাছের মানুষদের নিয়ে খুব বেশি কনসার্ন থাকে। লিমন সে ধরনের মানুষ।
অন্ধকারের একটা সুবিধা হল, এর মাঝে ক্ষীণ আলোর উপস্তিতিও সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়, যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। লিমন তেমনি আলো খোঁজার চেষ্টা করছে…
বিস্মৃতির অতল গভীরে ক্রমেই হারিয়ে যাওয়া লিমন ভাবে, সব ছেড়ে দিব, সব। আমার সব কাছের মানুষগুলোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবো। একলা চলার নীতি অনুসরণ করবো।
নিজের রুমে চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে লিমন এসব কথা ভাবছে।
হঠাৎ তার মন বলে ওঠে,
তুমি এমনটা করো না। তুমিও যদি অভিমানের বশবতী হয়ে অন্যান্য মানুষের মত আচরণ কর তবে
অতি সস্তা চিন্তার মানুষ আর তোমার মাঝে কি পার্থক্য থাকবে বল ??? তোমায় যে হতে হবে,
বসুন্ধরার মত সর্বংসহা; নদীর মত বেগবান, আকাশের মত উদার, বৃক্ষের মত পরপোকারী।
আড়মোরা ভেঙে লিমন পেছনে তাকায়।
দেখে, পেছনে কেউ নেই। কেবল ঘরের জানালা দিয়ে স্নিগ্ধ মৃদু বাতাস ঘরে প্রবেশ করছে।
সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। শীতল স্নিগ্ধ বাতাস তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
অনাবিল প্রশান্তিতে লিমনের শরীর ভরে উঠছে।
হালকা ভাবে চোখ বন্ধ করে লিমন, সাবলীল কন্ঠে বলে,
আমি এক অনন্য মানুষ। আমার স্বকীয়তা আমায় বজায় রাখতেই হবে। কারন, স্বকীয়তা বিসর্জন দেওয়ার অর্থ হল নিজেকে হারিয়ে ফেলা। সকল সমালোচনা গ্রহণ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করবো আমি আর এগিয়ে যাব।
হ্যাঁ, আমি এগিয়ে যাব দীপ্ত পায়ে………
Monday, March 7, 2011
একটু আলোর খোঁজে (গল্প)
উৎসর্গ...
যাদের কথা এবং কাজ দুটোতেই আমি মুগ্ধ !
প্রিয়, তারিক আলমগীর ভাই ও তারিকুর রহমান শামীম ভাই
এবং
প্রিয় তারিক রিদওয়ান, প্রিয় বন্ধুবরেষু
আমি আশা করব, আপনি সুযোগ পেলেই আপনার নির্ভরতার হাতখানা
আমার ঘাড়ে রাখবেন- বিশ্বাসী বন্ধুর মতন..........।
ভূমিকা.....
আপনাকে আমি চিনি না, কোন দিন দেখিও নি। তবুও আপনাকে না জানিয়েই আপনার জীবনের কিছু অংশ নিয়ে একটা কিছু লিখার স্পর্ধা দেখালাম। আমায় ক্ষমা করবেন। যোজন যোজন কষ্ট নিয়েও মানুষকে কিভাবে হাসতে হয় তা আপনি জানেন।কিন্তু আপনি এটা জানেন না, এভাবে হাসতে পারাটা একটা গুণ ! কোন দিন আপনার সাথে দেখা হবে কি না জানি না। তবুও দূর থেকে দোয়া করি, আপনি ভালো থাকেন, স্রস্টা যেন আপনাকে সুখের সন্ধান পাইয়ে দেন।
১।
দু’ঠোঁট বাঁকা করে শীষ বাজাচ্ছে হিয়া । শীষ বাজাচ্ছে আর কিছুক্ষণ পর পর পাশের বান্ধবী গুলোকে কি যেন বলছে।
হিয়া যে শিল্পীকে উদ্দেশ্য করে শীষ বাজাচ্ছে তা সে জানে। হিয়া ক্রমাগত শীষ বাজিয়েই যাচ্ছে।
খানিকক্ষণ পর হিয়া তার বান্ধবীদের নিয়ে শিল্পীর পাশে এসে বসল।
কি রে শিল্পী, মন খারাপ ? এমন করে বসে আছিস কেন ??
সাথে সাথেই শিল্পীর বুকটা ধ্ক করে ওঠে। শিল্পী বলে, এমনি।
স্বামী বুঝি ফোন করে নি, তাই না ???
না, না সে কারনে নয়। এমনি মন খারাপ।
হিয়া বলে, ইদানিং তো তোকে মোবাইলে কথা বলতেই দেখি না। জামাইবাবু কি ছেড়ে দিল নাকি তোকে ? নাকি আবার অন্য কোন মেয়ের পাল্লায় পড়েছে ???
কথাটা বলেই হিয়া আর তার বান্ধবীরা হাসতে থাকে।
শিল্পী কিছু বলে না। কেবল অপরাধীর মত চুপ করে থাকে। এদের মত আরো অনেক মানুষ আছে যারা তার ক্ষতস্থানে লবণ দিয়ে তার কষ্ট বাড়াতে ভালোবাসে।
একসময় হাসি থামিয়ে হিয়া বলে: দেখ তোর স্বামী নিশ্চিত অন্য কোন মেয়ের হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
স্বরটাকে দুঃখী দুঃখী করে বলে, তোর জন্য আমার খুব দুঃখ হয়রে শিল্পী।
কথাটা শুনেই শিল্পীর পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। সে বুঝতে পারে, হিয়া সমবেদনায় ব্যাথিত হয়ে কথাটা বলে নি. বরং করুনা করে কথাটা বলেছে।
আর করুণা শিল্পীর একদম পছন্দ না।
কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটিতে শিল্পী পড়ছে। অন্তত এতটুকু বোঝার তার ক্ষমতা হয়েছে যে, কোন মানুষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কোন কথা বলে। কোনটা করুনা, কোনটা সমবেদনায় ব্যথিত হওয়ার ভাষা।
২।
রাত হলেই বাবা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে কি যেন খোঁজেন !
একটু দূর থেকে দেখলে মনে হবে, বাবা যেন মূর্তির মত তাকিয়ে আছেন।
মাঝে মাঝে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বাবা হো হো করে হেসে ওঠেন।
এভাবে একা একা হাসেন, আবার হঠাৎ করেই হাসি থেমে যায়।
আমি বাবার কাছে গিয়ে বসি। কৌতুহলী হয়ে বলি, বাবা প্রতিদিন আপনি কি খোঁজেন ???
অসীম আগ্রহ নিয়ে বাবার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করি।
বাবা বলে, ও শিল্পী.........। স্রস্টাকে খুঁজিরে মা। তিনাকে যে আমার অনেক প্রশ্ন জিঞ্জেস করার আছে।
সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্যই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি।
মা রান্নাঘর থেকে এসে বলেন, শিল্পীর বাবা, প্রতি রাতে কি আপনার এই পাগলামি গুলো না করলে ভালো লাগে না ?
বাবা বলে, পাগলামি না শিল্পীর মা, বল অন্বেষণ। আমার সাথে তুমিও বোস। আকাশের দিকে তকাও। অন্ধকারেরও একটা সৌন্দর্য আছে।
তোমার আমার প্রত্যেকেরই জীবনে কিছু কিছু অন্ধকার মুহূর্ত আছে।
সাথে সাথে শিল্পীর মা বলে, কি সব আবোল-তাবোল বলেন !!!
এর ফাঁকে আমি আস্তে করে আমার রুমের দিকে পা বাড়াই। রুমে ঢুকতেই কি যেন মনে করে আমি আবার মা-বাবার দিকে ফিরে চাই ।
দেখি বাবা মায়ের হাতটা ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।
আমি জানি, তারা আমার জন্যই কাঁদেন। অতি অল্প বয়সে ডিভোর্স পাওয়া মেয়ের অসহায়ত্বে কাঁদেন। আশেপাশের মানুষ যে আমায় নিয়ে নানান কথা বলে, আমায় নিয়ে বাজে মন্তব্য করে সেগুলোর জন্য কাঁদেন।
তাদের কষ্ট দেখে আমার চোখও ঝাপসা হয়ে ওঠে।
মুখ ফিরিয়ে আমি রুমে গিয়ে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে পড়ি। আর চোখের কোণা দিয়ে নীরবে গরম জল গড়িয়ে পড়ে।
কোথা থেকে যেন একটুকরো বিষন্নতা এসে ঠাঁই নিল শিল্পীর মনে, আর সেটি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল তার সমস্ত অস্তিত্ব আর একাকীত্বে।
৩।
কখন যে ঘুম ভেঙে গেছে টেরই পাই নি। টপ টপ করে পানি পড়ার শব্দ কানে আসছে।
তাহলে কি আপু ট্যাপটি খোলা রেখেছে ? আপুর কথা মাথায় আসতেই রাজ্যের চিন্তা এসে মাথায় ভর করল।
আচ্ছা কি করছে আপু ? ঘুমোচ্ছে না কি জেগে আছে ? ধক করে উঠল বুকের ভিতর।
কি করব ? আপুর ঘরে গিয়ে কি একবার দেখে আসব ? না, থাক ।
মাথার ভিতর একপ্রকার শূন্যতার ছড়াছড়ি। মনেহচ্ছে, সময় যেন থমকে গেছে। কোন উৎকন্ঠা নেই। সব কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। চারদিকে নির্লিপ্ততার আবেশ। হঠাৎ বিছানা থেকে উঠতে গিয়েও পারলাম না। স্থির হয়েই রইলাম।
হঠাৎ ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখলাম, শিল্পী আপু দেয়ালের পাশে দাড়িয়ে আছে। একটু পরে দেয়ালে মাথা ঠেকাল। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বলছে, আমার কোন কষ্ট নেই, কোন কষ্ট নেই। আপু কাঁদছে আর কথাটা বলছে।
নিজেকে যেন নিজেই সান্তনা দিচ্ছে। আর কষ্টগুলো গড়িয়ে পড়ছে চোখের লোনা জল হয়ে। দুই বছর প্রেম করার পর বাবা-মায়ের অসম্মতি সত্ত্বেও বিয়ে করা, আবার বিয়ের ৬ মাসের মাথায় ডিভোর্স হয়ে যাওয়া আর মৌন দুঃখে তার মন ভরে গেছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন তার মনের ভিতর।
কাঁদুক আরো বেশি করে কাঁদুক আপু। মনের ভিতর জমে থাকা কষ্ট আর দীর্ঘশ্বাস গুলো যদি তাতে একটু হলেও কমে। তাহলেও যদি একটু হালকা হতে পারে ...........।
আধঘন্টা পরে আমি আপুর রুমে গিয়ে দেখি. সে হাটুতে থুতলি লাগিয়ে বসে আছে। এভাবে আপুকে দেখে আমার খুব মায়া লাগে। আমি কাছে গিয়ে তার পিঠে হাত রাখি।
ঘন-কালো অন্ধকার, তবুও দূরে কোথাও একটু আলো দেখা যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর আস্তে করে আপুকে বলি, আপু.....! সরলতা মানুষকে ছোট করে, কষ্ট দেয় প্রতি মুহূর্তে। জগতে এ সরল মানুষেরাই বাস্তবকে পাশ কাটিয়ে আবেগে ভেসে বেড়ায়। এরা না পায় সুখ, না পায় মর্যাদা।
সাথে সাথেই ফোঁত করে কেঁদে ওঠে আপু। জ্যোৎস্নার ম্লান আলোয় তার চোখদুটো চিক চিক করতে থাকে। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আপু আমার দিকে তাকায়।
আমার কি করা উচিত রে নিতু ? আপুর এই প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাই না। খুব চেষ্টা করি তবুও কিছু মাথায় আসে না। সান্তনা দেওয়ার মত কিছু খুঁজে পাই না। স্থবির মনে হয় সবকিছু- মাথার উপর বিশাল আকাশ এমনকি সময়টাকেও......।
৪।
সেই সন্ধ্যা থেকে একনাগারে পড়ছে শিল্পী। বাইরে কি হচ্ছে কোন খবর নেই। যেন বাইরের উথাল-পাথাল সমুদ্রের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। নির্লিপ্ত হয়ে কেবলমাত্র নিজের জগত নিয়েই ব্যস্ত।
পড়তে পড়তে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে দেখে লিপু তার বিছানায় এসে চুপ করে বসে আছে।
কখন আসলা লিপু ? আমিতো বুঝতেই পারি নি।
বই বন্ধ করে শিল্পী লিপুর পাশে এসে বসে।
লিপু শিল্পীর বেশ ভক্ত। কিছু কিছু মানুষ থাকে যারা অপর কোন মানুষকে অকারনেই অসম্ভব ভালবাসে। লিপুও ঠিক তেমন।
শিল্পী বলে, কি রে মন খারাপ ?
লিপু বলে, হুঁ। কেন রে ?
মা খুব অসুস্থ......। কথাটা বলেই লিপু কাঁদতে কাঁদতে শিল্পীর বুকে শিশুদের মত আচড়ে পড়ে। সাথে সাথেই শিল্পী লিপুকে জড়িয়ে ধরে।
পরম মমতা নিয়ে লিপুর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, কাদিঁস না লিপু। দেখবি অতি অল্প দিনেই মা সুস্থ হয়ে উঠবে। এভাবে বাচ্চা মেয়েদের মত কেউ কাঁদে !!!!!!!!!
তোকে আজ আর তোর রুমে যেতে হবে না, আমার সাথে ঘুমাবি।
কই শুয়ে পড়। আমি তোর কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, তুই ঘুমা।
নিজের যোজন যোজন কষ্ট থাকার পরও অন্য কোন মানুষের কষ্ট দেখলেই তাকে স্থান দেয় হৃদয়ের একেবারে গভীরে.........। হয়ে যায় তারও কাছের মানুষ..........।
৫।
রিক্সায় করে কাজলা থেকে হলের দিকে ফিরছিল শিল্পী।
আশেপাশের দাড়িয়ে থাকা মানুষগুলো ফিসফিস করছে আর বলছে, দেখ ঐ যে শিল্পী, আরে সেই মেয়েটা যে স্বামীর সাথে ৬ মাস সঙসার করার পর ডিভোর্স হয়ে যায়। নিশ্চই মেয়েটার খারাপ কিছু ছিল তাই স্বামী ছেড়ে দিয়েছে।
শিল্পী কিছু বলে না, কেবলই মাথা নিচু করে রিক্সায় বসে থাকে। মাঝে মাঝে ভাবে, আচ্ছা এই পৃথিবীতে কি আমিই একমাত্র ডিভোর্স পাওয়া মেয়ে, আর নেই ??? ডিভোর্স পাওয়াটা কি আমার পাপ, নাকি জীবনের মস্তবড় ভুল যার জন্য প্রায় প্রতিটি মানুষ আমায় খোঁচা দিয়ে কথা বলে ??????
কেউ শিল্পীর এসব প্রশ্নের উত্তর দেয় না।
মাথা নিচু করেই আছে শিল্পী। হঠাৎ এক নারীকণ্ঠ শিল্পী নামে চিৎকার করছে।
রিক্সার পিছনের ফাঁকা অংশ দিয়ে ফিরে তাকাতেই দেখে, তার কলেজ জীবনের বান্ধবী হীরা তাকে ডাকছে।
সাথে সাথেই রিক্সা থামিয়ে সে রিক্সা থেকে নামে।
হীরা কাছে এসেই শিল্পীকে জড়িয়ে ধরে বলে, কতদিন পর দেখা !!!!!!!!!!
বলেই হীরার চোখে আনন্দে জ্বল এসে যায়।
শিল্পী বলে, চল রুমে যাই।
রুমে গিয়েই বিছানায় দুই পা উঠিয়ে হীরা বসে পড়ে। শিল্পী বলে, কি খাবি ?
কিছু না। বোস, দু’জনে গল্প করি।
হীরা অনেকক্ষণ ধরে শিল্পীর দিকে তাকিয়ে আছে। শিল্পী বলে, ওভাবে কি দেখছিস ?
হীরা বলে, তোকে। তোর মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। নিজের যত্ন নেওয়া কি ছেড়ে দিয়েছিস নাকি ??
খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে শিল্পী বলে, না ছেড়ে দিই নি।
হীরা শিল্পীর গালে আলতো করে হাত রেখে বলে, কি হয়েছে রে তোর ?
আমার না ডিভোর্স হয়ে গেছে ........।
কথাটা শুনেই হীরার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়। কি বলিস এসব ??? বিস্ময়ের ভঙ্গিতে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আাছে হীরা। যেন সবকিছু থেমে গিয়েছে। অস্ত যাওয়া সূর্য, মাথার উপর বিশাল আকাশ, সময় কিংবা স্বপ্নবাজ মানুষের স্বপুনাও কিছুক্ষনের জন্য থমকে গেছে।
শিল্পী বলে,
তুই তো জানিস আমি অভিককে ভালোবাসতাম। বিশ্বাস কর, খুব মমতা নিয়ে ভালোবেসেছিলাম। এমন অনেক দিন গিয়েছে, আমরা সারাদিন বাইরে বেড়িয়েছি। আমার অন্য অনেক বান্ধবী বলত, এসব নাকি একদম ঠিক না। আমি বলতাম, কি জানি !
দুজন দুজনকে সারাদিনের সব কথাই বলতাম। আমার পরীক্ষার কথা ও আমায় মনে করিয়ে দিত; আর আমি ওকে ওর পরীক্ষার কথা মনে করিয়ে দিতাম। আমাদের মাঝে ঝগড়া হতো না, তবুও আমরা ঝগড়া করতাম- সামাজিক অসংগতি, বৈষম্য, অধিকার বিভিন্ন বিষয়ে। পরিশেষে আমরা দু’জনেই একই সিদ্ধান্তে উপনীত হতাম যে, আমরা সবাই সমান। সুন্দর সমাজ আর বসবাসযোগ্য বসুন্ধরা গঠনের জন্য সবার ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ।
দু’জনে পাশাপাশি বসে স্বপ্ন আঁকতাম। বর্ণিল প্রজাপতি, সুনীল আকাশ, রঙিন মেঘ এসে আমাদের স্বপ্নে রং ছড়িয়ে যেত। এভাবে একসময় পারিবারিক অনেক মানুষের অমত কিন্তু আমার প্রবল ইচ্ছায় আমাদের বিয়ে হয়। ছয় মাস আমরা বেশ ভালোভাবেই সংসার করি। চারদিক ভালোবাসার মূর্ছনায় পরিপূর্ণ ছিল। হঠাৎ একদিন একটা ব্যাপার টের পেয়ে যাই আমি । স্রস্টা এই একটা জায়গায় নারীদের পক্ষ নিয়েছেন। নারীরা আগে থেকেই টের পেয়ে যায় কিছু বিষয়। একটু বয়স হলেই টের পায় পৃথিবীর মানুষগুলো তার দিকে কিভাবে তাকাচ্ছে। টের পেয়ে যায় তাকে কিভাবে চলতে বলা হচ্ছে। তেমনি আমিও টের পেয়ে যাই, অভিক অন্য একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। ঐ মেয়েটা তার মনে এতটাই জায়গা করে নিয়েছে যে, সেখানে আর আমার কোন স্থানই ছিল না।
আমি ওকে এই বিষয় নিয়ে প্রশআন করলেই সে এড়িয়ে যেত। একদিন সে সত্যি সত্যি ধরা পড়ে যায়। অবশেষে সে আমার কাছে মুক্তি চায়। আমি তাকে সাথে সাথেই মুক্তি দিয়ে দিই। আমাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। সেইদিন অভিক এর চোখে ছিল মুক্তির আনন্দ, আমার চোখে ছিল কষ্ট আর ভালোবাসার বেদনায় নীল হয়ে যাওয়ার আগুন।
জানিস আমি এখন বাইরে বের হতে পারি না, বাড়িতেও যেতে পারি না। বাড়িতে গেলেই পাড়া-প্রতিবেশিরা বিভিন্ন কথা বলে। আমায় কুলটা, অলক্ষনী বলে গালি দেয়। আবার বলে, আমার নাকি স্বামীর ঘর করার যোগ্যতা নেই বলেই নাকি আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। আর বাসায় আসলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। মা-বাবা প্রায় সারাক্ষণই কাঁদতে থাকেন। অল্প বয়সে ডিভোর্স পাওয়া মেয়ের অসহায়ত্বে কাঁদেন, সন্তানের কষ্ট লাঘব করতে না পারার কষ্টে কাদেঁন........। আর এখানে ..... ?
আগে এই বিষয়টা কেউ জানত না। অভিক এর কথা জিঞ্জেস করলেই বলতাম, ও ভালো আছে। এখন বিষয়টা সবাই জানে। তবুও আছে যারা আমায় খোটা দেওয়ার জন্য সর্বদা তৈরি থাকে। সুযোগ পেলেই দু’চারটা কথা শুনিয়ে দেয়। হীরা শিল্পীর হাত ধরে রেখেছে। তার হাত দুটি কাঁপছে। শিল্পী বলে, বিশ্বাস কর হীরা, অভিককে ভালবেসে কতবার যে সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করেছে আমার, ও জানে না !!! ও জানে না !!! আজও আমি ওকে আমার হৃদয়ের একেবারে গভীরে অতি যত্নে রেখেছি। ও জানবে না, জানবে না কখনো। জানিস, আমার জীবনে যতগুলো আনন্দ এসেছিল তার সবগুলি কেড়ে নিয়েছে ও একচিলতে......: আর তাইতো আজ আমার হৃদয়ে আজ বাধভাঙা কান্নার আওয়াজ.......
বলতে বলতে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হীরাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমার কী দোষ ছিল রে হীরা ?? বল না হীরা ? ভালোবাসাটাই কি দোষ ???
হীরা কিছু বলে না। শিল্পীকে জড়িয়ে ধরে থাকে কেবলই। সাথে সাথে হীরার চোখ দিয়েও অবিরাম জ্বল গড়িয়ে পড়ে। বাইরে থেকে একটি মানুষকে দেখতে যতই শক্ত মনে হোক না কেন, তার ভিতর কি চলছে তাকি সহজে বোঝা যায় ??? না, যায় না। যোজন যোজন কষ্ট নিয়েও তারা পথ চলে ........নীরবে.......নীভৃতিতে.....
৬।
প্রায় প্রতিরাতেই শিল্পী জানালা দিয়ে ঐ দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি যেন ভাবে। অসংলগ্ন সব ভাবনা।
মাঝে মাঝে ভাবে, এই বুঝি অভিক তার কাছে এলো। এসে বললো, শিল্পী আমায় ক্ষমা করে দাও।
প্রথমে তোমায় ভালবাসলাম, অবশেষে বিয়েও করলাম। কিন্তু কিছুদিন পর হঠাৎ অন্য একটি মেয়ের প্রেমে পড়লাম। তারপর তোমায় ডিভোর্স দিয়ে দিলাম। কিন্তু মনের মাঝে সারাক্ষণই একটা অপরাধবোধ কাজ করত যা আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। আমি খুব কষ্টে আছি শিল্পী। আমায় ক্ষমা করে দাও। নইলে আমি এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাব না।
শিল্পী বলে, তুমি আগে আমার কাছে বাঁধন থেকে মুক্তি চেয়েছিলে, আমি তখনও তোমায় মুক্তি দিয়েছি। আর এখন অপরাধবোধ থেকে মুক্তি চাইছ !!!!!
আমি তো তোমায় কবেই ক্ষমা করে দিয়েছি অভিক। কারন, নারীরা ভালোবেসে ক্ষমা করতে শিখেছে জন্ম থেকেই। প্রতিদিন ভাবি আমি তোমায় ভুলে যাব। কিন্তু পারি না। তোমার দেওয়া কষ্ট আমায় ভুলতে দেয় না ..... কেবলই আমায় তাড়িয়ে বেড়ায়, যেভাবে ঠিক দুঃস্বপ্ন মানুষকে তাড়িয়ে ব্ড়োয়.....।
খানিকক্ষন পরে পিছন ফিরে দেখি সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমায় একা করে, নিঃস করে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে নিঃচিন্তে। কেবলই আমি জেগে আছি, দাড়িয়ে আছি রিক্ত হস্তে, তাকিয়ে আছি অপার শূন্যতা আর এক-সাগর কষ্টের লোনাজ্বল নিয়ে।
আচ্ছা, প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা, প্রবঞ্চিতকে দেয় দাহ। তাহলে অনুতপ্তকে কি দেয় ??????
হঠাৎ তার মন বলে ওঠে, প্রেম অনুতপ্তকে দেয় হাহাকার। তীব্র হাহাকার, পাঁজর ভাঙার মত হাহাকার। ঠিক সেই হাহাকার আজ আমারই মনে..........
কোন কোন পূর্ণিমার রাতে ঘরের জানালা দিয়ে রূপালী আলো ঘরের মেঝেতে এসে পড়ে। আমি জ্যোৎস্নার রূপালী আলোয় আমার ছায়া স্পষ্ট দেখতে পাই। রাতের নিস্তব্ধতায় আমি কেঁপে উঠি। নীরবে জ্বল গড়িয়ে পড়ে আমার দু’চোখের কোণা দিয়ে আর আমি আকুল হৃদয়ে প্রার্থনা করি – আল্লাহ, তুমিতো জানো আমার কষ্টগুলোর কথা। তুমিতো সব পারো, সব.....। পৃথিবীর সকল কিছু তোমারই সৃষ্টি। তোমার কত ক্ষমতা !!!!! তবে আমার কেন এত কষ্ট বলতে পারো ? কি দোষ ছিল আমার ? কবে আমার জীবনে সুখের পায়ড়া আনন্দের বার্তা নিয়ে আসবে ?????
আমি অসীম আগ্রহ নিয়ে স্রস্টার উত্তরের অপেক্ষা করি। অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করা পথিকের মত আমি তাকিয়ে থাকি অনাগত ভবিষ্যতের দিকে। বসন্ত এসে এক-সময় চলে যায়, পূর্ণিমা ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যায়। তবুও আমি স্রস্টার উত্তরের অপেক্ষায় থাকি।
আমার বিশ্বাস- স্রস্টা, কোন এক রাতে আমার সকল কষ্ট দূর করে দিবেন। সেদিন আমি বলবো; ‘আজ আমি সত্যি সুখী মানুষ। আমার আর কোন কষ্ট নেই। কোন কষ্ট নেই’..........
যাদের কথা এবং কাজ দুটোতেই আমি মুগ্ধ !
প্রিয়, তারিক আলমগীর ভাই ও তারিকুর রহমান শামীম ভাই
এবং
প্রিয় তারিক রিদওয়ান, প্রিয় বন্ধুবরেষু
আমি আশা করব, আপনি সুযোগ পেলেই আপনার নির্ভরতার হাতখানা
আমার ঘাড়ে রাখবেন- বিশ্বাসী বন্ধুর মতন..........।
ভূমিকা.....
আপনাকে আমি চিনি না, কোন দিন দেখিও নি। তবুও আপনাকে না জানিয়েই আপনার জীবনের কিছু অংশ নিয়ে একটা কিছু লিখার স্পর্ধা দেখালাম। আমায় ক্ষমা করবেন। যোজন যোজন কষ্ট নিয়েও মানুষকে কিভাবে হাসতে হয় তা আপনি জানেন।কিন্তু আপনি এটা জানেন না, এভাবে হাসতে পারাটা একটা গুণ ! কোন দিন আপনার সাথে দেখা হবে কি না জানি না। তবুও দূর থেকে দোয়া করি, আপনি ভালো থাকেন, স্রস্টা যেন আপনাকে সুখের সন্ধান পাইয়ে দেন।
১।
দু’ঠোঁট বাঁকা করে শীষ বাজাচ্ছে হিয়া । শীষ বাজাচ্ছে আর কিছুক্ষণ পর পর পাশের বান্ধবী গুলোকে কি যেন বলছে।
হিয়া যে শিল্পীকে উদ্দেশ্য করে শীষ বাজাচ্ছে তা সে জানে। হিয়া ক্রমাগত শীষ বাজিয়েই যাচ্ছে।
খানিকক্ষণ পর হিয়া তার বান্ধবীদের নিয়ে শিল্পীর পাশে এসে বসল।
কি রে শিল্পী, মন খারাপ ? এমন করে বসে আছিস কেন ??
সাথে সাথেই শিল্পীর বুকটা ধ্ক করে ওঠে। শিল্পী বলে, এমনি।
স্বামী বুঝি ফোন করে নি, তাই না ???
না, না সে কারনে নয়। এমনি মন খারাপ।
হিয়া বলে, ইদানিং তো তোকে মোবাইলে কথা বলতেই দেখি না। জামাইবাবু কি ছেড়ে দিল নাকি তোকে ? নাকি আবার অন্য কোন মেয়ের পাল্লায় পড়েছে ???
কথাটা বলেই হিয়া আর তার বান্ধবীরা হাসতে থাকে।
শিল্পী কিছু বলে না। কেবল অপরাধীর মত চুপ করে থাকে। এদের মত আরো অনেক মানুষ আছে যারা তার ক্ষতস্থানে লবণ দিয়ে তার কষ্ট বাড়াতে ভালোবাসে।
একসময় হাসি থামিয়ে হিয়া বলে: দেখ তোর স্বামী নিশ্চিত অন্য কোন মেয়ের হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
স্বরটাকে দুঃখী দুঃখী করে বলে, তোর জন্য আমার খুব দুঃখ হয়রে শিল্পী।
কথাটা শুনেই শিল্পীর পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। সে বুঝতে পারে, হিয়া সমবেদনায় ব্যাথিত হয়ে কথাটা বলে নি. বরং করুনা করে কথাটা বলেছে।
আর করুণা শিল্পীর একদম পছন্দ না।
কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটিতে শিল্পী পড়ছে। অন্তত এতটুকু বোঝার তার ক্ষমতা হয়েছে যে, কোন মানুষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কোন কথা বলে। কোনটা করুনা, কোনটা সমবেদনায় ব্যথিত হওয়ার ভাষা।
২।
রাত হলেই বাবা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে কি যেন খোঁজেন !
একটু দূর থেকে দেখলে মনে হবে, বাবা যেন মূর্তির মত তাকিয়ে আছেন।
মাঝে মাঝে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বাবা হো হো করে হেসে ওঠেন।
এভাবে একা একা হাসেন, আবার হঠাৎ করেই হাসি থেমে যায়।
আমি বাবার কাছে গিয়ে বসি। কৌতুহলী হয়ে বলি, বাবা প্রতিদিন আপনি কি খোঁজেন ???
অসীম আগ্রহ নিয়ে বাবার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করি।
বাবা বলে, ও শিল্পী.........। স্রস্টাকে খুঁজিরে মা। তিনাকে যে আমার অনেক প্রশ্ন জিঞ্জেস করার আছে।
সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্যই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি।
মা রান্নাঘর থেকে এসে বলেন, শিল্পীর বাবা, প্রতি রাতে কি আপনার এই পাগলামি গুলো না করলে ভালো লাগে না ?
বাবা বলে, পাগলামি না শিল্পীর মা, বল অন্বেষণ। আমার সাথে তুমিও বোস। আকাশের দিকে তকাও। অন্ধকারেরও একটা সৌন্দর্য আছে।
তোমার আমার প্রত্যেকেরই জীবনে কিছু কিছু অন্ধকার মুহূর্ত আছে।
সাথে সাথে শিল্পীর মা বলে, কি সব আবোল-তাবোল বলেন !!!
এর ফাঁকে আমি আস্তে করে আমার রুমের দিকে পা বাড়াই। রুমে ঢুকতেই কি যেন মনে করে আমি আবার মা-বাবার দিকে ফিরে চাই ।
দেখি বাবা মায়ের হাতটা ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।
আমি জানি, তারা আমার জন্যই কাঁদেন। অতি অল্প বয়সে ডিভোর্স পাওয়া মেয়ের অসহায়ত্বে কাঁদেন। আশেপাশের মানুষ যে আমায় নিয়ে নানান কথা বলে, আমায় নিয়ে বাজে মন্তব্য করে সেগুলোর জন্য কাঁদেন।
তাদের কষ্ট দেখে আমার চোখও ঝাপসা হয়ে ওঠে।
মুখ ফিরিয়ে আমি রুমে গিয়ে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে পড়ি। আর চোখের কোণা দিয়ে নীরবে গরম জল গড়িয়ে পড়ে।
কোথা থেকে যেন একটুকরো বিষন্নতা এসে ঠাঁই নিল শিল্পীর মনে, আর সেটি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল তার সমস্ত অস্তিত্ব আর একাকীত্বে।
৩।
কখন যে ঘুম ভেঙে গেছে টেরই পাই নি। টপ টপ করে পানি পড়ার শব্দ কানে আসছে।
তাহলে কি আপু ট্যাপটি খোলা রেখেছে ? আপুর কথা মাথায় আসতেই রাজ্যের চিন্তা এসে মাথায় ভর করল।
আচ্ছা কি করছে আপু ? ঘুমোচ্ছে না কি জেগে আছে ? ধক করে উঠল বুকের ভিতর।
কি করব ? আপুর ঘরে গিয়ে কি একবার দেখে আসব ? না, থাক ।
মাথার ভিতর একপ্রকার শূন্যতার ছড়াছড়ি। মনেহচ্ছে, সময় যেন থমকে গেছে। কোন উৎকন্ঠা নেই। সব কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। চারদিকে নির্লিপ্ততার আবেশ। হঠাৎ বিছানা থেকে উঠতে গিয়েও পারলাম না। স্থির হয়েই রইলাম।
হঠাৎ ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখলাম, শিল্পী আপু দেয়ালের পাশে দাড়িয়ে আছে। একটু পরে দেয়ালে মাথা ঠেকাল। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বলছে, আমার কোন কষ্ট নেই, কোন কষ্ট নেই। আপু কাঁদছে আর কথাটা বলছে।
নিজেকে যেন নিজেই সান্তনা দিচ্ছে। আর কষ্টগুলো গড়িয়ে পড়ছে চোখের লোনা জল হয়ে। দুই বছর প্রেম করার পর বাবা-মায়ের অসম্মতি সত্ত্বেও বিয়ে করা, আবার বিয়ের ৬ মাসের মাথায় ডিভোর্স হয়ে যাওয়া আর মৌন দুঃখে তার মন ভরে গেছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন তার মনের ভিতর।
কাঁদুক আরো বেশি করে কাঁদুক আপু। মনের ভিতর জমে থাকা কষ্ট আর দীর্ঘশ্বাস গুলো যদি তাতে একটু হলেও কমে। তাহলেও যদি একটু হালকা হতে পারে ...........।
আধঘন্টা পরে আমি আপুর রুমে গিয়ে দেখি. সে হাটুতে থুতলি লাগিয়ে বসে আছে। এভাবে আপুকে দেখে আমার খুব মায়া লাগে। আমি কাছে গিয়ে তার পিঠে হাত রাখি।
ঘন-কালো অন্ধকার, তবুও দূরে কোথাও একটু আলো দেখা যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর আস্তে করে আপুকে বলি, আপু.....! সরলতা মানুষকে ছোট করে, কষ্ট দেয় প্রতি মুহূর্তে। জগতে এ সরল মানুষেরাই বাস্তবকে পাশ কাটিয়ে আবেগে ভেসে বেড়ায়। এরা না পায় সুখ, না পায় মর্যাদা।
সাথে সাথেই ফোঁত করে কেঁদে ওঠে আপু। জ্যোৎস্নার ম্লান আলোয় তার চোখদুটো চিক চিক করতে থাকে। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আপু আমার দিকে তাকায়।
আমার কি করা উচিত রে নিতু ? আপুর এই প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাই না। খুব চেষ্টা করি তবুও কিছু মাথায় আসে না। সান্তনা দেওয়ার মত কিছু খুঁজে পাই না। স্থবির মনে হয় সবকিছু- মাথার উপর বিশাল আকাশ এমনকি সময়টাকেও......।
৪।
সেই সন্ধ্যা থেকে একনাগারে পড়ছে শিল্পী। বাইরে কি হচ্ছে কোন খবর নেই। যেন বাইরের উথাল-পাথাল সমুদ্রের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। নির্লিপ্ত হয়ে কেবলমাত্র নিজের জগত নিয়েই ব্যস্ত।
পড়তে পড়তে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে দেখে লিপু তার বিছানায় এসে চুপ করে বসে আছে।
কখন আসলা লিপু ? আমিতো বুঝতেই পারি নি।
বই বন্ধ করে শিল্পী লিপুর পাশে এসে বসে।
লিপু শিল্পীর বেশ ভক্ত। কিছু কিছু মানুষ থাকে যারা অপর কোন মানুষকে অকারনেই অসম্ভব ভালবাসে। লিপুও ঠিক তেমন।
শিল্পী বলে, কি রে মন খারাপ ?
লিপু বলে, হুঁ। কেন রে ?
মা খুব অসুস্থ......। কথাটা বলেই লিপু কাঁদতে কাঁদতে শিল্পীর বুকে শিশুদের মত আচড়ে পড়ে। সাথে সাথেই শিল্পী লিপুকে জড়িয়ে ধরে।
পরম মমতা নিয়ে লিপুর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, কাদিঁস না লিপু। দেখবি অতি অল্প দিনেই মা সুস্থ হয়ে উঠবে। এভাবে বাচ্চা মেয়েদের মত কেউ কাঁদে !!!!!!!!!
তোকে আজ আর তোর রুমে যেতে হবে না, আমার সাথে ঘুমাবি।
কই শুয়ে পড়। আমি তোর কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, তুই ঘুমা।
নিজের যোজন যোজন কষ্ট থাকার পরও অন্য কোন মানুষের কষ্ট দেখলেই তাকে স্থান দেয় হৃদয়ের একেবারে গভীরে.........। হয়ে যায় তারও কাছের মানুষ..........।
৫।
রিক্সায় করে কাজলা থেকে হলের দিকে ফিরছিল শিল্পী।
আশেপাশের দাড়িয়ে থাকা মানুষগুলো ফিসফিস করছে আর বলছে, দেখ ঐ যে শিল্পী, আরে সেই মেয়েটা যে স্বামীর সাথে ৬ মাস সঙসার করার পর ডিভোর্স হয়ে যায়। নিশ্চই মেয়েটার খারাপ কিছু ছিল তাই স্বামী ছেড়ে দিয়েছে।
শিল্পী কিছু বলে না, কেবলই মাথা নিচু করে রিক্সায় বসে থাকে। মাঝে মাঝে ভাবে, আচ্ছা এই পৃথিবীতে কি আমিই একমাত্র ডিভোর্স পাওয়া মেয়ে, আর নেই ??? ডিভোর্স পাওয়াটা কি আমার পাপ, নাকি জীবনের মস্তবড় ভুল যার জন্য প্রায় প্রতিটি মানুষ আমায় খোঁচা দিয়ে কথা বলে ??????
কেউ শিল্পীর এসব প্রশ্নের উত্তর দেয় না।
মাথা নিচু করেই আছে শিল্পী। হঠাৎ এক নারীকণ্ঠ শিল্পী নামে চিৎকার করছে।
রিক্সার পিছনের ফাঁকা অংশ দিয়ে ফিরে তাকাতেই দেখে, তার কলেজ জীবনের বান্ধবী হীরা তাকে ডাকছে।
সাথে সাথেই রিক্সা থামিয়ে সে রিক্সা থেকে নামে।
হীরা কাছে এসেই শিল্পীকে জড়িয়ে ধরে বলে, কতদিন পর দেখা !!!!!!!!!!
বলেই হীরার চোখে আনন্দে জ্বল এসে যায়।
শিল্পী বলে, চল রুমে যাই।
রুমে গিয়েই বিছানায় দুই পা উঠিয়ে হীরা বসে পড়ে। শিল্পী বলে, কি খাবি ?
কিছু না। বোস, দু’জনে গল্প করি।
হীরা অনেকক্ষণ ধরে শিল্পীর দিকে তাকিয়ে আছে। শিল্পী বলে, ওভাবে কি দেখছিস ?
হীরা বলে, তোকে। তোর মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। নিজের যত্ন নেওয়া কি ছেড়ে দিয়েছিস নাকি ??
খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে শিল্পী বলে, না ছেড়ে দিই নি।
হীরা শিল্পীর গালে আলতো করে হাত রেখে বলে, কি হয়েছে রে তোর ?
আমার না ডিভোর্স হয়ে গেছে ........।
কথাটা শুনেই হীরার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়। কি বলিস এসব ??? বিস্ময়ের ভঙ্গিতে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আাছে হীরা। যেন সবকিছু থেমে গিয়েছে। অস্ত যাওয়া সূর্য, মাথার উপর বিশাল আকাশ, সময় কিংবা স্বপ্নবাজ মানুষের স্বপুনাও কিছুক্ষনের জন্য থমকে গেছে।
শিল্পী বলে,
তুই তো জানিস আমি অভিককে ভালোবাসতাম। বিশ্বাস কর, খুব মমতা নিয়ে ভালোবেসেছিলাম। এমন অনেক দিন গিয়েছে, আমরা সারাদিন বাইরে বেড়িয়েছি। আমার অন্য অনেক বান্ধবী বলত, এসব নাকি একদম ঠিক না। আমি বলতাম, কি জানি !
দুজন দুজনকে সারাদিনের সব কথাই বলতাম। আমার পরীক্ষার কথা ও আমায় মনে করিয়ে দিত; আর আমি ওকে ওর পরীক্ষার কথা মনে করিয়ে দিতাম। আমাদের মাঝে ঝগড়া হতো না, তবুও আমরা ঝগড়া করতাম- সামাজিক অসংগতি, বৈষম্য, অধিকার বিভিন্ন বিষয়ে। পরিশেষে আমরা দু’জনেই একই সিদ্ধান্তে উপনীত হতাম যে, আমরা সবাই সমান। সুন্দর সমাজ আর বসবাসযোগ্য বসুন্ধরা গঠনের জন্য সবার ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ।
দু’জনে পাশাপাশি বসে স্বপ্ন আঁকতাম। বর্ণিল প্রজাপতি, সুনীল আকাশ, রঙিন মেঘ এসে আমাদের স্বপ্নে রং ছড়িয়ে যেত। এভাবে একসময় পারিবারিক অনেক মানুষের অমত কিন্তু আমার প্রবল ইচ্ছায় আমাদের বিয়ে হয়। ছয় মাস আমরা বেশ ভালোভাবেই সংসার করি। চারদিক ভালোবাসার মূর্ছনায় পরিপূর্ণ ছিল। হঠাৎ একদিন একটা ব্যাপার টের পেয়ে যাই আমি । স্রস্টা এই একটা জায়গায় নারীদের পক্ষ নিয়েছেন। নারীরা আগে থেকেই টের পেয়ে যায় কিছু বিষয়। একটু বয়স হলেই টের পায় পৃথিবীর মানুষগুলো তার দিকে কিভাবে তাকাচ্ছে। টের পেয়ে যায় তাকে কিভাবে চলতে বলা হচ্ছে। তেমনি আমিও টের পেয়ে যাই, অভিক অন্য একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। ঐ মেয়েটা তার মনে এতটাই জায়গা করে নিয়েছে যে, সেখানে আর আমার কোন স্থানই ছিল না।
আমি ওকে এই বিষয় নিয়ে প্রশআন করলেই সে এড়িয়ে যেত। একদিন সে সত্যি সত্যি ধরা পড়ে যায়। অবশেষে সে আমার কাছে মুক্তি চায়। আমি তাকে সাথে সাথেই মুক্তি দিয়ে দিই। আমাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। সেইদিন অভিক এর চোখে ছিল মুক্তির আনন্দ, আমার চোখে ছিল কষ্ট আর ভালোবাসার বেদনায় নীল হয়ে যাওয়ার আগুন।
জানিস আমি এখন বাইরে বের হতে পারি না, বাড়িতেও যেতে পারি না। বাড়িতে গেলেই পাড়া-প্রতিবেশিরা বিভিন্ন কথা বলে। আমায় কুলটা, অলক্ষনী বলে গালি দেয়। আবার বলে, আমার নাকি স্বামীর ঘর করার যোগ্যতা নেই বলেই নাকি আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। আর বাসায় আসলেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। মা-বাবা প্রায় সারাক্ষণই কাঁদতে থাকেন। অল্প বয়সে ডিভোর্স পাওয়া মেয়ের অসহায়ত্বে কাঁদেন, সন্তানের কষ্ট লাঘব করতে না পারার কষ্টে কাদেঁন........। আর এখানে ..... ?
আগে এই বিষয়টা কেউ জানত না। অভিক এর কথা জিঞ্জেস করলেই বলতাম, ও ভালো আছে। এখন বিষয়টা সবাই জানে। তবুও আছে যারা আমায় খোটা দেওয়ার জন্য সর্বদা তৈরি থাকে। সুযোগ পেলেই দু’চারটা কথা শুনিয়ে দেয়। হীরা শিল্পীর হাত ধরে রেখেছে। তার হাত দুটি কাঁপছে। শিল্পী বলে, বিশ্বাস কর হীরা, অভিককে ভালবেসে কতবার যে সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করেছে আমার, ও জানে না !!! ও জানে না !!! আজও আমি ওকে আমার হৃদয়ের একেবারে গভীরে অতি যত্নে রেখেছি। ও জানবে না, জানবে না কখনো। জানিস, আমার জীবনে যতগুলো আনন্দ এসেছিল তার সবগুলি কেড়ে নিয়েছে ও একচিলতে......: আর তাইতো আজ আমার হৃদয়ে আজ বাধভাঙা কান্নার আওয়াজ.......
বলতে বলতে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হীরাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমার কী দোষ ছিল রে হীরা ?? বল না হীরা ? ভালোবাসাটাই কি দোষ ???
হীরা কিছু বলে না। শিল্পীকে জড়িয়ে ধরে থাকে কেবলই। সাথে সাথে হীরার চোখ দিয়েও অবিরাম জ্বল গড়িয়ে পড়ে। বাইরে থেকে একটি মানুষকে দেখতে যতই শক্ত মনে হোক না কেন, তার ভিতর কি চলছে তাকি সহজে বোঝা যায় ??? না, যায় না। যোজন যোজন কষ্ট নিয়েও তারা পথ চলে ........নীরবে.......নীভৃতিতে.....
৬।
প্রায় প্রতিরাতেই শিল্পী জানালা দিয়ে ঐ দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি যেন ভাবে। অসংলগ্ন সব ভাবনা।
মাঝে মাঝে ভাবে, এই বুঝি অভিক তার কাছে এলো। এসে বললো, শিল্পী আমায় ক্ষমা করে দাও।
প্রথমে তোমায় ভালবাসলাম, অবশেষে বিয়েও করলাম। কিন্তু কিছুদিন পর হঠাৎ অন্য একটি মেয়ের প্রেমে পড়লাম। তারপর তোমায় ডিভোর্স দিয়ে দিলাম। কিন্তু মনের মাঝে সারাক্ষণই একটা অপরাধবোধ কাজ করত যা আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। আমি খুব কষ্টে আছি শিল্পী। আমায় ক্ষমা করে দাও। নইলে আমি এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাব না।
শিল্পী বলে, তুমি আগে আমার কাছে বাঁধন থেকে মুক্তি চেয়েছিলে, আমি তখনও তোমায় মুক্তি দিয়েছি। আর এখন অপরাধবোধ থেকে মুক্তি চাইছ !!!!!
আমি তো তোমায় কবেই ক্ষমা করে দিয়েছি অভিক। কারন, নারীরা ভালোবেসে ক্ষমা করতে শিখেছে জন্ম থেকেই। প্রতিদিন ভাবি আমি তোমায় ভুলে যাব। কিন্তু পারি না। তোমার দেওয়া কষ্ট আমায় ভুলতে দেয় না ..... কেবলই আমায় তাড়িয়ে বেড়ায়, যেভাবে ঠিক দুঃস্বপ্ন মানুষকে তাড়িয়ে ব্ড়োয়.....।
খানিকক্ষন পরে পিছন ফিরে দেখি সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমায় একা করে, নিঃস করে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে নিঃচিন্তে। কেবলই আমি জেগে আছি, দাড়িয়ে আছি রিক্ত হস্তে, তাকিয়ে আছি অপার শূন্যতা আর এক-সাগর কষ্টের লোনাজ্বল নিয়ে।
আচ্ছা, প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা, প্রবঞ্চিতকে দেয় দাহ। তাহলে অনুতপ্তকে কি দেয় ??????
হঠাৎ তার মন বলে ওঠে, প্রেম অনুতপ্তকে দেয় হাহাকার। তীব্র হাহাকার, পাঁজর ভাঙার মত হাহাকার। ঠিক সেই হাহাকার আজ আমারই মনে..........
কোন কোন পূর্ণিমার রাতে ঘরের জানালা দিয়ে রূপালী আলো ঘরের মেঝেতে এসে পড়ে। আমি জ্যোৎস্নার রূপালী আলোয় আমার ছায়া স্পষ্ট দেখতে পাই। রাতের নিস্তব্ধতায় আমি কেঁপে উঠি। নীরবে জ্বল গড়িয়ে পড়ে আমার দু’চোখের কোণা দিয়ে আর আমি আকুল হৃদয়ে প্রার্থনা করি – আল্লাহ, তুমিতো জানো আমার কষ্টগুলোর কথা। তুমিতো সব পারো, সব.....। পৃথিবীর সকল কিছু তোমারই সৃষ্টি। তোমার কত ক্ষমতা !!!!! তবে আমার কেন এত কষ্ট বলতে পারো ? কি দোষ ছিল আমার ? কবে আমার জীবনে সুখের পায়ড়া আনন্দের বার্তা নিয়ে আসবে ?????
আমি অসীম আগ্রহ নিয়ে স্রস্টার উত্তরের অপেক্ষা করি। অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করা পথিকের মত আমি তাকিয়ে থাকি অনাগত ভবিষ্যতের দিকে। বসন্ত এসে এক-সময় চলে যায়, পূর্ণিমা ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যায়। তবুও আমি স্রস্টার উত্তরের অপেক্ষায় থাকি।
আমার বিশ্বাস- স্রস্টা, কোন এক রাতে আমার সকল কষ্ট দূর করে দিবেন। সেদিন আমি বলবো; ‘আজ আমি সত্যি সুখী মানুষ। আমার আর কোন কষ্ট নেই। কোন কষ্ট নেই’..........
Sunday, January 23, 2011
নীল মানুষ
উৎসর্গ........
পৃথিবীতে যদি সেরা বড়-ভাইদের তালিকা করা হয় তাহলে আমার বিশ্বাস,
তোমার নামটা প্রথম তিনজনের মধ্যে থাকবে। আমার কত ভুল তুমি স্রেফ
কিছু না বলেই ক্ষমা করে দিয়েছ !!!!! আজও আমি শুদ্ধতার প্রতীক্ষায় !!!!
প্রিয় আরিফ ভাইয়া, সাথে প্রিয় খুশী ভাবী।
ভূমিকা ...
নটরডেম কলেজে পড়ার সময় প্রায়ই ঢাকা ভার্সিটির মধুর ক্যান্টিনে বড় ভাইদের সাথে আড্ডা দিতাম। একদিন হঠাৎ এক বড় আপুর সাথে দেখা হয়, কথা হয়। পরে এক বড় ভাইয়ের মুখে শুনি উনার কাষ্টলি অতীতের কথা। বেশ কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। আপুর ঠিকানা জানি না। জানলে, এই লিখাটা পাঠিয়ে দিতাম। আর লিখতাম-আপনার গল্প নিয়ে কিছু একটা লিখার চেষ্টা করেছি। বলুনতো লিখাটা কেমন হয়েছে ?????
১।
ধাক্কা লাগার পরও কয়েক পা এগিয়ে গেল অন্তী। কিন্তু হঠাৎ কি মনে করে ঘুরে দাঁড়াল। পিছন ফিরেই তাকিয়ে দেখে, একজন বৃদ্ধ মানুষ মাটি থেকে কাগজপত্র তুলছে।
অন্তী কিছু বুঝতে পারে না এই মুহুর্তে তার কি করা করা উচিত।
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সে। কিছুটা দ্বিধা বিভক্তি নিয়ে সে এগিয়ে যায়।
আঙ্কেল, আপনি কি ব্যথা পেয়েছেন ???
মাটি থেকে কাগজগুলো তুলে সোজা হয়ে মানুষটি বলে; না, ব্যথা পাই নি।
বাবার বয়সী একটি মানুষকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য অপরাধবোধে ভুগতে থাকে।
আঙ্কেল আমি নিচে দেখে হাঁটছিলাম তো, তাই দেখতে পাই নি।
স্যরি, আমায় মাফ করবেন।
নাকের উপরের চশমাটা একটু উপরে তুলে বলেন, এতে ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই মা। তুমিতো আর ইচ্ছে করে ধাক্কা দাও নি।
একটা প্রশ্ন করি, কিছু মনে করবে না তো ?
না, মনে করবো না আঙ্কেল।
এখনতো সন্ধ্যা হতে চলেছে প্রায়, তবুও তুমি সানগ্লাস পড়ে আছো কেন ???
কিছুক্ষণ ভাবলেশহীণ ভাবে অন্তী দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নিচু করে।
আড়মোরা ভেঙে বলে, ওটা আমার অতীত আঙ্কেল, আমার কাষ্টলী অতীত। আমার অর্ধেক পৃথিবী.......
আপনি এই বিশাল বসুন্ধরার সৌন্দর্য যতটুকু দেখেন, আমি তার অর্ধেক দেখি, উড়ে যাওয়া পাখির দৃশ্য এমনকি আনমনে লেজ নাচানো পাখির মন কেমন করা দৃশ্যও আমি উপভোগ করতে পারি না, আমার মমতাময়ী মায়ের মুখটাও ভালোমত দেখতে পারি না। বাবা যখন আমার হাত ধরে বারান্দায় গিয়ে আমাকে আকাশের তারা দেখিয়ে বলে, এই তারাটির নাম জানিস ??? আমি বলি, জানি না। বাবা গভীর মমতা নিয়ে তারা গুলো দেখিয়ে আমায় তাদের নাম বলে। আকাশের সব তারাগুলো আমার চোখে ধরা পড়ে না; অর্ধেক ধরা দেয়......।
কিছুটা ছটফট করতে থাকে বৃদ্ধ মানুষটি। বলে, মা তোমার কি কোন সমস্যা আছে ????
অন্তী বৃদ্ধ মানুষটির কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে বলে, আঙ্কেল আমার যে সমস্যা তা তো শুধু সমস্যা না,
মরে যাওয়ার মত সমস্যা..........।
২।
সাধারণত অন্তীর রুমে ঢোকার আগে দরজায় নক করে বলে, আপু আমি রাহাত, আসব ???
ওর অভ্যাস-ই এটা। অন্তীর রুমে সে এভাবেই ঢুকে।
মাঝে মাঝে শুধু রুমে ঢুকার আগে দরজায় নক করে। কে বলে চিৎকার করলেও উত্তর দেয় না। অন্তী কিছুটা বিরক্ত হয়ে ভিতরে আসার জন্য বলে।
আর এভাবে রাহাত আসলে অন্তী বুঝতে পারে, আজ সে গোপন কিছু বলবে অথবা তার মন খারাপ...।
যেদিন সে গোপনকিছু বলতে চায় সেদিন সে আমার সাথে প্রথমে কিছু অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে কথা বলে।কথার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট প্রশ্ন করে, যা জানতে চেয়েছে তা জেনে নেবে কৌশলে।
আমি রাহাতের হাত ধরে বলি, কিছু বলবি ভাইয়া ???
রাহাত বলে, না তেমন কিছু না। এমনি গল্প করতে এসেছি।
আপু তুমি কি জান তোমার জন্য একটা সুখবর আছে ???
ম্লান হাসে অন্তী ! রাহাত বলে, ওরকম উৎফুল্লহীণ ভাবে হাসছো কেন ?
অন্তী বলে, এমনি।
সুখবরটা শুনবে না ?? না, শুনতে ইচ্ছে করছে না।
রাহাত অন্তীর হাত-টা ধরে বলে, আহা ! শোনই না প্লিজ। তোমার ভালো লাগবে ।
আবারও ম্লান হাসি হাসে অন্তী।
গভীর চোখে বলে, আমার জন্য কোন সুখবর থাকতে পারে সেটা কবেই ভুলে গেছি। আমি জানি, আমার জন্য কোন সুখবর কখনোই থাকতে পারে না; আগামীতেও আসবে না কখনো।
কথাটা শুনেই রাহাতের মন খারাপ হয়ে যায়।
অন্তী আলতো করে রাহাতের গালে হাত রেখে বলে, তোর মন খারাপ করে দিলাম তাই না ?
বাদ-দে এসব কথা। আচ্ছা বলতো, মানুষ শ্রেষ্ঠ না বৃক্ষ ???
৩।
ঘুম ভেঙে গেল মা’র চিৎকারে।
গতরাতে কেন যেন ঘুম আসছিল না। ছন্নছাড়া চিন্তা আসছিল একটার পর একটা। মাঝরাতে বিছানায় বসেছিলাম। ভেবেছিলাম, কে আমি ? কেন এমন হলো আমার ? কি দোষ ছিল আমার ???
আমার রুমের দরজা খোলা। কাজ নেই তাই রবীন্দ্রসংগীত শুনছি।
আপু তোমায় মা ডাকছে। কথাটা বলতে বলতে রুমে ঢোকে রাহাত।
আমি বিছানা থেকে নামতেই স্যান্ডেলগুলো এগিয়ে দেয়।
রাহাতের এসব কিছু কাজ আমার বেশ ভালো লাগে। আমার কোন কিছু প্রয়োজন হলে সাথে সাথেই সে এনে দেয়। আমার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে নিজেই রিক্সা ডেকে দেয় এমনকি সময় থাকলে সাথেও যায়।
বাইরে থেকে ফিরেই বা স্কুল থেকে ফিরেই প্রথমে আমার খবর নেয়। মাঝে মাঝে নিজেই আমায় আবৃত্তি করে শুনায়..................।
আমি গম্ভীর হয়ে বলি, আমার প্রতি তোর এত ভালবাসা কেন ???
রাহাত বলে, ওভাবে বলছো কেন গম্ভীর হয়ে ???? বোনের প্রতি ভাইয়ের ভালবাসা থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক।
মাথা নিচু করে বলি, মানুষের একটা স্বভাব কি জানিস ?
মানুষ তার ব্যর্থতার কথা গুলো বেশ গম্ভীর করেই বলে।
কোন এক গল্পের বইতে পড়েছিলাম, ভালবাসলে নাকি ছোট্ট করে হলেও তার প্রতিদান দিতে হয়।
কিন্তু আমার না আছে সামর্থ্য, না আছে যোগ্যতা। আমার কাছে এমন কিছুই নেই যে আমি নিজেকে কারো উপযুক্ত ভাবতে পারি।
রাহাত কিছু বলে না। গ্রিল ধরে বাইরের দিকে কেবলই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
আশেপাশের পরিবেশটা বেশ শান্ত, খানিকটা অসহনীয়ও.......
কিছুক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকে রাহাত চলে যায়। আমি জানি, ওর এখন মন খারাপ। এখন সে তার রুমের দরজা লাগিয়ে রুমের মধ্যেই পায়েচারি করবে, আর ভাববে কি করে সে আমার কষ্টগুলো দূর করে দিবে ????
অনেক ভাববে কিন্তু কোন কুল-কিনারা পাবে না। না পেয়ে অবশেষে স্রস্টার কাছে আত্মসমর্পণ করে নীরবে চোখের জ্বল ফেলবে – আমি জানি।
৪।
হ্যালো অন্তী, কই তুই ????
আমি কলা ভবনের সামনে। তোরা কই ?
রনি বলে, কিছু ছোট ভাই এসেছে, তাদের সাথে মধুর ক্যান্টিনে আড্ডা দিচ্ছি। চলে আয়।
অন্তী বলে, আসছি তবে একটু দেরি হবে।
রনি ভাই, অন্তী আপুটা কে ?? আগে আসুক তবেই জানতে পারবি।
ওই যে, ধীর পায়ে হেঁটে আসছে অন্তী।
অন্তী আসতেই রনি দরজার সামনে গিয়ে অন্তীর হাত ধরে তাকে ক্যান্টিনে নিয়ে আসে।
রনি বলে, বোস এখানে। ওরা হলো আমার ছোট ভাই। তোরা পরিচয় দে তোদের.......।
আমি আসিফ; নটরডেম কলেজ, বিঞ্জান, ১ম বর্ষ।
আমি সৌম্য; নটরডেম কলেজ, ১ম বর্ষ মানবিক।
আমি কাজল; নটরডেম কলেজ, ১ম বর্ষ মানবিক।
অন্তী বলে, এবার আমার পরিচয়টা দিই। আমি অন্তী। আই.ই.আর, ঢকা বিশ্ববিদ্যালয়, অনার্স (৪র্থ বর্ষ)।
মাঝে মাঝে চলে এসো ভাইয়ারা, সবাই মিলে গল্প করা যাবে।
রনি, আজ আমি যাই। রাহাতের শরীরটা ভালো নেই। মাথা ব্যথাটা বেড়েছে।
একা যেতে পারবি ??? কল্পনা আছে, ও বলেছে আমার সাথে যাবে।
যাওয়া শুরু করতেই অন্তী, সৌম্য-কাজল’দের দিকে ফিরে তাকাল। সাবলীল ভাবে বলল, আমি জানি তোমাদের মনে এখন একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটার উত্তর রনি দিয়ে দিবে।
কথাটা শেষ করেই অন্তী হাঁটতে শুরু করে।
কাজল আড়মোরা ভেঙে প্রশ্ন করে, প্রায় সন্ধ্যা হতে চলেছে। তারপরও অন্তী আপু সানগ্লাস পরে ছিল কেন ???
মধুর ক্যান্টিনে চলছে বিভিন্ন টেবিলে জমজমাট আড্ডা, কেউ আবার হাত তুলে ওয়েটারকে ডাকছে।
এমন সময় রনি বলে, “অন্তীর একটা চোখ নষ্ট” !!!!!!!
কথাটা কিছুটা কাঁটার মত বিধে আসিফ-সৌম্য আর কাজলের মনে।
অন্তী যাকে ভালবাসত সেই মানুষটিই তার এক চোখ অন্ধ করে দিয়েছে।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তিনজনই রনির দিকে তাকিয়ে আছে।
আসিফ একটু একটু করে রেগে যাচ্ছে আর ঘামছে। মানুষ হয়ে অপর একটি মানুষের এতবড় ক্ষতি করতে তার এতটুকু বাঁধল না !!!!!!!!!!!!!
আড়মোরা ভেঙে চিৎকার করে আসিফ বলে ওঠে, ধিক্কার তোমাদের প্রতি হে মানবসম্প্রদায়, তোমরা যারা অসহায় নারীদের এসিড মারো, ধর্ষণ করো..........
তোমাদের জন্য লজ্জিত হোক আজ গোটা পুরুষ জাতি মানবিকতার অবক্ষয়ের জন্য........
খানিকক্ষণ পরে কাজল বলে ওঠে, মানবতা বিরোধী কাজ করে কেউ টিকে থাকে নি। টিকে থাকে নি নমরুদ, ফেরাউন পর্যন্ত........ তোমরাও একদিন ধ্বংস হবে, তোদের ধ্বংস অনিবার্য....।
৫।
কি করছো বাবা ????
পিছন ফিরে তাকাতেই আসলাম সাহেব দেখতে পান, তার বড় মেয়ে অন্তী !
ও অন্তী ! আয় মা। কিছু করছি না। এমনি বাড়ান্দায় বসে আছি।
না, তুমি কি যেন ভাবছিলে !!!! বল না বাবা .......
সে রকম কিছু নারে মা। ভাবছিলাম, আমি একজন ব্যর্থ মানুষ।
যে মানুষ তার সন্তানদের দুঃখ-কষ্ট দূর করতে পারে না !!!!!
অন্তী তার বাবার হাতটা ধরে বলে, ছিঃ বাবা, ওসব কথা বলে না। কত ভালো শিক্ষায় শিক্ষিত করেছ তুমি আমাদের দুই ভাই-বোনকে !!! মানুষকে মানুষ ভাবতে শিখিয়েছ। মানুষের জন্য, সমাজের জন্য ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণাতো আমরা তুমি আর মা’র কাছেই পেয়েছি বাবা।
একসময় আমাদের গাড়ি ছিল, বড় বাড়ি ছিল। তখন আমরা প্রতিদিনই ভালো খেতাম। ইচ্ছে হলেই বাইরে যেতাম সবাই মিলে........।
আর এখন ! সপ্তাহে মাত্র একদিন মাছ, একদিন গোশত খেতে পারি। সবাই মিলে বাইরে একসাথে বেড়াতে যাওয়াও হয় না।
তখন একপ্রকার সুখ ছিল আর এখন এখনও সুখ আছে কিন্তু একটু অন্যরকম।
তখন মনে হয়েছিল, পৃথিবীটা বুঝি এমনই। রাস্তায় ঘুমানো মানুষগুলোকে দেখলে কষ্ট হত, ভাবতাম, তাদের জন্য যদি কিছু করা যেত !!!!!!!!
আর এখন বস্তির মানুষ গুলোকে দেখলে মায়া হয়। কারন তাদের সাথে আমাদের জীবনযাত্রার কত মিল !!!!!
জীমন মানেই সংগ্রাম, বেঁচে থাকার চেষ্টা.........।
কথাগুলো শুনে বাবা কাঁদতে শুরু করেন।
আমার হাতদুটি চেপে ধরে বলেন, আমায় ক্ষমা করে দিস রে মা। তোর জন্য কিছুই করতে পারলাম না। আমায় ক্ষমা করিস !!!!!
আমি কিছু বলি না। বাবাকে জড়িয়ে ধরি। নীরবে জ্বল গড়িয়ে পড়ে ।
বাবা-মায়েরা এরকমই। সন্তানের ছোট-খাট কষ্টে এমনকি সমস্যায় তারা কাঁদে। কেঁদে বুক ভাসায়। আর আমারতো মহা সমস্যা.........
মাঝে মাঝেই মা আমার ঘরে আসেন বেশ রাত করে। আমার মাথার কাছে বসে মাথার চুলে, কপালে হাত বুলিয়ে দেন। আমি সব টের পাই, ভাল লাগে আমার। কিন্তু খানিকক্ষণ পর মা যখন নাক টানেন তখন আমার বুকের মাঝখান টাতে ব্যথা শুরু হয়।
বুকের ভেতর থেকে সবকিছু ভেঙে আসতে চায়। ব্যর্থ মনে হয় আমার জীবনটা.....।
এই অন্তী ! তোর বাবাকে নিয়ে খেতে আয়।
চল বাবা খেতে যাই। আসলাম সাহেব বলে, তুই যা আমি আসছি।
খাবার টেবিলে খেতে খেতে অন্তী বলে, বাবা ! রবিনের মাথা ব্যথাটা বেড়েছে। আজ দুপুরে সে একবার মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।
অসহায় ভঙ্গিতে বাবা বলে, আমার হাতে তো ডাক্তার দেখানোর টাকা নাইরে মা !!!!!!
আমি কাল ওকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাব বাবা। তুমি ওসব চিন্তা করো না।
৬।
আজ খুব গরম পড়েছে তাই না রে ????
রাহাত বলে, হ্যাঁ।
আপু একটা প্রশ্ন করি, সত্যি করে উত্তর দিবে তো ???
অন্তী বলে, আগে প্রশ্নটা করেই দেখ না বোকা ।
তোমার কানের দুলগুলো কি হলো ????
চুপ করে থেকে অন্তী। রাহাত জিঞ্জেস করে, কি চুপ কেন ???
অপরাধী সুরে বলে, ওগুলো মা’র কাছে রেখে এসেছি। দুল পড়লে আমার কানগুলো আমার কাছেই বড্ড বেশি ভারি লাগে।
অমলিন হাসি হেসে রাহাত বলে, আপু ! যে মিথ্যে বলতে জানে না, তার মিথ্যা কথা বলার চেষ্টা করা মোটেও সাজে না। ধরা পড়ে যায় অতি সহজেই........ যেমনঃ তুমি..........
সাথে সাথেই চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসে দু’জনের.............
আপনি কি হোন রোগীর ??? আমি ওর বড় বোন।
ওর কি কি সমস্যা খুলে বলুন তো........
ওর খুব মাথা ব্যথা হয়। মাঝে মাঝে এমন ব্যথা ওঠে যে ও চিৎকার করতে থাকে। এক সময় ছটফট করতে করতে অঞ্জান হয়ে যায়। আবার কিছুদিন হলো, মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে......।
আর কিছু ??? খাইতে চায় না একদম। গোসলের সময় প্রচুর মাথার চুল ওঠে।
আচ্ছা ঠিক আছে। এই টেষ্টগুলো করিয়ে আমার সাথে দেখা করবেন।
অন্তী বলে, ঠিক আছে। ডাক্তার মিষ্টি হাসে বলে, আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার ভাই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।
এরপর রাহাত আর অন্তী মিলে, হাসপাতালে গিয়ে টেষ্টগুলো করায়।
বাবা দোকান থেকে বাসায় ফিরে জিঞ্জেস করে, কিরে অন্তী ? ডাক্তার কি বললো ???
অন্তী বলে, ডাক্তার টেষ্ট করাতে বলেছে। কাল রিপোর্ট নিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে যাব।
হ্যালো, রনি ? কই তুই ?
আমি এই মুহুর্তে মধুতে। তুই কোথায় ? আমি ল্যাবএইড এ।
রাহাত এর রিপোর্টগুলো ডাক্তারকে দেখাব। তুই একটু আসবি ???
রনি বলে, তুই দাঁড়া আমি আসছি।
আধঘন্টা পর রনি এসে দেখে, অন্তী একটি দেয়ালে মাথা দিয়ে হেলান দিয়ে আছে। এভাবে অন্তীকে দেখে রনি’র বেশ মায়া হয়।
রনি অন্তীর কাঁধে আলতো করে হাত রেখে ডাকে, অন্তী !!!
চমকে ওঠে অন্তী ! ও রনি ! চল ডাক্তারের কাছে যাই .....
রনি, অন্তীর হাত ধরে তাকে ডাক্তারের রুমে নিয়ে যায়।
অন্তী রনির হাত ধরে রেখেছে। তার হাত-দুটি কাঁপছে। বুকটা ধক ধক করছে।
অন্তী কাঁপা কাঁপা গলায় জিঞ্জেস করে, রাহাতের কি হয়েছে ????
ডাক্তার অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলে, সিটি স্ক্যান এর রিপোর্ট-টা ভালো আসে নি .......!!
আমি একাধিকবার চেক করেছি কিন্তু রেজাল্ট একই।
কি রেজাল্ট ? চোখ বড় বড় করে রনি জিঞ্জেস করে ।
ডাক্তার অতি শান্ত গলায় বলে, পেসেন্ট এর ব্রেইন টিউমার হয়েছে.........
কথাটা শুনে অন্তী আর রনি দু’জনেই ধাক্কা খায়। অন্তী যেন কথাটা বিশ্বাস করতে পারছে না।
চোখ বড় করে বিস্ময়ের ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। তার হাত-পা কাঁপছে। শক্ত করে ধরে রেখেছে রনি’র হাতটা।
একটা চোখ দিয়েই এই পৃথিবীটা দেখে অন্তী। সেই চোখটাও তার কষ্টের লোনাজ্বলে ঝাপসা হয়ে আসে।
ডাক্তার বলে, এটা যে ধরনের টিউমার তাতে অপারেশনের কোন বিকল্প নেই। আপনারা যতদূত সম্ভব অপারেশনের ব্যবস্থা করুন।
অন্তী বুঝতে পারে না সে কি বলবে !!!!!!!!!
ঝাপসা চোখ নিয়েই সে অবাক দুষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নীরবে জ্বল গড়িয়ে পড়ে চিবুক বেয়ে। তার মনের ভিতর জ্বলতে থাকে কষ্টের আগুন।
সবকিছু, সবকিছু অর্থহীণ, আর ফালতু মনে হয় তার।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে অন্তীকে বাড়িতে পৌছে দেয় রনি।
এতটা রাস্তা দু’জনের কেউ কথা বলে নি। বোবা হয়ে গেছে দু’জনেই..........
নীল, একেবারে নীল হয়ে গেছে অন্তী.......... কষ্ট আর আশাভঙ্গের বেদনায়...............।
৭।
দু’দিন হলো রাহাতকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রায় সারাদিনই অন্তী, রাহাতের সাথে থাকে। মা দুপুরবেলা খাবার নিয়ে আসে। আবার সন্ধ্যা হলেই বাসায় চলে যান। রাতে আসে বাবা..........
আমি যখন ঘুমোই তখন সারাক্ষণ আপু আমার দিকে তাকিয়ে থাকে আর আমার হাত ধরে থাকে। মাঝে মাঝে আমার গাল ছুঁয়ে দেয়, কপালে হাত বুলিয়ে দেয়।
আমি স্পষ্ট সব টের পাই..........
হঠাৎ ঘুম ভেঙে চোখ খুলতেই দেখি, আপু আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর তার চোখের কোণা দিয়ে টুপ টুপ করে জ্বল পড়ছে। আমি তাকাতেই কি যেন খোঁজার ভান করে অন্য দিকে তাকিয়ে চোখ মুছে ফেলে।
কিছু খাবি ভাইয়া ??? জুস করে দিই ?????
না রে, এখন খাব না। পরে......
আমি জানি, আমি খুব তাড়াতাড়ি মারা যাব।
ইদানিং মা হাসপাতালে আসলেই আমার হাত-টা শক্ত করে ধরে রাখে। মাঝে মাঝে আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদে। তখন আমার খুব কষ্ট হয়। স্থির হয়ে শুয়েও থাকতে পারি না। বুকের ভেতর থেকে সবকিছু বের হয়ে আসতে চায়। মা আমায় জড়িয়ে ধরে থাকেন পরম মমতায়, অসীম নির্ভরতায়।
যেন আমায় কোথাও যেতে দিবেন না। যতবড় ঝড় আসুক না কেন; আমায় নিয়ে যেতে দিবে না। মাতৃত্বের আবরনে আমার চারপাশে দেয়াল তৈরি করে রেখেছে।
আর বাবা !!!!!!!! বাবা আমাকে প্রতিদিনই দেখতে আসেন। কিন্তু কোন দিন আমার কাছে আসেন না। দরজায় দাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
বাবা দেখতে এমনিতে একটু কালো। কষ্টের আগুনে পুড়ে তার মুখখানা আরো বেশি কালো হয়ে গেছে।
বাবাকে আমি কাছে ডাকি কিন্তু তিনি আসেন না !!!!!!!!
আমি বুঝতে পারি, বাবা লজ্জায় আমার কাছে আসেন না।
পিতা হয়েও সন্তানের জন্য কিছু করতে না পারার কষ্টে তিনি নিজেকে ধিক্কার দেন প্রতি মুহুর্তে। নিজের অসহায়ত্বে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন।
সন্ধ্যার দিকে রনি ভাইয়া এসেছিল। অন্তী আপুর সাথে গল্প করছিল। এমন সময় হঠাৎ আমার কানে আসে, অন্তী আপু বলছে –
আমাদের গ্রামে যে ৪ বিঘা জমি ছিল তা বাবা বিক্রি করে দিচ্ছে। বাবা তার দোকানটাও বন্ধক রেখেছে ব্যাংকের কাছে। যা টাকা হয় তা দিয়েই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।
কথাটা শুনেই বুকটা ধক করে ওঠে। মৃত্যু-পথযাত্রী এই আমার বাঁচার আকুল ইচ্ছা প্রকাশের আশা জাগে। তবুও আশা মাড়িয়ে আমি চুপ করে থাকি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই, গন্তব্যহীণ ভাবে ছুটে চলা পাখিদের দেখি........।
মৃত্যু-পথযাত্রী এই আমার জন্য নিজের সমস্তকিছু বিলীন করে দেওয়ার কোন মানেই হয় না। তবুও মা-বাবা তাই করেন সন্তানের জন্যে। নাড়ীর বন্ধন বলে কথা.........
৮।
হ্যালো, রনি ? আমি অন্তী !
এত রাতে কল করলি যে !!!!!! কোন সমস্যা ?
হ্যাঁ, রাহাতের শরীর বেশি খারাপ করেছে। বারবার বমি করছে, আর মাথা ব্যথায় চিৎকার করছে। তুই কি একটু আসতে পারবি ????
ঠিক আছে, আমি আসছি।
রনি হাসপাতালে এসে দেখে অন্তী আর তার মা স্থির হয়ে বসে আছে।
অন্তী রনিকে দেখেই বলে, বাবা ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গিয়েছেন। তুই একটু গিয়ে বাবার সাথে থাক তো .....
রনি ডাক্তারের রুমে ঢুকতেই হঠাৎ কি মনেকরে যেন থমকে দাঁড়াল।
ডাক্তার বলছে, আপনাকে আগে অপারেশনের টাকা আর কিছু ঔষধ-পত্রের টাকা পরিশোধ করতে হবে। নইলে আমরা অপারেশনে যাব না।
অন্তীর বাবা হাত জোর করে বলছে,
ডাক্তার সাহেব, আমার সমস্ত সম্পদ বিক্রি করে যা টাকা হয়েছে তার সবটুকু আমি দিয়ে দিয়েছি। আমার আর কিছুই নেই যে আমি তা বিক্রি করে বাকি টাকা দিতে পারি।
প্লিজ ডাক্তার সাহেব, আমার ছেলেকে বাঁচান।
কথাটা বলতে বলতে, অন্তীর বাবা ডাক্তারের পা পর্যন্ত ধরেন......
পা ধরতেই ডাক্তার বলে, আমরা কিছু করতে পারবো না। সম্পূর্ণ টাকা না দেওয়া পর্যন্ত আমরা অপারেশনে যেতে পারব না। কাল সকালের মধ্যেই আপনি টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করুন।
অসহায় আর পরাজিত মানুষের মত মাথা নিচু করে অন্তীর বাবা ডাক্তারের রুম থেকে বের হয়ে আসে।
বাবাকে দেখেই অন্তী এগিয়ে আসে। বলে, কি হল বাবা ? ডাক্তার কি বলল ?
অন্তীর বাবা মাথা নিচু করেই থাকে। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে, আগামীকাল সকালের মধ্যে সব টাকা পরিশোধ করতে হবে। না হলে তারা অপারেশনে যাবে না।
কথাটা বলেই বাবা অন্যদিকে হাটতে থাকেন।
কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না অন্তী, এমনকি রনি’ও..........
একটাকা বা একহাজার টাকার কথা না.........। পুরো পাঁচ লক্ষ টাকার দরকার।
অন্তী মনে মনে ভাবে, আশরাফুল মাখলুকাত হয়েও মানুষ সত্যিই কত অসহায়, কত নিরীহ !!!!!!!!
আচ্ছা, এটাই কি স্রস্টার কৃতিত্ব ???
কোন উত্তর খুঁজে পায় না অন্তী। কেবল স্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ..........।
রাহাতকে ঘুমের ইনজেকশান দেওয়া হয়েছে। সে ঘুমোচ্ছে।
রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। অন্তীর মা, রাহাতের মাথার পাশে বসে আছে। কোন কথা নেই কারো মুখে।
অন্তী বিছানার পাশে চেয়ারে বসে রাহাতের হাত ধরে তার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আর চোখের কোণা দিয়ে জ্বল ঝড়ছে নীরবে, রাতের নিঃস্তব্ধ পরিবেশের মতই............।
ফজরের আযানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। অন্তীর বাবা আর রনি নামাযে গিয়েছে।
হঠাৎ অন্তী অনুভব করে, রাহাতের শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে।
অন্তী চিৎকার করে ডাকে, নার্স, নার্স।ওর শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। ডাক্তার ডাকুন........
অন্তীর চিৎকার শুনে দায়িত্বে থাকা ডাক্তার আর নার্স ছুটে আসে।
ডাক্তার এসে রাহাতের পার্লস চেক করে। পার্লস নেই।
ডাক্তার রাহাতের বুকে চাপ দেয়.......। কোন কাজ হয় না.....
বুকের ভিতর হার্ট-টাও ধুক ধুক করছে না।
কিছুক্ষণ থেমে ডাক্তার রাহাতের গায়ে জড়িয়ে থাকা সাদা চাদর টা মাথা পর্যন্ত ঢেকে দেয়.......।
দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রাহাতের মা দৌড়ে এসে রাহাতের পা দুটি জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলে ওঠে, বাবারে...... ফিরে আয় আমার কোলে......... আর কাঁদতে থাকে ....... জ্বল গড়িয়ে পড়ে অঝর ধারায়.......
অন্তী মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখের জ্বল যেন শুকিয়ে গেছে।
তারপর ধির পায়ে অন্তী রাহাতের কানের কাছে গিয়ে বলে,
“ ভাইয়া, চলে গেলি রে !!!! ভালোই করেছিস। এই পৃথিবী আমাদের মত অসহায় আর পরাজিত মানুষদের জন্য নয়। বাবা অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু পারে নি......। মনুষ্যত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে কেউ এগিয়েও আসে নি.....। এমনকি ডাক্তার গুলোও নয় !!!!! তুই আমাদের ক্ষমা করিস !!!!! যাবার আগে অন্তত একটি বার আমার সাথে কথাও বললি না ” !!!!!!!!!
রুমের বাইরে অন্তী দাঁড়িয়ে আছে। বাবা আর রনিকে আসতে দেখেই সে এগিয়ে যায়।
এগিয়ে গিয়েই সে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে।
বাবা বলে, চিন্তা করিস না মা। একটা উপায় বের হবেই।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর হৃদয়ের সমস্ত বাতাস বের করে দিয়ে অন্তী বলে, বাবা ! তোমার ছেলে পৃথিবীর সব বন্ধন আর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে। সে আর কোনদিন তোমায় বাবা বলে ডাকবে না; আমায় নিয়ে বাইরে যাবে না........
কেবলই স্মৃতি হয়ে থাকবে...........।
৯।
রাহাত মারা যাবার পর অনেক রকম দুঃচিন্তা ছিল, মা-বাবা কিভাবে সামলাবে নিজেদের, পরিবারটাকে বাবা কিভাবে চালাবে !!!!!!!
কিন্তু রাহাতের জন্য কোন কিছুই আটকে থাকল না। জীবন চলতেই থাকল। খালি সময়গুলোকে আগের চেয়ে বেশি অস্বস্তিকর মনে হতে লাগল। মনেহয় গভীর শূন্যতায় তলিয়ে যাচ্ছি একটু একটু করে।
মাঝে মাঝে ভাবি, একটু বাইরে থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।
রাহাত বেঁচে থাকতে কতদিন ঠিক করেছি- এবার ছুটিতে আমরা সীতাকুন্ড, সিলেট, অথবা কক্সবাজার বেড়াতে যাব।
কিন্তু যাওয়া হয়নি তখনও......। আর এখন ? এখনতো আমি একা। কিভাবে যাব !!!!!!!!
একদিন হঠাৎ করে রাহাতের ট্রাঙ্কটা খুললাম। কত কি সাজিয়ে রেখেছে। আমি জীবনে প্রথম বেতন পেয়ে একটা কলম তাকে উপহার দিয়েছিলাম। সেই কলমটাও অতি যত্নে রেখেছে সে।
স্কুলের প্রতিযোগিতায় যে পৃরস্কার গুলো পেয়েছিল সেগুলোও সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে।
হঠাৎ একটা ডায়েরি দেখতে পেলাম। হাতে নিয়েই পড়তে শুরু করলাম :-
২২-৪-০৬ ইং
রনি ভাইয়া আমায় এমন একটা কথা বলেছে যে আমি সম্পূর্ণ অবাক। বলেছে, তিনি নাকি অনেক চেষ্টা করেও একটা কথা অন্তী আপুকে বলতে পারে নি। কত ভীতু একটা মানুষ !! আরও বলেছে আমি যেন অন্তী আপুকে কোন ভাবেই না বলি।
১৮-৫-০৬ ইং
প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় গণিতে ৯৬ নম্বর পাওয়ার পর ক্লাসের সবাই হাততালি দিয়েছিল। ক্লাস শেষে একটা মেয়ে আসে আমায় বলে, অভিনন্দন। যা লজ্জা পেয়েছিলাম !!!!!!! উত্তরে কিছুই বলতে পারি নি।
২৯-৬-০৬ইং
অন্তী আপুর কষ্টের কথা মনে পড়লেই আমার ভিতরের সবকিছু বের হয়ে আসতে চায়। স্রস্টা যদি আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও আপুর জীবনের সব-কষ্ট দূর করে দিত !!!!!!
১২-৮-০৬ ইং
আপু আজ তোমার জন্মদিন। বাবা-মায়ের অফুরন্ত ভালবাসা তুমি পেয়েছ। সাথে সাথে পেয়েছিলে অন্য একটি মানুষেরও। অথচ তার পরও তোমার জীবনে কত কষ্ট !!! এত ভালবাসা পাওয়ার পরও তুমি প্রতি রাতেই কাঁদ, আমি টের পাই। তুমি কি জান, তোমার কষ্টে আমিও মাঝে মাঝে কেঁদে বুক ভাসাতাম.........?
ডায়েরির লিখাগুলো আর পড়তে ভালো লাগে না। সাথে সাথেই ডায়েরিটা বন্ধ করে রাখি। বিষন্নতায় ডুবে যাই সম্পূর্ণ আমি । ঝাপসা দেখি সব-সবকিছু...........
১০।
ছয় বছর লাগল অনার্স শেষ করতে। রেজাল্ট বেরিয়েছে গত পরশু দিন। আট মাস হল ভার্সিটি যাওয়া হয় না।
মাঝখানে বাড়ি পাল্টেছি বলে, কোন বন্ধু-ই নতুন বাড়ির ঠিকানা জানে না।
ভার্সিটিতে গিয়ে রেজাল্ট দেখছি। হঠাৎ শুনলাম, পেছন থেকে কে যেন অন্তী বলে চিৎকার করছে। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি রনি ।
কাছে এসেই বলে, কত দিন তোকে দেখি না !!!!! তোর কোন খবরও নেই। বাড়ি পাল্টেছিস কিন্তু ঠিকানা পর্যন্ত দিস নি।
চল ! মধুতে গিয়ে গল্প করব......।
মাস্টার্স করবি না ????
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর অন্তী বলে, অনার্সটাই করা হচ্ছিল না ! আর মাস্টার্স !!!!! জানিসতো একবছর বাবা কোন টাকা দিতে পারে নি ।
রনি, আর থাকতে ভালো লাগছে না। আমি যাই। পরে কথা হবে। কথাটা বলেই অন্তী উঠে চলে যায়।
১১।
মা-অন্তী ? আসব ? হ্যাঁ বাবা আস। কিছু বলবে ?
বাবা চোখের চশমাটা আরেকটু উপরে উঠিয়ে বলে, ইয়ে মানে !!!! না থাক !!!!!
বাবা চলে যেতে শুরু করে। পিছন থেকে আমি বলি, তুমি কি বলতে এসেছ আমি জানি বাবা।
উনাকে বসতে বল আমি আসছি। বাবা আমার দিকে একটা প্রশান্তির হাসি দিয়ে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
বিশ মিনিট পর অন্তী বসার ঘরে আসে। এসেই বলে, বাবা আমি উনার সাথে একটু গল্প করতে পারি ???
বাবা, চলে যেতেই উনার পাশের চেয়ারে আমি বসি।
মাথা নিচু করে বলি, আমার বিষয়ে আপনি কতটুকু জানেন ????
পাশের চেয়ারে বসে থাকা মানুষটি বলে, আমি প্রায় সবকিছুই জানি। আর জেনে শুনেই আপনাকে বিয়ে করতে চাই ।
অন্তী বলে,
আমার অন্ধকার অতীতের কিছু অংশ আপনি দেখেছেন ??? তবে আমার ভেতরটুকু কি আপনি দেখেছেন ??
না, দেখেন নি। সেখানে একটি নয়, হাজারো পলিপ আছে। আর এক-একটি পলিপ তৈরি হয়েছে এক-একটি কষ্টের জন্য, ব্যর্থতার জন্য। আপনার আগেও আমার জন্য ছয়টি প্রস্তাব এসেছিল। আমি ফিরিয়ে দিয়েছি কারন তারা বিনিময়ে বাবার কাছে তার সকল জায়গা-জমি চেয়েছিল। তবে আপনি শুধু বাবার কাছে একটি মোটরসাইকেল আর বাবার দোকানটা চেয়েছেন। তাই ভাবলাম আপনার সাথে একটু কথা বলি।
প্রথম ভালবাসার প্রতি মানুষের যেমন আকর্ষণ থাকে তেমনি আমারও ছিল। একটা ছেলেকে ভালবাসতাম। সেও আমায় ভালবেসেছিল। একবছর পর, হঠাৎ জানতে পারি, সে অন্য একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। একদিন আমার সামনে ধরা পড়ে যায় সে। তারপর আর যোগাযোগ হয় নি আমাদের।
বিচ্ছেদের ৮ মাস পর একদিন হঠাৎ আমাদের দেখা হয়। সে আমায় পুচকা খাওয়াতে চায়। কি মনে করে আমিও রাজি হই। কথা বলতে বলতে হঠাৎ সে আমায় জাপটে ধরে আমার মুখে কি যেন ঢেলে দেয়। আমি সরিয়ে দিতেই ওগুলো আমার চোখে এসে পড়ে। আর সেই থেকেই আমার একচোখ অন্ধ...........
আমি জানি, পৃথিবীতে মেয়ের অভাব পড়ে নি যে আমাকে আপনার বিয়ে করতে হবে। আপনি রাজি হয়েছেন কারন বিনিময়ে আপনি একটি মোটরসাইকেল আর বাবার দোকানটা পাবেন। আর সময়ে অসময়ে বাবার কাছে অনান্য সুবিধা নিবেন তাও আমি জানি। আজও আমাদের মত মেয়েরা আপনাদের কাছে পণ্যই রয়ে গেল। যখন ইচ্ছে এসিড মারেন, ধর্ষণ করেন তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেন অব্যবহৃত প্লাস্টিকের মত।
বিনিময়ে কিছু পাওয়ার লোভে আমায় বিয়ে করবেন- এতে আমাদের মাঝে কতটুকু ভালোবাসা থাকবে বলুন ??? কোন দিন কি আপনার উপর আমার সত্যিকারের শ্রদ্ধাবোধ জন্মাবে ??? আমি কি কোন দিন বলতে পারব, আমার স্বামী সত্যিই একজন বড় মনের মানুষ ????
প্রতিরাতেই মা নীরবে কলপাড়ে গিয়ে কাঁদেন। আমার জন্য..........। কখনো একলা চলতে না পারা মেয়ের কষ্টে কাঁদেন, বিয়ে দিতে না পারার কষ্টে কাঁদেন, পদে পদে হোঁচট খাই এই কষ্টে কাঁদেন..........।
দেখুন, বাবাকে যৌতুক দিতে হলে আমি বিয়ে করতে রাজি নই। আমি সেই মানুষটিকে বিয়ে করব না, যে বিনিময়ে কিছু পাওয়ার লোভে আমাকে বিয়ে করবে........। আমি বিয়ে করব সেই মানুষটিকে যে আমার কাষ্টলি অতীতের কথা জেনে কেবল আমার জন্যই আমাকে বিয়ে করবে। আর বিনিময়ে ???
বিনিময়ে আমার কাছে চাইবে শুধু একবুক ভালোবাসা............।
পাশে থাকা মানুষটি মাথা নিচু করে আছে।
অন্তী চেয়ার থেকে উঠে তার রুমের দিকে চলে যেতে শুরু করে।
হঠাৎ পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে, বুকে হাত দিয়ে একবার ভাবুন তো, আপনি কি সেরকম একজন মানুষ ??????
পৃথিবীতে যদি সেরা বড়-ভাইদের তালিকা করা হয় তাহলে আমার বিশ্বাস,
তোমার নামটা প্রথম তিনজনের মধ্যে থাকবে। আমার কত ভুল তুমি স্রেফ
কিছু না বলেই ক্ষমা করে দিয়েছ !!!!! আজও আমি শুদ্ধতার প্রতীক্ষায় !!!!
প্রিয় আরিফ ভাইয়া, সাথে প্রিয় খুশী ভাবী।
ভূমিকা ...
নটরডেম কলেজে পড়ার সময় প্রায়ই ঢাকা ভার্সিটির মধুর ক্যান্টিনে বড় ভাইদের সাথে আড্ডা দিতাম। একদিন হঠাৎ এক বড় আপুর সাথে দেখা হয়, কথা হয়। পরে এক বড় ভাইয়ের মুখে শুনি উনার কাষ্টলি অতীতের কথা। বেশ কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। আপুর ঠিকানা জানি না। জানলে, এই লিখাটা পাঠিয়ে দিতাম। আর লিখতাম-আপনার গল্প নিয়ে কিছু একটা লিখার চেষ্টা করেছি। বলুনতো লিখাটা কেমন হয়েছে ?????
১।
ধাক্কা লাগার পরও কয়েক পা এগিয়ে গেল অন্তী। কিন্তু হঠাৎ কি মনে করে ঘুরে দাঁড়াল। পিছন ফিরেই তাকিয়ে দেখে, একজন বৃদ্ধ মানুষ মাটি থেকে কাগজপত্র তুলছে।
অন্তী কিছু বুঝতে পারে না এই মুহুর্তে তার কি করা করা উচিত।
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সে। কিছুটা দ্বিধা বিভক্তি নিয়ে সে এগিয়ে যায়।
আঙ্কেল, আপনি কি ব্যথা পেয়েছেন ???
মাটি থেকে কাগজগুলো তুলে সোজা হয়ে মানুষটি বলে; না, ব্যথা পাই নি।
বাবার বয়সী একটি মানুষকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য অপরাধবোধে ভুগতে থাকে।
আঙ্কেল আমি নিচে দেখে হাঁটছিলাম তো, তাই দেখতে পাই নি।
স্যরি, আমায় মাফ করবেন।
নাকের উপরের চশমাটা একটু উপরে তুলে বলেন, এতে ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই মা। তুমিতো আর ইচ্ছে করে ধাক্কা দাও নি।
একটা প্রশ্ন করি, কিছু মনে করবে না তো ?
না, মনে করবো না আঙ্কেল।
এখনতো সন্ধ্যা হতে চলেছে প্রায়, তবুও তুমি সানগ্লাস পড়ে আছো কেন ???
কিছুক্ষণ ভাবলেশহীণ ভাবে অন্তী দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নিচু করে।
আড়মোরা ভেঙে বলে, ওটা আমার অতীত আঙ্কেল, আমার কাষ্টলী অতীত। আমার অর্ধেক পৃথিবী.......
আপনি এই বিশাল বসুন্ধরার সৌন্দর্য যতটুকু দেখেন, আমি তার অর্ধেক দেখি, উড়ে যাওয়া পাখির দৃশ্য এমনকি আনমনে লেজ নাচানো পাখির মন কেমন করা দৃশ্যও আমি উপভোগ করতে পারি না, আমার মমতাময়ী মায়ের মুখটাও ভালোমত দেখতে পারি না। বাবা যখন আমার হাত ধরে বারান্দায় গিয়ে আমাকে আকাশের তারা দেখিয়ে বলে, এই তারাটির নাম জানিস ??? আমি বলি, জানি না। বাবা গভীর মমতা নিয়ে তারা গুলো দেখিয়ে আমায় তাদের নাম বলে। আকাশের সব তারাগুলো আমার চোখে ধরা পড়ে না; অর্ধেক ধরা দেয়......।
কিছুটা ছটফট করতে থাকে বৃদ্ধ মানুষটি। বলে, মা তোমার কি কোন সমস্যা আছে ????
অন্তী বৃদ্ধ মানুষটির কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে বলে, আঙ্কেল আমার যে সমস্যা তা তো শুধু সমস্যা না,
মরে যাওয়ার মত সমস্যা..........।
২।
সাধারণত অন্তীর রুমে ঢোকার আগে দরজায় নক করে বলে, আপু আমি রাহাত, আসব ???
ওর অভ্যাস-ই এটা। অন্তীর রুমে সে এভাবেই ঢুকে।
মাঝে মাঝে শুধু রুমে ঢুকার আগে দরজায় নক করে। কে বলে চিৎকার করলেও উত্তর দেয় না। অন্তী কিছুটা বিরক্ত হয়ে ভিতরে আসার জন্য বলে।
আর এভাবে রাহাত আসলে অন্তী বুঝতে পারে, আজ সে গোপন কিছু বলবে অথবা তার মন খারাপ...।
যেদিন সে গোপনকিছু বলতে চায় সেদিন সে আমার সাথে প্রথমে কিছু অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে কথা বলে।কথার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট প্রশ্ন করে, যা জানতে চেয়েছে তা জেনে নেবে কৌশলে।
আমি রাহাতের হাত ধরে বলি, কিছু বলবি ভাইয়া ???
রাহাত বলে, না তেমন কিছু না। এমনি গল্প করতে এসেছি।
আপু তুমি কি জান তোমার জন্য একটা সুখবর আছে ???
ম্লান হাসে অন্তী ! রাহাত বলে, ওরকম উৎফুল্লহীণ ভাবে হাসছো কেন ?
অন্তী বলে, এমনি।
সুখবরটা শুনবে না ?? না, শুনতে ইচ্ছে করছে না।
রাহাত অন্তীর হাত-টা ধরে বলে, আহা ! শোনই না প্লিজ। তোমার ভালো লাগবে ।
আবারও ম্লান হাসি হাসে অন্তী।
গভীর চোখে বলে, আমার জন্য কোন সুখবর থাকতে পারে সেটা কবেই ভুলে গেছি। আমি জানি, আমার জন্য কোন সুখবর কখনোই থাকতে পারে না; আগামীতেও আসবে না কখনো।
কথাটা শুনেই রাহাতের মন খারাপ হয়ে যায়।
অন্তী আলতো করে রাহাতের গালে হাত রেখে বলে, তোর মন খারাপ করে দিলাম তাই না ?
বাদ-দে এসব কথা। আচ্ছা বলতো, মানুষ শ্রেষ্ঠ না বৃক্ষ ???
৩।
ঘুম ভেঙে গেল মা’র চিৎকারে।
গতরাতে কেন যেন ঘুম আসছিল না। ছন্নছাড়া চিন্তা আসছিল একটার পর একটা। মাঝরাতে বিছানায় বসেছিলাম। ভেবেছিলাম, কে আমি ? কেন এমন হলো আমার ? কি দোষ ছিল আমার ???
আমার রুমের দরজা খোলা। কাজ নেই তাই রবীন্দ্রসংগীত শুনছি।
আপু তোমায় মা ডাকছে। কথাটা বলতে বলতে রুমে ঢোকে রাহাত।
আমি বিছানা থেকে নামতেই স্যান্ডেলগুলো এগিয়ে দেয়।
রাহাতের এসব কিছু কাজ আমার বেশ ভালো লাগে। আমার কোন কিছু প্রয়োজন হলে সাথে সাথেই সে এনে দেয়। আমার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে নিজেই রিক্সা ডেকে দেয় এমনকি সময় থাকলে সাথেও যায়।
বাইরে থেকে ফিরেই বা স্কুল থেকে ফিরেই প্রথমে আমার খবর নেয়। মাঝে মাঝে নিজেই আমায় আবৃত্তি করে শুনায়..................।
আমি গম্ভীর হয়ে বলি, আমার প্রতি তোর এত ভালবাসা কেন ???
রাহাত বলে, ওভাবে বলছো কেন গম্ভীর হয়ে ???? বোনের প্রতি ভাইয়ের ভালবাসা থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক।
মাথা নিচু করে বলি, মানুষের একটা স্বভাব কি জানিস ?
মানুষ তার ব্যর্থতার কথা গুলো বেশ গম্ভীর করেই বলে।
কোন এক গল্পের বইতে পড়েছিলাম, ভালবাসলে নাকি ছোট্ট করে হলেও তার প্রতিদান দিতে হয়।
কিন্তু আমার না আছে সামর্থ্য, না আছে যোগ্যতা। আমার কাছে এমন কিছুই নেই যে আমি নিজেকে কারো উপযুক্ত ভাবতে পারি।
রাহাত কিছু বলে না। গ্রিল ধরে বাইরের দিকে কেবলই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
আশেপাশের পরিবেশটা বেশ শান্ত, খানিকটা অসহনীয়ও.......
কিছুক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকে রাহাত চলে যায়। আমি জানি, ওর এখন মন খারাপ। এখন সে তার রুমের দরজা লাগিয়ে রুমের মধ্যেই পায়েচারি করবে, আর ভাববে কি করে সে আমার কষ্টগুলো দূর করে দিবে ????
অনেক ভাববে কিন্তু কোন কুল-কিনারা পাবে না। না পেয়ে অবশেষে স্রস্টার কাছে আত্মসমর্পণ করে নীরবে চোখের জ্বল ফেলবে – আমি জানি।
৪।
হ্যালো অন্তী, কই তুই ????
আমি কলা ভবনের সামনে। তোরা কই ?
রনি বলে, কিছু ছোট ভাই এসেছে, তাদের সাথে মধুর ক্যান্টিনে আড্ডা দিচ্ছি। চলে আয়।
অন্তী বলে, আসছি তবে একটু দেরি হবে।
রনি ভাই, অন্তী আপুটা কে ?? আগে আসুক তবেই জানতে পারবি।
ওই যে, ধীর পায়ে হেঁটে আসছে অন্তী।
অন্তী আসতেই রনি দরজার সামনে গিয়ে অন্তীর হাত ধরে তাকে ক্যান্টিনে নিয়ে আসে।
রনি বলে, বোস এখানে। ওরা হলো আমার ছোট ভাই। তোরা পরিচয় দে তোদের.......।
আমি আসিফ; নটরডেম কলেজ, বিঞ্জান, ১ম বর্ষ।
আমি সৌম্য; নটরডেম কলেজ, ১ম বর্ষ মানবিক।
আমি কাজল; নটরডেম কলেজ, ১ম বর্ষ মানবিক।
অন্তী বলে, এবার আমার পরিচয়টা দিই। আমি অন্তী। আই.ই.আর, ঢকা বিশ্ববিদ্যালয়, অনার্স (৪র্থ বর্ষ)।
মাঝে মাঝে চলে এসো ভাইয়ারা, সবাই মিলে গল্প করা যাবে।
রনি, আজ আমি যাই। রাহাতের শরীরটা ভালো নেই। মাথা ব্যথাটা বেড়েছে।
একা যেতে পারবি ??? কল্পনা আছে, ও বলেছে আমার সাথে যাবে।
যাওয়া শুরু করতেই অন্তী, সৌম্য-কাজল’দের দিকে ফিরে তাকাল। সাবলীল ভাবে বলল, আমি জানি তোমাদের মনে এখন একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটার উত্তর রনি দিয়ে দিবে।
কথাটা শেষ করেই অন্তী হাঁটতে শুরু করে।
কাজল আড়মোরা ভেঙে প্রশ্ন করে, প্রায় সন্ধ্যা হতে চলেছে। তারপরও অন্তী আপু সানগ্লাস পরে ছিল কেন ???
মধুর ক্যান্টিনে চলছে বিভিন্ন টেবিলে জমজমাট আড্ডা, কেউ আবার হাত তুলে ওয়েটারকে ডাকছে।
এমন সময় রনি বলে, “অন্তীর একটা চোখ নষ্ট” !!!!!!!
কথাটা কিছুটা কাঁটার মত বিধে আসিফ-সৌম্য আর কাজলের মনে।
অন্তী যাকে ভালবাসত সেই মানুষটিই তার এক চোখ অন্ধ করে দিয়েছে।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তিনজনই রনির দিকে তাকিয়ে আছে।
আসিফ একটু একটু করে রেগে যাচ্ছে আর ঘামছে। মানুষ হয়ে অপর একটি মানুষের এতবড় ক্ষতি করতে তার এতটুকু বাঁধল না !!!!!!!!!!!!!
আড়মোরা ভেঙে চিৎকার করে আসিফ বলে ওঠে, ধিক্কার তোমাদের প্রতি হে মানবসম্প্রদায়, তোমরা যারা অসহায় নারীদের এসিড মারো, ধর্ষণ করো..........
তোমাদের জন্য লজ্জিত হোক আজ গোটা পুরুষ জাতি মানবিকতার অবক্ষয়ের জন্য........
খানিকক্ষণ পরে কাজল বলে ওঠে, মানবতা বিরোধী কাজ করে কেউ টিকে থাকে নি। টিকে থাকে নি নমরুদ, ফেরাউন পর্যন্ত........ তোমরাও একদিন ধ্বংস হবে, তোদের ধ্বংস অনিবার্য....।
৫।
কি করছো বাবা ????
পিছন ফিরে তাকাতেই আসলাম সাহেব দেখতে পান, তার বড় মেয়ে অন্তী !
ও অন্তী ! আয় মা। কিছু করছি না। এমনি বাড়ান্দায় বসে আছি।
না, তুমি কি যেন ভাবছিলে !!!! বল না বাবা .......
সে রকম কিছু নারে মা। ভাবছিলাম, আমি একজন ব্যর্থ মানুষ।
যে মানুষ তার সন্তানদের দুঃখ-কষ্ট দূর করতে পারে না !!!!!
অন্তী তার বাবার হাতটা ধরে বলে, ছিঃ বাবা, ওসব কথা বলে না। কত ভালো শিক্ষায় শিক্ষিত করেছ তুমি আমাদের দুই ভাই-বোনকে !!! মানুষকে মানুষ ভাবতে শিখিয়েছ। মানুষের জন্য, সমাজের জন্য ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণাতো আমরা তুমি আর মা’র কাছেই পেয়েছি বাবা।
একসময় আমাদের গাড়ি ছিল, বড় বাড়ি ছিল। তখন আমরা প্রতিদিনই ভালো খেতাম। ইচ্ছে হলেই বাইরে যেতাম সবাই মিলে........।
আর এখন ! সপ্তাহে মাত্র একদিন মাছ, একদিন গোশত খেতে পারি। সবাই মিলে বাইরে একসাথে বেড়াতে যাওয়াও হয় না।
তখন একপ্রকার সুখ ছিল আর এখন এখনও সুখ আছে কিন্তু একটু অন্যরকম।
তখন মনে হয়েছিল, পৃথিবীটা বুঝি এমনই। রাস্তায় ঘুমানো মানুষগুলোকে দেখলে কষ্ট হত, ভাবতাম, তাদের জন্য যদি কিছু করা যেত !!!!!!!!
আর এখন বস্তির মানুষ গুলোকে দেখলে মায়া হয়। কারন তাদের সাথে আমাদের জীবনযাত্রার কত মিল !!!!!
জীমন মানেই সংগ্রাম, বেঁচে থাকার চেষ্টা.........।
কথাগুলো শুনে বাবা কাঁদতে শুরু করেন।
আমার হাতদুটি চেপে ধরে বলেন, আমায় ক্ষমা করে দিস রে মা। তোর জন্য কিছুই করতে পারলাম না। আমায় ক্ষমা করিস !!!!!
আমি কিছু বলি না। বাবাকে জড়িয়ে ধরি। নীরবে জ্বল গড়িয়ে পড়ে ।
বাবা-মায়েরা এরকমই। সন্তানের ছোট-খাট কষ্টে এমনকি সমস্যায় তারা কাঁদে। কেঁদে বুক ভাসায়। আর আমারতো মহা সমস্যা.........
মাঝে মাঝেই মা আমার ঘরে আসেন বেশ রাত করে। আমার মাথার কাছে বসে মাথার চুলে, কপালে হাত বুলিয়ে দেন। আমি সব টের পাই, ভাল লাগে আমার। কিন্তু খানিকক্ষণ পর মা যখন নাক টানেন তখন আমার বুকের মাঝখান টাতে ব্যথা শুরু হয়।
বুকের ভেতর থেকে সবকিছু ভেঙে আসতে চায়। ব্যর্থ মনে হয় আমার জীবনটা.....।
এই অন্তী ! তোর বাবাকে নিয়ে খেতে আয়।
চল বাবা খেতে যাই। আসলাম সাহেব বলে, তুই যা আমি আসছি।
খাবার টেবিলে খেতে খেতে অন্তী বলে, বাবা ! রবিনের মাথা ব্যথাটা বেড়েছে। আজ দুপুরে সে একবার মাথা ঘুরে পড়ে গেছে।
অসহায় ভঙ্গিতে বাবা বলে, আমার হাতে তো ডাক্তার দেখানোর টাকা নাইরে মা !!!!!!
আমি কাল ওকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাব বাবা। তুমি ওসব চিন্তা করো না।
৬।
আজ খুব গরম পড়েছে তাই না রে ????
রাহাত বলে, হ্যাঁ।
আপু একটা প্রশ্ন করি, সত্যি করে উত্তর দিবে তো ???
অন্তী বলে, আগে প্রশ্নটা করেই দেখ না বোকা ।
তোমার কানের দুলগুলো কি হলো ????
চুপ করে থেকে অন্তী। রাহাত জিঞ্জেস করে, কি চুপ কেন ???
অপরাধী সুরে বলে, ওগুলো মা’র কাছে রেখে এসেছি। দুল পড়লে আমার কানগুলো আমার কাছেই বড্ড বেশি ভারি লাগে।
অমলিন হাসি হেসে রাহাত বলে, আপু ! যে মিথ্যে বলতে জানে না, তার মিথ্যা কথা বলার চেষ্টা করা মোটেও সাজে না। ধরা পড়ে যায় অতি সহজেই........ যেমনঃ তুমি..........
সাথে সাথেই চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসে দু’জনের.............
আপনি কি হোন রোগীর ??? আমি ওর বড় বোন।
ওর কি কি সমস্যা খুলে বলুন তো........
ওর খুব মাথা ব্যথা হয়। মাঝে মাঝে এমন ব্যথা ওঠে যে ও চিৎকার করতে থাকে। এক সময় ছটফট করতে করতে অঞ্জান হয়ে যায়। আবার কিছুদিন হলো, মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে......।
আর কিছু ??? খাইতে চায় না একদম। গোসলের সময় প্রচুর মাথার চুল ওঠে।
আচ্ছা ঠিক আছে। এই টেষ্টগুলো করিয়ে আমার সাথে দেখা করবেন।
অন্তী বলে, ঠিক আছে। ডাক্তার মিষ্টি হাসে বলে, আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার ভাই তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।
এরপর রাহাত আর অন্তী মিলে, হাসপাতালে গিয়ে টেষ্টগুলো করায়।
বাবা দোকান থেকে বাসায় ফিরে জিঞ্জেস করে, কিরে অন্তী ? ডাক্তার কি বললো ???
অন্তী বলে, ডাক্তার টেষ্ট করাতে বলেছে। কাল রিপোর্ট নিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে যাব।
হ্যালো, রনি ? কই তুই ?
আমি এই মুহুর্তে মধুতে। তুই কোথায় ? আমি ল্যাবএইড এ।
রাহাত এর রিপোর্টগুলো ডাক্তারকে দেখাব। তুই একটু আসবি ???
রনি বলে, তুই দাঁড়া আমি আসছি।
আধঘন্টা পর রনি এসে দেখে, অন্তী একটি দেয়ালে মাথা দিয়ে হেলান দিয়ে আছে। এভাবে অন্তীকে দেখে রনি’র বেশ মায়া হয়।
রনি অন্তীর কাঁধে আলতো করে হাত রেখে ডাকে, অন্তী !!!
চমকে ওঠে অন্তী ! ও রনি ! চল ডাক্তারের কাছে যাই .....
রনি, অন্তীর হাত ধরে তাকে ডাক্তারের রুমে নিয়ে যায়।
অন্তী রনির হাত ধরে রেখেছে। তার হাত-দুটি কাঁপছে। বুকটা ধক ধক করছে।
অন্তী কাঁপা কাঁপা গলায় জিঞ্জেস করে, রাহাতের কি হয়েছে ????
ডাক্তার অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলে, সিটি স্ক্যান এর রিপোর্ট-টা ভালো আসে নি .......!!
আমি একাধিকবার চেক করেছি কিন্তু রেজাল্ট একই।
কি রেজাল্ট ? চোখ বড় বড় করে রনি জিঞ্জেস করে ।
ডাক্তার অতি শান্ত গলায় বলে, পেসেন্ট এর ব্রেইন টিউমার হয়েছে.........
কথাটা শুনে অন্তী আর রনি দু’জনেই ধাক্কা খায়। অন্তী যেন কথাটা বিশ্বাস করতে পারছে না।
চোখ বড় করে বিস্ময়ের ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। তার হাত-পা কাঁপছে। শক্ত করে ধরে রেখেছে রনি’র হাতটা।
একটা চোখ দিয়েই এই পৃথিবীটা দেখে অন্তী। সেই চোখটাও তার কষ্টের লোনাজ্বলে ঝাপসা হয়ে আসে।
ডাক্তার বলে, এটা যে ধরনের টিউমার তাতে অপারেশনের কোন বিকল্প নেই। আপনারা যতদূত সম্ভব অপারেশনের ব্যবস্থা করুন।
অন্তী বুঝতে পারে না সে কি বলবে !!!!!!!!!
ঝাপসা চোখ নিয়েই সে অবাক দুষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নীরবে জ্বল গড়িয়ে পড়ে চিবুক বেয়ে। তার মনের ভিতর জ্বলতে থাকে কষ্টের আগুন।
সবকিছু, সবকিছু অর্থহীণ, আর ফালতু মনে হয় তার।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে অন্তীকে বাড়িতে পৌছে দেয় রনি।
এতটা রাস্তা দু’জনের কেউ কথা বলে নি। বোবা হয়ে গেছে দু’জনেই..........
নীল, একেবারে নীল হয়ে গেছে অন্তী.......... কষ্ট আর আশাভঙ্গের বেদনায়...............।
৭।
দু’দিন হলো রাহাতকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রায় সারাদিনই অন্তী, রাহাতের সাথে থাকে। মা দুপুরবেলা খাবার নিয়ে আসে। আবার সন্ধ্যা হলেই বাসায় চলে যান। রাতে আসে বাবা..........
আমি যখন ঘুমোই তখন সারাক্ষণ আপু আমার দিকে তাকিয়ে থাকে আর আমার হাত ধরে থাকে। মাঝে মাঝে আমার গাল ছুঁয়ে দেয়, কপালে হাত বুলিয়ে দেয়।
আমি স্পষ্ট সব টের পাই..........
হঠাৎ ঘুম ভেঙে চোখ খুলতেই দেখি, আপু আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর তার চোখের কোণা দিয়ে টুপ টুপ করে জ্বল পড়ছে। আমি তাকাতেই কি যেন খোঁজার ভান করে অন্য দিকে তাকিয়ে চোখ মুছে ফেলে।
কিছু খাবি ভাইয়া ??? জুস করে দিই ?????
না রে, এখন খাব না। পরে......
আমি জানি, আমি খুব তাড়াতাড়ি মারা যাব।
ইদানিং মা হাসপাতালে আসলেই আমার হাত-টা শক্ত করে ধরে রাখে। মাঝে মাঝে আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদে। তখন আমার খুব কষ্ট হয়। স্থির হয়ে শুয়েও থাকতে পারি না। বুকের ভেতর থেকে সবকিছু বের হয়ে আসতে চায়। মা আমায় জড়িয়ে ধরে থাকেন পরম মমতায়, অসীম নির্ভরতায়।
যেন আমায় কোথাও যেতে দিবেন না। যতবড় ঝড় আসুক না কেন; আমায় নিয়ে যেতে দিবে না। মাতৃত্বের আবরনে আমার চারপাশে দেয়াল তৈরি করে রেখেছে।
আর বাবা !!!!!!!! বাবা আমাকে প্রতিদিনই দেখতে আসেন। কিন্তু কোন দিন আমার কাছে আসেন না। দরজায় দাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
বাবা দেখতে এমনিতে একটু কালো। কষ্টের আগুনে পুড়ে তার মুখখানা আরো বেশি কালো হয়ে গেছে।
বাবাকে আমি কাছে ডাকি কিন্তু তিনি আসেন না !!!!!!!!
আমি বুঝতে পারি, বাবা লজ্জায় আমার কাছে আসেন না।
পিতা হয়েও সন্তানের জন্য কিছু করতে না পারার কষ্টে তিনি নিজেকে ধিক্কার দেন প্রতি মুহুর্তে। নিজের অসহায়ত্বে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন।
সন্ধ্যার দিকে রনি ভাইয়া এসেছিল। অন্তী আপুর সাথে গল্প করছিল। এমন সময় হঠাৎ আমার কানে আসে, অন্তী আপু বলছে –
আমাদের গ্রামে যে ৪ বিঘা জমি ছিল তা বাবা বিক্রি করে দিচ্ছে। বাবা তার দোকানটাও বন্ধক রেখেছে ব্যাংকের কাছে। যা টাকা হয় তা দিয়েই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।
কথাটা শুনেই বুকটা ধক করে ওঠে। মৃত্যু-পথযাত্রী এই আমার বাঁচার আকুল ইচ্ছা প্রকাশের আশা জাগে। তবুও আশা মাড়িয়ে আমি চুপ করে থাকি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই, গন্তব্যহীণ ভাবে ছুটে চলা পাখিদের দেখি........।
মৃত্যু-পথযাত্রী এই আমার জন্য নিজের সমস্তকিছু বিলীন করে দেওয়ার কোন মানেই হয় না। তবুও মা-বাবা তাই করেন সন্তানের জন্যে। নাড়ীর বন্ধন বলে কথা.........
৮।
হ্যালো, রনি ? আমি অন্তী !
এত রাতে কল করলি যে !!!!!! কোন সমস্যা ?
হ্যাঁ, রাহাতের শরীর বেশি খারাপ করেছে। বারবার বমি করছে, আর মাথা ব্যথায় চিৎকার করছে। তুই কি একটু আসতে পারবি ????
ঠিক আছে, আমি আসছি।
রনি হাসপাতালে এসে দেখে অন্তী আর তার মা স্থির হয়ে বসে আছে।
অন্তী রনিকে দেখেই বলে, বাবা ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গিয়েছেন। তুই একটু গিয়ে বাবার সাথে থাক তো .....
রনি ডাক্তারের রুমে ঢুকতেই হঠাৎ কি মনেকরে যেন থমকে দাঁড়াল।
ডাক্তার বলছে, আপনাকে আগে অপারেশনের টাকা আর কিছু ঔষধ-পত্রের টাকা পরিশোধ করতে হবে। নইলে আমরা অপারেশনে যাব না।
অন্তীর বাবা হাত জোর করে বলছে,
ডাক্তার সাহেব, আমার সমস্ত সম্পদ বিক্রি করে যা টাকা হয়েছে তার সবটুকু আমি দিয়ে দিয়েছি। আমার আর কিছুই নেই যে আমি তা বিক্রি করে বাকি টাকা দিতে পারি।
প্লিজ ডাক্তার সাহেব, আমার ছেলেকে বাঁচান।
কথাটা বলতে বলতে, অন্তীর বাবা ডাক্তারের পা পর্যন্ত ধরেন......
পা ধরতেই ডাক্তার বলে, আমরা কিছু করতে পারবো না। সম্পূর্ণ টাকা না দেওয়া পর্যন্ত আমরা অপারেশনে যেতে পারব না। কাল সকালের মধ্যেই আপনি টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করুন।
অসহায় আর পরাজিত মানুষের মত মাথা নিচু করে অন্তীর বাবা ডাক্তারের রুম থেকে বের হয়ে আসে।
বাবাকে দেখেই অন্তী এগিয়ে আসে। বলে, কি হল বাবা ? ডাক্তার কি বলল ?
অন্তীর বাবা মাথা নিচু করেই থাকে। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে, আগামীকাল সকালের মধ্যে সব টাকা পরিশোধ করতে হবে। না হলে তারা অপারেশনে যাবে না।
কথাটা বলেই বাবা অন্যদিকে হাটতে থাকেন।
কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না অন্তী, এমনকি রনি’ও..........
একটাকা বা একহাজার টাকার কথা না.........। পুরো পাঁচ লক্ষ টাকার দরকার।
অন্তী মনে মনে ভাবে, আশরাফুল মাখলুকাত হয়েও মানুষ সত্যিই কত অসহায়, কত নিরীহ !!!!!!!!
আচ্ছা, এটাই কি স্রস্টার কৃতিত্ব ???
কোন উত্তর খুঁজে পায় না অন্তী। কেবল স্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ..........।
রাহাতকে ঘুমের ইনজেকশান দেওয়া হয়েছে। সে ঘুমোচ্ছে।
রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। অন্তীর মা, রাহাতের মাথার পাশে বসে আছে। কোন কথা নেই কারো মুখে।
অন্তী বিছানার পাশে চেয়ারে বসে রাহাতের হাত ধরে তার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আর চোখের কোণা দিয়ে জ্বল ঝড়ছে নীরবে, রাতের নিঃস্তব্ধ পরিবেশের মতই............।
ফজরের আযানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। অন্তীর বাবা আর রনি নামাযে গিয়েছে।
হঠাৎ অন্তী অনুভব করে, রাহাতের শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে।
অন্তী চিৎকার করে ডাকে, নার্স, নার্স।ওর শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। ডাক্তার ডাকুন........
অন্তীর চিৎকার শুনে দায়িত্বে থাকা ডাক্তার আর নার্স ছুটে আসে।
ডাক্তার এসে রাহাতের পার্লস চেক করে। পার্লস নেই।
ডাক্তার রাহাতের বুকে চাপ দেয়.......। কোন কাজ হয় না.....
বুকের ভিতর হার্ট-টাও ধুক ধুক করছে না।
কিছুক্ষণ থেমে ডাক্তার রাহাতের গায়ে জড়িয়ে থাকা সাদা চাদর টা মাথা পর্যন্ত ঢেকে দেয়.......।
দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রাহাতের মা দৌড়ে এসে রাহাতের পা দুটি জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলে ওঠে, বাবারে...... ফিরে আয় আমার কোলে......... আর কাঁদতে থাকে ....... জ্বল গড়িয়ে পড়ে অঝর ধারায়.......
অন্তী মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখের জ্বল যেন শুকিয়ে গেছে।
তারপর ধির পায়ে অন্তী রাহাতের কানের কাছে গিয়ে বলে,
“ ভাইয়া, চলে গেলি রে !!!! ভালোই করেছিস। এই পৃথিবী আমাদের মত অসহায় আর পরাজিত মানুষদের জন্য নয়। বাবা অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু পারে নি......। মনুষ্যত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে কেউ এগিয়েও আসে নি.....। এমনকি ডাক্তার গুলোও নয় !!!!! তুই আমাদের ক্ষমা করিস !!!!! যাবার আগে অন্তত একটি বার আমার সাথে কথাও বললি না ” !!!!!!!!!
রুমের বাইরে অন্তী দাঁড়িয়ে আছে। বাবা আর রনিকে আসতে দেখেই সে এগিয়ে যায়।
এগিয়ে গিয়েই সে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে।
বাবা বলে, চিন্তা করিস না মা। একটা উপায় বের হবেই।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর হৃদয়ের সমস্ত বাতাস বের করে দিয়ে অন্তী বলে, বাবা ! তোমার ছেলে পৃথিবীর সব বন্ধন আর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে। সে আর কোনদিন তোমায় বাবা বলে ডাকবে না; আমায় নিয়ে বাইরে যাবে না........
কেবলই স্মৃতি হয়ে থাকবে...........।
৯।
রাহাত মারা যাবার পর অনেক রকম দুঃচিন্তা ছিল, মা-বাবা কিভাবে সামলাবে নিজেদের, পরিবারটাকে বাবা কিভাবে চালাবে !!!!!!!
কিন্তু রাহাতের জন্য কোন কিছুই আটকে থাকল না। জীবন চলতেই থাকল। খালি সময়গুলোকে আগের চেয়ে বেশি অস্বস্তিকর মনে হতে লাগল। মনেহয় গভীর শূন্যতায় তলিয়ে যাচ্ছি একটু একটু করে।
মাঝে মাঝে ভাবি, একটু বাইরে থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।
রাহাত বেঁচে থাকতে কতদিন ঠিক করেছি- এবার ছুটিতে আমরা সীতাকুন্ড, সিলেট, অথবা কক্সবাজার বেড়াতে যাব।
কিন্তু যাওয়া হয়নি তখনও......। আর এখন ? এখনতো আমি একা। কিভাবে যাব !!!!!!!!
একদিন হঠাৎ করে রাহাতের ট্রাঙ্কটা খুললাম। কত কি সাজিয়ে রেখেছে। আমি জীবনে প্রথম বেতন পেয়ে একটা কলম তাকে উপহার দিয়েছিলাম। সেই কলমটাও অতি যত্নে রেখেছে সে।
স্কুলের প্রতিযোগিতায় যে পৃরস্কার গুলো পেয়েছিল সেগুলোও সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে।
হঠাৎ একটা ডায়েরি দেখতে পেলাম। হাতে নিয়েই পড়তে শুরু করলাম :-
২২-৪-০৬ ইং
রনি ভাইয়া আমায় এমন একটা কথা বলেছে যে আমি সম্পূর্ণ অবাক। বলেছে, তিনি নাকি অনেক চেষ্টা করেও একটা কথা অন্তী আপুকে বলতে পারে নি। কত ভীতু একটা মানুষ !! আরও বলেছে আমি যেন অন্তী আপুকে কোন ভাবেই না বলি।
১৮-৫-০৬ ইং
প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় গণিতে ৯৬ নম্বর পাওয়ার পর ক্লাসের সবাই হাততালি দিয়েছিল। ক্লাস শেষে একটা মেয়ে আসে আমায় বলে, অভিনন্দন। যা লজ্জা পেয়েছিলাম !!!!!!! উত্তরে কিছুই বলতে পারি নি।
২৯-৬-০৬ইং
অন্তী আপুর কষ্টের কথা মনে পড়লেই আমার ভিতরের সবকিছু বের হয়ে আসতে চায়। স্রস্টা যদি আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও আপুর জীবনের সব-কষ্ট দূর করে দিত !!!!!!
১২-৮-০৬ ইং
আপু আজ তোমার জন্মদিন। বাবা-মায়ের অফুরন্ত ভালবাসা তুমি পেয়েছ। সাথে সাথে পেয়েছিলে অন্য একটি মানুষেরও। অথচ তার পরও তোমার জীবনে কত কষ্ট !!! এত ভালবাসা পাওয়ার পরও তুমি প্রতি রাতেই কাঁদ, আমি টের পাই। তুমি কি জান, তোমার কষ্টে আমিও মাঝে মাঝে কেঁদে বুক ভাসাতাম.........?
ডায়েরির লিখাগুলো আর পড়তে ভালো লাগে না। সাথে সাথেই ডায়েরিটা বন্ধ করে রাখি। বিষন্নতায় ডুবে যাই সম্পূর্ণ আমি । ঝাপসা দেখি সব-সবকিছু...........
১০।
ছয় বছর লাগল অনার্স শেষ করতে। রেজাল্ট বেরিয়েছে গত পরশু দিন। আট মাস হল ভার্সিটি যাওয়া হয় না।
মাঝখানে বাড়ি পাল্টেছি বলে, কোন বন্ধু-ই নতুন বাড়ির ঠিকানা জানে না।
ভার্সিটিতে গিয়ে রেজাল্ট দেখছি। হঠাৎ শুনলাম, পেছন থেকে কে যেন অন্তী বলে চিৎকার করছে। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি রনি ।
কাছে এসেই বলে, কত দিন তোকে দেখি না !!!!! তোর কোন খবরও নেই। বাড়ি পাল্টেছিস কিন্তু ঠিকানা পর্যন্ত দিস নি।
চল ! মধুতে গিয়ে গল্প করব......।
মাস্টার্স করবি না ????
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর অন্তী বলে, অনার্সটাই করা হচ্ছিল না ! আর মাস্টার্স !!!!! জানিসতো একবছর বাবা কোন টাকা দিতে পারে নি ।
রনি, আর থাকতে ভালো লাগছে না। আমি যাই। পরে কথা হবে। কথাটা বলেই অন্তী উঠে চলে যায়।
১১।
মা-অন্তী ? আসব ? হ্যাঁ বাবা আস। কিছু বলবে ?
বাবা চোখের চশমাটা আরেকটু উপরে উঠিয়ে বলে, ইয়ে মানে !!!! না থাক !!!!!
বাবা চলে যেতে শুরু করে। পিছন থেকে আমি বলি, তুমি কি বলতে এসেছ আমি জানি বাবা।
উনাকে বসতে বল আমি আসছি। বাবা আমার দিকে একটা প্রশান্তির হাসি দিয়ে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
বিশ মিনিট পর অন্তী বসার ঘরে আসে। এসেই বলে, বাবা আমি উনার সাথে একটু গল্প করতে পারি ???
বাবা, চলে যেতেই উনার পাশের চেয়ারে আমি বসি।
মাথা নিচু করে বলি, আমার বিষয়ে আপনি কতটুকু জানেন ????
পাশের চেয়ারে বসে থাকা মানুষটি বলে, আমি প্রায় সবকিছুই জানি। আর জেনে শুনেই আপনাকে বিয়ে করতে চাই ।
অন্তী বলে,
আমার অন্ধকার অতীতের কিছু অংশ আপনি দেখেছেন ??? তবে আমার ভেতরটুকু কি আপনি দেখেছেন ??
না, দেখেন নি। সেখানে একটি নয়, হাজারো পলিপ আছে। আর এক-একটি পলিপ তৈরি হয়েছে এক-একটি কষ্টের জন্য, ব্যর্থতার জন্য। আপনার আগেও আমার জন্য ছয়টি প্রস্তাব এসেছিল। আমি ফিরিয়ে দিয়েছি কারন তারা বিনিময়ে বাবার কাছে তার সকল জায়গা-জমি চেয়েছিল। তবে আপনি শুধু বাবার কাছে একটি মোটরসাইকেল আর বাবার দোকানটা চেয়েছেন। তাই ভাবলাম আপনার সাথে একটু কথা বলি।
প্রথম ভালবাসার প্রতি মানুষের যেমন আকর্ষণ থাকে তেমনি আমারও ছিল। একটা ছেলেকে ভালবাসতাম। সেও আমায় ভালবেসেছিল। একবছর পর, হঠাৎ জানতে পারি, সে অন্য একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। একদিন আমার সামনে ধরা পড়ে যায় সে। তারপর আর যোগাযোগ হয় নি আমাদের।
বিচ্ছেদের ৮ মাস পর একদিন হঠাৎ আমাদের দেখা হয়। সে আমায় পুচকা খাওয়াতে চায়। কি মনে করে আমিও রাজি হই। কথা বলতে বলতে হঠাৎ সে আমায় জাপটে ধরে আমার মুখে কি যেন ঢেলে দেয়। আমি সরিয়ে দিতেই ওগুলো আমার চোখে এসে পড়ে। আর সেই থেকেই আমার একচোখ অন্ধ...........
আমি জানি, পৃথিবীতে মেয়ের অভাব পড়ে নি যে আমাকে আপনার বিয়ে করতে হবে। আপনি রাজি হয়েছেন কারন বিনিময়ে আপনি একটি মোটরসাইকেল আর বাবার দোকানটা পাবেন। আর সময়ে অসময়ে বাবার কাছে অনান্য সুবিধা নিবেন তাও আমি জানি। আজও আমাদের মত মেয়েরা আপনাদের কাছে পণ্যই রয়ে গেল। যখন ইচ্ছে এসিড মারেন, ধর্ষণ করেন তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেন অব্যবহৃত প্লাস্টিকের মত।
বিনিময়ে কিছু পাওয়ার লোভে আমায় বিয়ে করবেন- এতে আমাদের মাঝে কতটুকু ভালোবাসা থাকবে বলুন ??? কোন দিন কি আপনার উপর আমার সত্যিকারের শ্রদ্ধাবোধ জন্মাবে ??? আমি কি কোন দিন বলতে পারব, আমার স্বামী সত্যিই একজন বড় মনের মানুষ ????
প্রতিরাতেই মা নীরবে কলপাড়ে গিয়ে কাঁদেন। আমার জন্য..........। কখনো একলা চলতে না পারা মেয়ের কষ্টে কাঁদেন, বিয়ে দিতে না পারার কষ্টে কাঁদেন, পদে পদে হোঁচট খাই এই কষ্টে কাঁদেন..........।
দেখুন, বাবাকে যৌতুক দিতে হলে আমি বিয়ে করতে রাজি নই। আমি সেই মানুষটিকে বিয়ে করব না, যে বিনিময়ে কিছু পাওয়ার লোভে আমাকে বিয়ে করবে........। আমি বিয়ে করব সেই মানুষটিকে যে আমার কাষ্টলি অতীতের কথা জেনে কেবল আমার জন্যই আমাকে বিয়ে করবে। আর বিনিময়ে ???
বিনিময়ে আমার কাছে চাইবে শুধু একবুক ভালোবাসা............।
পাশে থাকা মানুষটি মাথা নিচু করে আছে।
অন্তী চেয়ার থেকে উঠে তার রুমের দিকে চলে যেতে শুরু করে।
হঠাৎ পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে, বুকে হাত দিয়ে একবার ভাবুন তো, আপনি কি সেরকম একজন মানুষ ??????
Subscribe to:
Posts (Atom)